সময়টাই ছিলো বেইমানি আর বেইনসাফের। পাকিস্তান নামের উদ্ভট এক রাষ্ট্রের অংশ হয়েও বেইনসাফির শিকার পূর্বদিকের গণমানুষের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এ বছর প্রনয়ণ করেছিলেন সমঅধিকারের ইশতেহার। তবে, ছয় দফার সেই ন্যায্য দাবি মেনে না নিয়ে উল্টো এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে ফের বেইমানি করে পশ্চিমারা।
অথচ এই পূর্বের লোকেরাই কি বীর উদ্যমেই না পাকিস্তানের হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল ঠিক আগের বছরেই! ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীরত্বে রক্ষা পায় পশ্চিম পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণতম শহর লাহোর। বাঙালি পাইলটদের বীরত্বে মহাপ্রতাপশালী ভারতীয় বিমানবাহিনীও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। সে বছরেই সংক্ষিপ্ততম সময়েই অবশ্য যুদ্ধ শেষ হয়! কিন্তু এই যুদ্ধের উত্তেজনা ছিলো এতোই বেশি যে, তাসখন্দে দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের পরদিনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মারাই গেলেন।
সরকারিভাবে বলা হয় হার্ট এটাক, যদিও অনেকে অবশ্য এতে অন্য কিছুর গন্ধ খুঁজে পান। যদিও স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রবীণ এই রাজনীতিকের মৃত্যুতে ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী, ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেন। আর ইনি যে কি ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ ছিলেন সেটা বোঝাতে একটা তথ্যই যথেষ্ট, আর তা হচ্ছে- সেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের উত্তেজনার সময়েও ক্ষমতা নিয়ে প্রথম বছরেই তিনি মস্কো আর ওয়াশিংটন দুই দেশেই রাষ্ট্রীয় সফরে যান।
ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিশাল দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে সেই কঠিন সময়েও ইন্দিরার অবস্থান ছিল ভীষণ রকমের হিসেবি, রুথলেস। দুনিয়ার ঐ বিভ্রান্তির সময়ে উপমহাদেশীয় আয়রন লেডি নির্বিচারে নিজ দেশে মানুষ মেরে, নকশালীদের দমিয়ে দিয়েও ঘরে বাইরে নিজের ক্লিন ইমেজ ধরে রাখেন। দুনিয়ার যে টালমাটাল অবস্থার কথা বলা হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সে বছরে ছিল গোটা আফ্রিকা মহাদেশটাই। ঘানার স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপকার, ব্রিটিশদের সে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া, অভিন্ন আফ্রিকা মহাদেশের শক্তিতে বিশ্বাস করা, প্যন-আফ্রিকানিজমের অগ্রদূত কোয়ামে নক্রুমাকে সে বছর ক্ষমতাচ্যূত করে আফ্রিকানদের স্বাধীনতার স্বপ্নে আঘাত হানে সেদেশেরই কিছু সামরিক অফিসার। একই রকম সামরিক ক্যু হয় নাইজেরিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, আপার ভোল্টাতে (বর্তমানের বুরকিনা ফাসো) পরাজিত ব্রিটিশ হানাদারদের ষড়যন্ত্রে হোমো স্যাপিয়েন্সের জন্মস্থান, পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ মহাদেশ আফ্রিকা পরিণত হয় অশান্তির এক চির আধারে।
এই ব্রিটিশদেরই শয়তানি চালে জন্ম নেয়া ইসরায়েল আর সিরিয়ার মধ্যেও তখন চলছে যুদ্ধ। আফ্রিকানদের মতো মধ্যপ্রাচ্যের মানুষও সাম্রাজ্যবাদের থাবায় হয়ে যায় ছিন্নভিন্ন। এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়াতেও চলছে রক্তস্নান। কেউ বলে দশ লাখ, কেউ বলে বিশ, কেউ বলে পঞ্চাশ লাখ, আসলে সে বছর দেশটির সদাজাগ্রত সামরিক বাহিনী কত মানুষ মেরেছিলো তার কোন লেখাজোখা নেই।
পূর্ব এশিয়ার আরেক দেশ ভিয়েতনামে ছোটখাটো হো-চি-মিনের লাল বাহিনী বুক চিতিয়ে লড়ে গেলেও ব্রিটিশদের তালতো ভাই, স্বভাব চরিত্রে যমজ, মার্কিনরা সমানে বিমান হামলা চালিয়েই যাচ্ছিলো। একই সঙ্গে স্বর্ণপ্রসবা ল্যাটিন আমেরিকায় সামরিক বাহিনীগুলোকে উসকে দিয়ে আর্জেন্টিনা আর ইকুয়েডরে সে বছর জনতার সরকারের পতন ঘটায় সিআইএ। ইউরোপের দেশ স্পেনেও সে বছর বিমানে বিমান সংঘর্ষে হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। ভাগ্যক্রমে ধ্বংসাবশেষ সাগরের পানিতে পড়ায় হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেনি। এত কিছুর মধ্যেও কূটনীতি কিন্তু থেমে ছিলো না। ইন্দিরার কথা তো বলাই হলো, এমনকি ফরাসি প্রেসিডেন্ট শার্ল দো গলও এবছর ন্যাটো থেকে বেরিয়ে আসেন, সফর করেন সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর থেকেও বড় বিস্ময়, সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকো ভ্যাটিকান গিয়ে দেখা করেন পোপের সঙ্গে। সেটাই কোন সোভিয়েত নেতার সঙ্গে পোপের প্রথম সাক্ষাত। ফিয়াটও শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নে গাড়ি বানানো। অন্যদিকে মাও জেদং চীনে তখন সাংস্কৃতিক বিপ্লব করে বেড়াচ্ছিলেন আর চে গুয়েভারা পালিয়ে ছিলেন বলিভিয়ার জঙ্গলে পালিয়ে। এসব টালমাটাল সময়ের মধ্যেও শিল্প সাহিত্য থেমে থাকে না, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউড প্রকাশিত হয় এ বছরেই। পশ্চিমে আগমন ঘটে ডোরস নামক এক ব্যান্ডের আর জন লেনন তো বলেই বসেন যে- বিটলস, যীশুখ্রিষ্টের চেয়েও জনপ্রিয়।
কী আশ্চর্য এক সময়! বেইমানি, বিভ্রান্তি, আশঙ্কার সেই বছরে পশ্চিম জার্মানি আর স্পেনকে বিডে হারিয়ে দিয়ে দ্য গ্রেটেষ্ট শো অন আর্থের আয়োজক হয় ব্রিটেন। শুরুতেই দুই সর্দারজীর কথোপকথনের একটা চুটকি বলে নেওয়া যাক। তখন যুদ্ধ চলছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলাফল নিয়ে আলাপ করছেন দুই সর্দার। তো কোন দেশ হারলে কি হবে তাই নিয়ে কথার এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে জার্মানি যদি হারে তবে দুনিয়া থেকে এঞ্জিনিয়ারিং হারিয়ে যাবে, ফরাসিরা হারলে শিল্প সাহিত্য আর বৃটিশ হারলে দুনিয়া থেকে লোপ পাবে বেইমানি। বেইমানি হারে না, সুতরাং বৃটিশরা হারেনি (স্ট্রিক্টলি, বিশ্বকাপ সেন্সে)। বিশ্বকাপ আয়োজন করে, ছলে-বলে-কৌশলে কাপ ঘরে রেখে, বৃটিশরা বেইমানির কোন চূড়ায় পৌঁছেছে সেটি আবার গোটা দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিলো এ বছরে। ১৯৬৬ ছিল বিশ্বকাপের অষ্টম আসর। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ ১৯৬৬, বাটপারি, ছলচাতুরি আর বেইমানির এক বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডের এ যাবত একমাত্র বিশ্বকাপ ‘বিজয়’।
আগেই আফ্রিকা মহাদেশ নিয়ে কথা হচ্ছিলো। তবে ঐ বিশ্বকাপের আসরে আফ্রিকানরা খেলেইনি। ফিফা নিয়ম করে যে, শুধু নিজেদের মহাদেশ থেকে কোয়ালিফাই করলেই চলবে না, সেই সাথে এশিয়ান কোয়ালিফায়ারদের হারালেই আফ্রিকার কোন দেশ মূল পর্বে খেলতে পারবে। এই আইনটাই ছিল আফ্রিকানদের জন্য অপমানজনক। যদিও বর্ণবাদী রাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফিফা পুনরায় সদস্যপদ দেওয়ার মতো অপকর্ম করে রেখেছে। সবমিলিয়ে এই দুই কারণেই আফ্রিকানরা টুর্নামেন্টটাই বয়কট করে। অবশ্য মজার ব্যাপার হচ্ছে এই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন কিন্তু একজন আফ্রিকান। ওরকম ক্ষিপ্র গতির খেলোয়াড় আজতক ফুটবল বিশ্বে আর দেখা যায়নি। মোজাম্বিকে জন্ম নেয়া ইউসেবীয় তার জাদুতে বিশ্বকে সেই বিশ্বকাপে মোহাবিষ্ট করেছিলেন।
অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অধিকাংশ কলোনি খোয়া গেলেও পর্তুগাল নিজের আফ্রিকান কলোনি মোজাম্বিক আর এঙ্গোলা তখনও ধরে রেখেছিল, আর সেই কারণেই ‘কালো চিতা’ ইউসেবিও পর্তুগালের হয়ে খেলেন।
সেটি ছিল পর্তুগালেরও প্রথম বিশ্বকাপ আর সেবার এশিয়া থেকে খেলা একমাত্র দেশ উত্তর কোরিয়াও প্রথমবারের মতোই খেলে চূড়ান্ত পর্বে। এই দুই দেশই বিশ্বকাপ মাতিয়ে তোলে অপ্রত্যাশিত সাফল্যে। সে আলাপ আমরা যাবো একটু পরেই। পর্তুগালসহ ইউরোপের দশটা, ল্যাটিন আমেরিকার চারটি আর মেক্সিকো এবং উত্তর কোরিয়া চার গ্রুপে ভাগ হয়ে অংশ নেয়। প্রতিটি ম্যাচই টেলিভিশনে সরাসরি দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য এই সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে একটু ঝামেলাও হয়। উইম্বলডন আর ওপেন গলফ চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে বিবিসির ব্যস্ততার কারণে গোটা টুর্নামেন্টটাই পিছিয়ে নিয়ে শুরু করা হয় ১১ই জুলাই থেকে (কেবল প্রথম বিশ্বকাপ, যেটি ১৩ই জুলাই শুরু হয়েছিল বাদে আর কোন আসর আজ পর্যন্ত এতো দেরি করে শুরু হয়নি) আর ফাইনালটা হয় ৩০ জুলাই।
তবে টিভিতে দেখালে কি! ইউরোপীয়রা সেবারে ভীষণ রক্ষণাত্নক কৌশলে খেলা শুরু করে। গোলকিপারের ঠিক সামনে, সুইপার পজিশনে একজন করে বাড়তি সুইপার খেলিয়ে গোল করার থেকে গোল বাঁচানোকেই একমাত্র কর্তব্য হিসেবে ঘোষণা দেয়। সেটা নাহয় খেলার কৌশল! কিন্তু সেই বৃটিশ বিশ্বকাপে খেলার কৌশলের বাইরেও রেফারিরা যেন একজোট হয়ে ইউরোপীয় দলগুলোকে জেতাতে উঠেপড়ে লাগে। মোট ২৪ জন ইউরোপীয় রেফারির কম বেশি সবাই পক্ষপাতের বাঁশি বাজালেও দুটি খেলায় সব সীমা যেন একেবারে ছাড়িয়ে যায়। দুটোই ছিল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। ইংলিশ রেফারি জিম ফ্যানি বীর বিক্রমে একতরফা রেফারিং করে জার্মানিকে জোর করে জেতান উরুগুয়ের সঙ্গে। জার্মান ডিফেন্ডার শ্নেলিঙ্গার গোললাইন থেকে হাত দিয়ে বল ফেরালেও পেনাল্টিতো দূরের কথা প্রতিবাদ করায় উরুগুয়ের দুইজনকে মাঠ থেকে বহিস্কার করেন। আর নিজের দেশের দলকে সেমিতে ওঠানোর দায় শোধ করতেই কিনা, জার্মান রেফারি ক্রেইটলেইন রুডলফ ইংলিশদের সাহায্য করেন আরেক ল্যাটিন দেশ আর্জেন্টিনাকে হারাতে। তিনি আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় আন্তোনিও রাটিনকে বহিষ্কারাদেশ দেন। রাটিন দাবি করেন- তিনি ফাউল করেননি। অবশ্য রেফারির পাল্টা যুক্তি ছিল, ‘ফাউল করেছো কি করোনি জানি না, তোমার চাহনি আমার ভালো ঠেকছে না বাপু, তুমি বেরিয়ে যাও’। এরপর জিওফ হার্স্টের গোলটা অফসাইড- আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের এই দাবিতেও কর্ণপাত করেননি তিনি। কোয়ার্টারের এই খেলাটাকে আর্জেন্টিনাতে বলা হয় ‘এল রবো দেল সিগ্লো’ বা ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ডাকাতি’।
এভাবে করে তো দুই ল্যাটিন দল বিদায় নিলো কোয়ার্টারে। প্রথম রাউন্ডেই অবশ্য আগের দুই বারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে রীতিমত মারতে মারতেই বের করে দেয়া হয়। পেলেকে বুলগেরিয়া আর পর্তুগালের খেলোয়াড়রা পেটায় রোজ পত্রিকার পাতায় ছাপা ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের মতো করেই আর ইউরোপীয় রেফারিদের আচরণও ছিল যথারীতি আমাদের পরিচিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মতোই। ফলাফল, আহত পেলে মাঠ ছাড়েন, ব্রাজিল প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেয়। বিদায় নেন ছোট্ট পাখি গ্যারিঞ্চাও। মনে রাখতে হবে যে, নব্বই মিনিটের খেলায় তখন পর্যন্ত একমাত্র চোটপ্রাপ্ত গোলকিপার বাদে অন্য কোন খেলোয়াড় বদলি করা যেতো না। ফলে মারধোর খেয়ে বেরিয়ে যাওয়া খেলোয়াড়দের অভাবে কম খেলোয়াড় নিয়ে খেলেই হার মেনে নিতে হতো দলগুলাকে। এইভাবে করে ইউরোপীয় রেফারিরা এক অসামান্য প্রতিভার ঝলকে বিশ্বকে মুগ্ধ করে অল-ইউরোপীয় সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে।
আগেই কোয়ার্টার ফাইনালের আলাপ করা হয়ে গেল! ব্রিটিশদের এই বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ড একটিও গোল না খেয়ে দুই খেলায় জেতে আর এক খেলায় ড্র করে এ গ্রুপ থেকে উরুগুয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে। বাদ পড়ে মেক্সিকো আর ফ্রান্স। বি গ্রুপে পশ্চিম জার্মানি প্রথম ম্যাচে সুইজারল্যান্ডকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দেয় যার মধ্যে দুটি গোল করেন তরুন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। তিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠবেন জার্মান ফুটবলের ‘কাইজার’ বা ‘সম্রাট’।
সেবার মাত্র ২০ বছর বয়সেই দারুন পারফর্ম করলেও জার্মানির সেযুগের সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন স্পেনের বিরুদ্ধে জয়সূচক গোল করা উয়ে সিলার। হামবুর্গে জন্ম নেয়া গাট্টাগোট্টা আর মগের পর মগ বিয়ার শেষ করা উয়ে সিলার ছিলেন যেন জার্মান জীবনদর্শনের প্রতিচ্ছবি। ওরকম স্বাস্থ্য হলে কি হবে! বল পেলে দৌড়াতেন চঞ্চল খরগোশের মতো, গোলমুখে আক্রমণ করতেন ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো, আর শত প্রলোভনেও কখনো ইউরোপের অন্য দেশের লিগ খেলতে যাননি। তাই চারটি বিশ্বকাপ খেলা উয়ে সিলার যখন বল পেতেন, দর্শকেরা চিৎকার করে বলতো উয়ে, উয়ে। তবে সেই চিৎকার আসলে ছিলো জার্মানি, জার্মানি বলে। সি গ্রুপে পেলে আর গারিঞ্চা মার খেয়েও দুটো গোল দিয়ে হারিয়ে ছাড়েন বুলগেরিয়াকে কিন্তু হেরে যায় হাঙ্গেরির কাছে। শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয় ব্রাজিল-পর্তুগাল। কালো চিতা ইউসেবীয়র জোড়া গোলে পর্তুগাল চলে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে, চ্যাম্পিয়নরা বাদ পরে প্রথম রাউন্ড থেকেই। ডি গ্রুপে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিলো অপ্রতিরোধ্য। জিয়ান্নি রিভেরা আর সান্দ্রো মাজোলার মতো খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দুর্দান্ত ইতালিকে তারা হারায় ১-০ গোলে। আর হারাবে নাইবা কেন! তাদের দলে ছিলেন একজন লেভ ইয়াশিন! দুনিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গোলকিপার। এখন পর্যন্ত ‘ব্যালন ডি অর’ জেতা একমাত্র গোলকিপার। গোলকিপিং ব্যাপারটাকেই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের এক কারখানা শ্রমিকের পুত্র ইয়াশিন ১৮ বছর বয়সে নার্ভাস ব্রেকডাউনের জন্য কাজ ছাড়তে বাধ্য হলেও খেলার মাঠে ছিলেন ইস্পাত কঠিন নার্ভের প্রতিশব্দ। কেবল বল ঠেকানো নয়, তিনি ছিলেন ডিফেন্সের সেনাপতি। নিখুঁত পজিশন সেন্স, ভোকাল আর সাহস দিয়ে তিনি ডিফেন্সের নেতৃত্ব দিতেন রুশ সীমান্তের যোদ্ধাদের মতো। একটা পিন যাওয়ার মতো ফাঁকা জায়গা তিনি রাখতেন না। কালো পোষাকে যখন তিনি দেহ প্রসারিত করে বল ধরতেন মনে হতো একটা বিশাল মাকড়সা জাল পেতে আছে। আবার গোলার মতো শট ঠেকিয়ে দিতেন অবলীলায়, বিকারহীনভাবে, আর জিমন্যাস্টের মতো ঠেকাতেন শয়ে শয়ে পেনাল্টি শট।
তবে ইতালীয়রা কেবল ইয়াশিনের সোভিয়েতের কাছেই নয়, ধাক্কাটা খায়, পুঁচকে উত্তর কোরীয়দের কাছে। মিডলসবারোতে ১৯ জুলাইয়ের গ্রুপ ম্যাচে ৪২ মিনিটে পাক ইক-দু নামের সেনাবাহিনীর হাবিলদারের দেওয়া গোলের কোন জবাবই তারা দিয়ে উঠতে পারেনি। ইতালিকে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে দেওয়া সেই গোল নিয়ে কত লেখা, কত কিংবদন্তীর জন্ম হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রচার পায় যেটি তা হচ্ছে পাক ছিলেন একজন দাঁতের ডাক্তার। কে জানে, ইতালীয়রা হয়তো অবচেতনে ভাবতো যে দাঁতের ডাক্তার ছাড়া আর কেইবা পারে এত অমায়িকভাবে চুপ করিয়ে দিতে! তবে উত্তর কোরিয়ার চমক সেখানেই শেষ হয়নি! ২৩ জুলাই গুডিসন পার্কের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে ২৫ মিনিটের মধ্যে পর্তুগালকে তিন গোল দিয়ে এগিয়েও যায় পাকের দল। কিন্তু বিধিবাম! অতিমানব হয়ে উঠলেন কালো চিতা ইউসেবীয়। ইসরায়েলি রেফারির বদান্যতায় দুটি পেনাল্টি গোলসহ মোট চারটি গোল করেন তিনি নিজে আর তার দল জেতে ৫-৩ গোলে।
ইউসোবীয় যেখানে জন্মেছিলেন সে এলাকার ছেলেরা বড় হয়ে জুতা পালিশ, বাদাম বিক্রি কিংবা পকেটমার হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। বাচ্চা বয়সে তাকে বলা হতো ‘নিনগুয়েম’, মানে ‘কেউ না’। তবে আরো অগণিত ‘কেউ না’দের সঙ্গে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফুটবল খেলতো ইউসেবীয়। ফুটবল খেলতে নামলে মনে হতো যেন পুলিশের ধাওয়া কিংবা দারিদ্র্যের ছোবল এড়াতে সে দৌড়াচ্ছে। আর এই দৌড়ের জন্যেই নাম হয় কালো চিতা। অসম্ভব সব কোণ থেকে গোল করতে পারলে কি হবে, কালো মানুষ বলে শাসকের বুটের নিচে থেকেই এক দুঃখী, অতৃপ্ত জীবন তাকে পার করতে হয়। তাই সেই টুর্নামেন্টে অবিশ্বাস্যভাবে নয়টা গোল দিয়ে তার ফাইনালও খেলা হয়না, সেমি ফাইনালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে এক গোল দিলেও ববি চার্লটন নামের ম্যাঞ্চেস্টারে জন্ম নেয়া আরেক মজুরের ছেলের জোড়া গোলে তার দল হারে।
সেমির অন্য খেলায় বেকেনবাওয়ার আর হেলমুট হেলার, শেষ পর্যন্ত ইয়াশিনকে পরাস্ত করার কৃতিত্ব দেখিয়ে জার্মানিকে ফাইনালে তোলেন। তবে, ফুটবলের দুই ইউরোপীয় মুরুব্বি কোয়ার্টার ফাইনালে রেফারিদের সহায়তা পেলেও ফাইনালে গিয়ে দর্শক দেখে আসল ‘ব্রিটিশগিরি’।
ওয়েম্বলির ফাইনালে হেলমুট হেলার ১২ মিনিটের মাথায় পশ্চিম জার্মানিকে এগিয়ে নিলেও ছয় মিনিট পর শোধ দেন জিওফ হার্ষ্ট। মার্টিন পিটারস ৭৮ মিনিটে স্বাগতিকদের ফের এগিয়ে নিলেও এক মিনিট বাকি থাকতে ফ্রি কিকে উলফগ্যাং উয়েবার সমতা আনেন। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ৯৮ মিনিটের মাথায় হার্ষ্টের শট ক্রসপিসে লেগে গোললাইনে পড়ে কিন্তু আজারবাইজানের (যদিও এই ঘটনার পর সারাজীবন ‘রুশ লাইন্সম্যন’ বলেই কুখ্যাত) লাইন্সম্যান তৌফিক বাখরামভ সেটিকে গোল ঘোষণা করেন আর সুইস রেফারি দিয়েন্সত গটফ্রিড সেই সিদ্ধান্তই বহাল রাখেন। জার্মানদের চিৎকার চেঁচামেচিতে তো কাজ হয়ইনি উলটো শেষ মুহূর্তে গোল দিয়ে হার্ষ্ট হ্যাটট্রিক পূরণ করেন।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফাইনালে করা একমাত্র হ্যাট্রিক! উচ্ছ্বসিত রাণির হাত থেকে ইংল্যান্ড দল জুলে রিমে ট্রফি নিয়ে উল্লাস করে। রেফারিং বিতর্ক নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তখন কই! আর সেটা ঠিক ব্রিটিশসুলভও নয়! ঘরে মাঠে যেনতেনভাবে কাপ জেতার আনন্দই তখন একমাত্র আলোচ্য বিষয়!
তবে ব্রিটিশদের এই কাপজেতার গল্পের মাঝে একটা প্রভুভক্তির আলাপ না করলেই নয়। বিশ্বকাপ শুরুর মাস চারেক আগে, মার্চের ২০ তারিখ ওয়েষ্টমিনিস্টারের এক প্রদর্শনী থেকে জুলে রিমে ট্রফিটা চুরি যায়।
আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও সেটিকে না পেয়ে কাজ চালাতে একটা রেপ্লিকাও বানানো হয়। তবে সাতদিন পর চারবছর বয়সী সংকর জাতের কুকুর পিকলস মালিকের সঙ্গে সন্ধ্যায় বেড়াতে বের হয়ে সংবাদপত্রে মোড়ানো ট্রফিটা খুঁজে পায়। ব্রিটিশদের ইজ্জত বাঁচায় এক সারমেয়। এসব ক্ষেত্রে যা হয়! পিকলসের যেহেতু টাকাপয়সার মতো ‘ফালতু’ বিষয় নিয়ে ভাবনা নেই, তাই তার ভাগ্যে জোটে ন্যাশনাল ক্যানাইন ডিফেন্স লিগের একটা রুপার মেডেল আর বেশ কিছু টেলিভিশন শোতে চেহারা দেখানোর সুযোগ। অন্যদিকে তার মালিক, ডেভিড করবেট পাঁচ হাজার পাউন্ড ইনাম পান। সেটা দিয়ে তিনি সারেতে একটা বাড়িও কেনেন! অতীব দুঃখের ব্যাপার পরের বছর সে বাড়িতে সমাধিস্থ করা হয় পিকলসকে। একে তো কুত্তা তায় বৃটিশ! স্বভাবচরিত্র কি আর শোধরানো যায়! শহীদুল জহিরের ইন্দুর বিলাই খেলার মতো এক বিড়ালকে তাড়া করতে গিয়ে গাছের শাখার সঙ্গে গলার বকলস পেঁচিয়ে ফাঁস লাগিয়ে মরে যায় সেই ব্রিটিশ সারমেয়টি।