এই ইদে ‘ঈদের’ স্মৃতিচারণ

এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের ছোটোবেলাতেই ‘ঈদ’ হতো। এখন হয় না। হবে কি করে? এখন তো হ্রস্ব-ই দিয়ে লেখা হয়। তাই ‘ঈদ’-এর অস্তিত্বই নেই। তাই আগে যেমন মামা-চাচাদের কাছে ‍শুনতাম “তোরা আর কি ঈদ পালন করিস রে, ঈদ তো হতো আমাদের টাইমে”। ওই একই স্টাইলে আমরা যদি আমাদের ছোটো ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগ্নে-ভাগ্নির কাছে তেমন গল্প করি, টেকনিক্যালি আমাদের ভুল প্রমাণ করতে কেউ পারবে না। তা অবস্থা-পরিস্থিতি যতোটাই কাছাকাছি হোক না কেনো।

তবে আমাদের শৈশব আর এখনকার শৈশব মোটেও কাছাকাছি লেভেলের না। এক টাইপের পোস্ট প্রায়ই দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়- অনলি নাইন্টিজ কিডস উইল রিমেমবার। বা অনলি নাইন্টিজ কিডস ক্যান রিলেট। ওই পোস্টগুলো ঘাটলেও বোঝা যায়। যেমন সে সময় ছিলো কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসানো, এরোপ্লেন বানিয়ে ওড়ানোর চল। ওসব আজকালকার শিশুরাও করে। তবে তারা অনেক অ্যাডভান্সড। আমরা যেখানে নৌকা, উড়োজাহাজ হয়ে বড়জোর সাধারণ পাখি বা ব্যাঙ বানাতাম, সেখানে তারা ইউটুব দেখে ‘ওরিগ্যামি’ করে ডায়নোসর, বাঘ, ভাল্লুক বানিয়ে ফেলছে। আমার এক ভাগ্নে তো কাগজের ‘ব্যাটারাং’ (ব্যাটম্যানের ব্যাট শেপের ছুঁড়ে মারার অস্ত্র) বানিয়ে সেদিন আমায় দেখাচ্ছিলো। আবার ধরুন আমরাই শেষ জেনারেশন যারা সর্বোচ্চ ৫ মেগাবাইটের ফ্লপিডিস্ক আর ১০-১২টা গান ধরে এমন ফিতাওয়ালা ক্যাসেটের সাথে পরিচিত। এখনকার এরা জানেই না ওই বস্তুগুলো কি। আর ক্যাসেটের কথা যখন উঠলোই তখন আমাদের ‘ঈদ’টাও কিন্তু তার সাথে ঠিক জুড়ে যায়। ঈদ উপলক্ষ্যে প্রিয় গায়ক, ব্যান্ডরা নতুন নতুন অডিও অ্যালবাম রিলিজ দিতেন। সেগুলো কেনার জন্য ঈদের শপিংয়ের বাইরেও অনেকের বাজেট থাকতো। আমার গানশোনার হাতেখড়ি বা কানেখড়ি যা-ই বলি সেটা আমার বড় বোনের মাধ্যমে। সে ছিলো একটা টুইনওয়ানের গর্বিত মালিক। তাতে সে যা শুনতো, আমিও তা শুনতে বাধ্য ছিলাম। তার কাছ থেকেই শেখা- যেহেতু একটা অ্যালবামে সব গান ভালো হয় না, তাই বিভিন্ন অ্যালবামের ভালো গানগুলো একটা ক্যাসেটের এপিঠ-ওপিঠে (ফুটনোট: প্রতিটা গানের ক্যাসেটের এ আর বি নামে ‍দু’টো সাইড থাকতো। একটা সাইডের ফিতা চলে গান বাজানো শেষ হয়ে গেলে বের করে উল্টিয়ে আবার ভরলে অন্য সাইডের গান প্রথম থেকে শুরু হতো) রেকর্ড করে নেয়াই সাশ্রয়ী। ক্যাসেটের দোকানের দোকানিরা অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে পছন্দের গানগুলো খালি ক্যাসেটে ভরে দিতো। এই চমৎকার বুদ্ধিটা কোনো এক ইদেই প্রথম কাজে লাগিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। তা দিয়েই পাইরেটেড জগতের অন্ধকারে প্রথম প্রবেশ। অবশ্য ওসব নিয়ে ভাবতে বয়েই গিয়েছিলো সে সময়। টেনশন থাকতো পছন্দের সবগুলো গান ক্যাসেটে জায়গা হবে তো? ঈদের দিন নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে সেসময়ের হিট গানগুলো বাড়িতে বাজবে তো? আর পছন্দের গানগুলো ভরেও যদি দোকানি দু-একটা গান বোনাস হিসেবে দিয়ে দিতো তাহলে আর খুশি দেখতো কে?

ঈদের দিনের স্মৃতি নিয়ে কথা হচ্ছে তো স্মৃতি ধরে রাখার যন্ত্র ফিল্ম ক্যামেরা নিয়েও কথা হবে। সে আরেক টেনশন। এক রিলে থাকে ৩৬টা ছবি তোলার সুযোগ। ৩৬-এর জায়গায় ৩৪-৩৫টায় যখন রিল ফুরিয়ে যায়, কিংবা দু-একটা ছবি জ্বলে যাবার আশংকা তৈরি হয় তখন ঈদটাই মাটি মনে হয়। আর যদি কোনোক্রমে ৩৬-এর জায়গায় ৩৭টা উঠে যায়, মনে হয় ঈদের চাঁদটাই আবার দেখা গেলো।

ঈদের আরেকটা স্মৃতি শপিং। আজকাল তো ঔকাদে কুলালে সারাবছর জুড়েই নতুন জামা কেনা হয়। জামাকাপড়ের পেইজ আর গ্রুপের আপ্পিরা প্রায়ই লাইভে এসে জানান নতুন কি কালেকশন আপনার অপেক্ষায়। আর তাতেই হুড়মুড় করে বিক্রিবাট্টা শেষ। আমাদের শৈশবে কি আর সে উপায় ছিলো? মা-বাবা-ভাই-বোন সবার শপিংয়ের জন্য বছরে একটাই সময়- রোজার ঈদ। কোরবানির ঈদে তো কোরবানিই দেয়া হবে। সেসময় নো নতুন জামাকাপড়। বাড়ির আদরের মেয়েদের জন্য আবার ঈদের তিনবেলার জন্য তিন সেট জামা চাই। ওদিকে ঈদ আবার তিনদিন। কোয়ান্টিটি বাড়ে গিয়ে আরো। সেগুলোর সাথে মিলিয়ে জুতো আর অ্যাক্সেসরিজ। অ্যাক্সেসরিজের জন্য চাঁদরাতে চাঁদনী চক। চাঁদরাত মানে কিন্তু রাত না। ২৯ রোজার পুরো দিন ও সন্ধ্যেটাই ছিলো চাঁদরাত বলে গণ্য। নিউমার্কেট-গাউছিয়া-চাঁদনী চকে পা রাখার জায়গা থাকতো না। আর ছেলেদের শপিং? সেটা বড়জোর একটা পাঞ্জাবি-স্যান্ডেল আর এক সেট শার্ট-প্যান্ট-জুতোয় শেষ। সেগুলোর জন্য নিউ মার্কেট আর এলিফ্যান্ট রোডের দোকানগুলোই ভরসা। আর যেবার প্রথম ইস্টার্ন প্লাজা চালু হলো আমাদের খুশি দেখে কে। কি আজব এক মার্কেট। এক ছাদের নিচে কতোগুলো ফ্লোর আর কতোরকম জিনিসপত্রের দোকান। সিঁড়িগুলোও একা একাই চলে। কাজিনরা মিলে কতোবার যে নিচে নামার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার মজা নিতে গিয়ে আশেপাশের দোকানিদের ধমক খেয়েছি তার হিসেব নেই। ধমক এড়িয়ে কী করে আরো দুষ্টুমি করা যায় তখন টেনশন ছিলো সেগুলো নিয়েই।

টিনেজ বয়সী ছেলেদের জন্য চাঁদরাত মানেই ছিলো উইন্ডো শপিংয়ের দিন। উইন্ডো শপিং মানে উইন্ডো শপিংই। মার্কেটে মার্কেটে ঘোরা। পকেটমানি বলতে কোনো কিছু আমাদের ডিকশনারিতে ছিলো না। তার মানে জিনিসপত্র দেখা ছাড়া উপায় কি। সাথে টিনেজ বয়স উপযোগী হালকা চোখাচোখিতেও ক্ষতি কি? চাঁদ দেখা গেলে তো কথাই নেই। পটকা ফুটিয়ে সারা মহল্লা জানান দিতে হবে। আমাদের মতো গুড বয়রা অবশ্য বিটিভি খুলে কোথায় কখন ঈদ জামাত সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনতো। পরদিনের পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি-ইনার ভেস্ট (যাকে বলা হয় স্যান্ডো গেঞ্জি) গুছিয়ে রাখতো। অন্য বদছেলেরা সেগুলো করতো না। মায়েদের ঘাড়েই চাপতো সে দায়িত্ব। আর মেয়েদের জন্য এখনকার চেয়ে ভিন্ন অবস্থা ছিলো না। তারা নিজেদের ঈদের জামায় শেষমুহূর্তের কাজগুলো সারতো। হয়তো দর্জি একটু বেশি টাইট বা ঢিলে করে ফেলেছে। মায়ের তো আর পরদিনের ব্যাপক রান্নাবান্নার প্রস্তুতি থেকে ফুরসৎ নেই, তাই নিজেই সুঁই-সুতো নিয়ে বসে পড়তো ফিটিং ঠিক করতে। কিংবা জরি-ফিতা লাগিয়ে চলতে থাকে ড্রেসের এক্সট্রা ক্রিয়েটিভ বিউটিফিকেশন। তবে সেটা অবশ্যই সবার থেকে লুকিয়ে। ঈদের দিন পরার আগে নিজের জামাটা কেউ দেখে ফেলার গ্লানি সে যুগে সহ্য করা খুবই কষ্টকর ছিলো। তখন ওগুলোই নিয়েই ছিলো তাদের যতো টেনশন।

আরেকটু বড় হলে যখন টিউশনি করে হাতে দু’টো টাকা আসা শুরু হয় তখন শহরের নানা পয়েন্টে খাবারের দোকানগুলো চোখে পড়তে থাকে। হাতিরপুলে শর্মা হাউজ, বিগ বাইট কিংবা ইস্টার্ন প্লাজার উপরের ফুড কোর্ট, ওদিকে ধানমন্ডি লেক। গুলশান-বনানী তখনও অনেক দূর। সেসময় বড় হয়ে গেছি বলে ঈদে আর কেউ সালামি দিতে চায় না। তাই চাঁদরাতে পুরো টাকাটা খরচ না করে কিছু রেখে দেয়ার টেনশনও কাজ করতো। তখন ওগুলোই ছিলো বড় টেনশন।

ওই এতো এতো টেনশন থাকার পরও জীবনটা অনেক টেনশন ফ্রি-ই ছিলো। রঙিনই ছিলো। যাপিত জীবনের যাঁতাকলে ওসব রঙিন দিন দূর অতীত। কথা উঠতে পারে এসব স্মৃতিচারণের জন্য আমি কোন মহামহিম? এসব তো বিখ্যাত লোকেদের কারবার। আসলে যা যা বললাম এভরি নাইন্টিজ কিড ক্যান রিলেট। আমি তাদের রিপ্রেজেন্টেটিভ মাত্র।

সবাইকে ঈদ … স্যরি, ইদের শুভেচ্ছা।