পূর্ব জার্মানি : প্রথমবারেই হারিয়েছিল সেবারের চ্যাম্পিয়নকে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি পরাজিত হলে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে, নাৎসি ফ্রুয়েরার হিটলারের অধীনস্ত জার্মানি পরাজিত হলে, দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে মিত্রশক্তির তিন মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলে একটি চুক্তি করেছিল। বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা যে বিশাল অঞ্চল নিজেদের আয়ত্বাধীনে এনেছিল, সেই চুক্তি অনুযায়ী তার বিলিবণ্টন হয়। ইউরোপের পূর্বের অংশের কর্তৃত্ব যায় সোভিয়েতদের হাতে, পশ্চিমের কর্তৃত্ব যায় যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের হাতে। আরো সোজা করে বললে, পশ্চিমে পুঁজিবাদ-গণতন্ত্র আর পূর্বে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৪৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব জার্মানি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। নামে স্বাধীন দেশ হলে কী হবে, প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের করদ রাজ্য। তবে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ইস্টার্ন ব্লকের দেশগুলোর মধ্যে পূর্ব জার্মানিই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল সবচেয়ে বেশি।

এমনিতে জার্মানিতে ফুটবলের চল অনেক পুরনো। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েতের দখলে থাকা পূর্ব জার্মানিতে সকল ফুটবল ক্লাব নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। সেই নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আবারো ফুটবল চালু করার প্রচেষ্টাও চলছিল নিয়মিত। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে হেলমুট শানকে এমনকি পূর্ব জার্মানি থেকে পালিয়ে পশ্চিমে চলে আসতে হয়েছিল। বিভক্তির পুরোটা কাল জুড়েই অবশ্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে এমনি নিয়মিতই মানুষ পালিয়ে আসতো। সেটা ঠেকাতেই মূলত বার্লিন দেয়াল দেয়া হয়। বসানো হয়েছিল বুবি ট্র্যাপও। পশ্চিম জার্মানি অবশ্য এ বাবদে উদারই ছিল। কারণ লাভটা তো তাদেরই হতো। এই যেমন ওই পূর্ব জার্মানি থেকে পালিয়ে আসা হেলমুট শানের কোচিংয়েই সত্তরের শুরুতে তাদের দলটা হয়ে উঠেছিল অজেয়। ১৯৭২-এর ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে ১৯৭৪-এ জিতেছিল তাদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা।

১৯৪৯ সালে রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর পূর্ব জার্মানিতে ফের ফুটবল চালু হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৫১ সালে দেশটি ফিফার সহযোগী সদস্য হয়, ১৯৫২-তে পূর্ণ সদস্য। ১৯৫৪ সালে তাদের প্রতিবেশি, কিংবা বলা ভালো তাদের আর্চরাইভাল পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়। ঘটনাটা কেবল পশ্চিম জার্মানিতেই ফুটবলের নবজাগরণ ঘটায়নি, তার ছোঁয়া এসে লেগেছিল পূর্ব পাড়েও।

১৯৫৪ সালে পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলে তার ছোঁয়া এসে লেগেছিল পূর্ব পাড়েও

সেই বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে অবশ্য পূর্ব জার্মানিকে বিবেচনাই করা হয়নি। তবে পরের বিশ্বকাপ থেকে পূর্ব জার্মানি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের শক্ত প্রতিপক্ষই হয়ে ওঠে। প্রায় প্রতিবারই তারা বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা নিয়েই বাছাইপর্ব খেলেও, বারবারই ব্যর্থ হচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত তারা সফল হলো ১৯৭৪-এ। সেবার আবার আয়োজক তাদের আর্চরাইভাল পশ্চিম জার্মানি। ভাগ্যবিধাতাও তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। গ্রুপিংয়ে দুই জার্মানি পরল একই গ্রুপে।

 ১৯৭৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে মাঠে নামে পূর্ব জার্মানি

সেবার পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার। দলপতি জার্মান কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ওরফে কাইজার (সম্রাট)। আছে দ্য বোম্বার খ্যাত স্ট্রাইকার গার্ড মুলার। বছর দুয়েক আগে তারা ইউরোপের সেরার মুকুটও মাথায় তুলেছে। তার উপর স্বাগতিক। অন্যদিকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে এলেও, পূর্ব জার্মানিও নিতান্ত মন্দ দল ছিল না। এর আগের অলিম্পিকেই তারা ফুটবলে ব্রোঞ্জ জিতেছে। পরের দুই অলিম্পিকে জিতেছে যথাক্রমে সোনা আর রুপা।

দুই জার্মানি গ্রুপ রাউন্ডের প্রথম দুই ম্যাচেই দ্বিতীয় পর্ব নিশ্চিত করে মাঠেও সেই প্রমাণ রাখল। তৃতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হলো দুই আর্চরাইভাল, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি। ম্যাচটা কেবল সাধারণ একটা ফুটবল ম্যাচের মাহাত্ম্যেই সীমাবদ্ধ রইল না। বরং ভিন্ন আদর্শের দুই জার্মানির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আত্মসম্মানের প্রতীকী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে উঠল। আর সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে সেই লড়াইয়ে জিতে গেল পূর্ব জার্মানি। ইউরোপ সেরাকে পেছনে ফেলে হয়ে গেল গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন।

দ্বিতীয় রাউন্ডে অবশ্য তারা আর অমন অঘটন ঘটাতে পারেনি। তবে একেবারে খারাপও করেনি। নেদারল্যান্ডস-ব্রাজিলের কাছে হারলেও, আর্জেন্টিনার সাথে ড্র করেছিল। তাদের পেছনে ফেলে গ্রুপে তৃতীয়ও হয় তারা। অন্যদিকে তাদের কাছে হেরে যাওয়া পশ্চিম জার্মানি পরের সবগুলো ম্যাচ জিতে দ্বিতীয়বারের মতো উঁচিয়ে ধরে বিশ্বকাপের শিরোপা।

এই গোলটির বদৌলতে পূর্ব জার্মানি দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনার সাথে এগিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত খেলা ড্র হয়

প্রথম বিশ্বকাপেই এমন দুর্দান্ত সাফল্য অর্জনের পরেও আর কখনোই বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছাতে পারেনি পূর্ব জার্মানি। তবে হ্যাঁ, সম্ভাবনা জাগিয়েছিল বেশ কয়েকবার। সর্বশেষ ১৯৯০ বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছে গিয়েছিল। শেষ গ্রুপ ম্যাচে অস্ট্রিয়ার সাথে দরকার ছিল কেবল ড্র করার। কিন্তু হেরে বসলে সেবারও কপাল পোড়ে তাদের।

 পূর্ব জার্মানির কাছে হেরে যাওয়া পশ্চিম জার্মানি পরের সবগুলো ম্যাচ জিতে দ্বিতীয়বারের মতো উঁচিয়ে ধরে বিশ্বকাপের শিরোপা

তারপর তো পূর্ব জার্মানি-পশ্চিম জার্মানি বলে আলাদা দেশই আর রইল না। ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে দুই জার্মানি মিলে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যেমন ছিল, তেমনি আবারো হয়ে গেল এক ও অখণ্ড জার্মানি। বিশ্বযুদ্ধের আগের অখণ্ড জার্মানির সকল ফুটবলীয় উত্তরাধিকার যেমন পেয়েছিল পশ্চিম জার্মানি, তেমনি এই অখণ্ড জার্মানি পেল পশ্চিম জার্মানির সকল ফুটবলীয় উত্তরাধিকার। পশ্চিম জার্মানির সেই তিন বিশ্বকাপ শিরোপা আর দুই ইউরোপিয়ান শিরোপার সাথে আরো একটি করে যুক্ত হয়ে জার্মানির এখন বিশ্বকাপ শিরোপা চারটি, ইউরোপিয়ান শিরোপা তিনটি।

১৯৯০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসে বেলজিয়ামের বিপক্ষে শেষ বারের মতো মাঠে নামে পূর্ব জার্মানি

আর পূর্ব জার্মানি নামের সোভিয়েত ব্লকের সাবেক দেশটি সম্ভাবনাময় হয়েও, ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ করল মাত্র একটি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলেই। সান্ত্বনা কেবল, সেই বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দলটিকে তারা হারিয়েছিল ঠিকই।