ফুটবলের মেঘমল্লার আর দীপক রাগের আসরঃ বিশ্বকাপ ১৯৭০

অস্থির, প্রতিবাদী এক দশকের শেষে নতুন দশকের শুরুর বছরেই এল বিশ্বকাপ। নতুন দশকে নতুন চ্যালেঞ্জ। সে বছরের সবচেয়ে বড় ঝড়টা বয়ে গেলো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর। ঝড় মানে ঘূর্ণিঝড় গোর্কি। মানুষের ইতিহাসে এ যাবত যতো ঘূর্ণিঝড়ের হিসেব রাখা হয়েছে তার মধ্যে অতো প্রলয়ংকরী, অতো ক্ষতিকর দুর্যোগ আর আসেনি।

গোর্কির তান্ডবে লণ্ডভণ্ড ভোলা

ঐ ঝড়ে পূর্ব বাংলার দক্ষিণাঞ্চল লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, মারা যায় ৫ লাখের বেশি মানুষ। এবারের বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা ক্রোয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় সেই ঝড়ে। অথচ এই সর্বগ্রাসী ঝড়ের ঝাপ্টা ঠিকই সামলে এ জনপদের মানুষ আরও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো, প্রকৃতির রুদ্ররোষের শক্তিটা সঞ্চারিত হলো ওদের মানসে, আর তাতে স্রেফ উড়ে গেলো এতোদিন ধরে ওদের নিগ্রহে রাখা, অত্যাচার করা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। সে বছরের ডিসেম্বরের নির্বাচনে এ অঞ্চলের মানুষ যে একতার নিদর্শন দেখালো সেটা ছিলো সর্বহারা বঞ্চিতের লেখা অনবদ্য রাজনৈতিক কাব্য। একইরকম কাব্যের সন্ধান করতেন নিকারাগুয়ার কবি লিওনেল রুগামা। মাত্র ২০ বছর বয়সে কবির কণ্ঠ চিরে তাকে রুদ্ধ করে সে দেশের শাসক গোষ্ঠী। এ বছর মারা যান মানবতাবাদের আরেক চ্যাম্পিয়ন বার্ট্রান্ড রাসেল। অবশ্য বেঁচেছিলেন ৯৭ বছরের বেশি। বিরাট ঝড় নেমে আসে সংগীত জগতে। সর্বকালের অন্যতম সেরা গিটারিস্ট জিমি হেন্ড্রিক্স ঘটান নিজের জীবনাবসান আর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে ভেঙ্গে যায় ‘যিশু খ্রিষ্টের চেয়েও জনপ্রিয়’ বিটলস।

নিজের সময়ের সেরা এবং সম্ভবত সর্বকালের সেরা গিটারিস্ট জিমি হেনড্রিক্স আত্মহত্যা করেছিলেন সত্তর সালে

বাঙালি যখন প্রকৃতি আর অপশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বিশ্বের অন্যপ্রান্তে মানবসৃষ্ট বিপর্যয় রুখে দিচ্ছিল প্রতিবাদী জনতা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে সে বছর মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ১০ লাখ। দখলদার মার্কিন বাহিনীর নাপাম বোমায় পুরো দেশ ছিন্নভিন্ন হলেও ক্রমশ হো চি মিনের দেশের লোকেরা অসম্ভব এক প্রতিরোধের গল্প লিখে চলে। ওদিকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে সালভাদর আয়েন্দে নামের স্বপ্নালু একজন মানুষ প্রতিটি শিশুকে দুধ খাওয়ানোর প্রতিশ্রতি দিয়ে, সাম্যের সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষায় নির্বাচনে জিতে প্রেসিডেন্ট হন।

সালভাদর আয়েন্দে ও পাবলো নেরুদা, চিলির দুই সেরা সন্তান

এইসবের মধ্যে আমেরিকা মহাদেশের আরেক প্রান্ত মেক্সিকোতে শুরু হয় বিশ্বকাপ। সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ জয়ী নির্ধারণের বিশ্বকাপ। এক দুর্দান্ত, মোহনীয় আসর, বিশ্বকাপ ১৯৭০।

ইউরোপ আর ল্যাটিন আমেরিকার বাইরে হওয়া প্রথম বিশ্বকাপটি শুরু হয় মে মাসের ৩১ তারিখ আর শেষ হয় জুনের ২১ তারিখে। সেবার বাছাইপর্বেই দুবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের রেকর্ডে স্তম্ভিত হয় বিশ্ব, ছয় ম্যাচের ছয়টিতেই জেতা পেলে, গারসন, জর্জিনহো, রিভেলিনো আর টোস্টাওদের দলটাকে বলা হচ্ছিলো সর্বকালের সেরা দল। তখন নিয়ম ছিলো মোট তিনবার কাপ জিতলেই আজীবনের জন্য বিশ্বকাপ তথা জুলে রিমে ট্রফিটি দিয়ে দেওয়া হবে।

পরম আরাধ্য জুলে রিমে ট্রফি

দুনিয়ার সেরা দল ব্রাজিল ছাড়াও ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা দল উরুগুয়েও অবশ্য একই আশা নিয়ে শুরু করেছিলো বিশ্বকাপ মিশন। এই দুই দলের সঙ্গে তৃতীয় দল হিসেবে কোয়ালিফাই করে পেরু। বরাবরই নিজেদের ‘বড়’ দল দাবি করলেও অর্জনের দিক দিয়ে ‘ছোট্ট’ দল আর্জেন্টিনা কোয়ালিফাই তো দূরের কথা বাছাই পর্ব শেষ করে গ্রুপের সর্বশেষ অবস্থানে। তবে বিশ্ব পরিস্থিতি বোঝা যায় কোয়ালিফাইংয়ের কিছু ঘটনায়। ফিফা ফিদেল কাস্ট্রোর কিউবাকে খেলতেই দেয়নি, যেমনটা দেয়নি আফ্রিকার দেশ ঘানা আর জায়ারকে। আর এর আগের বিশ্বকাপে দুর্দান্ত চমক দেখানো উত্তর কোরিয়া দল জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বাছাইপর্ব বয়কট করে। এই সুযোগে প্রথমবারে মতো বিশ্বকাপে সুযোগ পায় ইসরায়েল।

তবে এসব কিছুকে ছাপিয়ে যায় দুনিয়ার প্রথম ‘ফুটবল যুদ্ধ’। স্বাগতিক হবার সুবাদে মেক্সিকো সরাসরি বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়ায় কনকাক্যাফ অঞ্চল থেকে আর একটা দলের সুযোগ থাকে। ঘটনাক্রমে ১২ দলের তিন ধাপের কঠিন লড়াই শেষে দুই প্রতিবেশী এল সালভাদর আর হন্ডুরাসের মধ্যের ম্যাচটি হয়ে ওঠে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। এদের মধ্যে যে জিতবে সে হাইতির সঙ্গে প্লে-অফ খেলবে এবং সে ম্যাচের জয়ীই পাবে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ। ঐ অঞ্চলের প্রায় ১০ শতাংশ জমির দখল নেওয়া, গরিব দেশগুলোকে চুষে খাওয়া মার্কিন বেনিয়া ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির ইন্ধনে দুই দেশের কৃষকদের মধ্যে অস্থিরতা ছিলো আগে থেকই। এল সালভাদর থেকে যেসব কৃষক হন্ডুরাসে এসে বসতি গড়ে তাদের জমির অধিকার বঞ্চিত করে ইউনাইটেডের মদতপুষ্ট সরকার। কিন্তু বাছাইপর্বের দুইটা ম্যাচে যার যার দেশে দুই দল জিতলে এই উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে। শেষতক নিরপেক্ষ ভেনু মেক্সিকো সিটিতে ১৯৬৯ সালের ২৬ জুন অতিরিক্ত সময়ে দেওয়া গোলে এল সালভাদর ২-১ গোলে জেতে। কিন্তু ততোদিনে এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যের কূটনৈতিক সম্পর্ক শেষ করে ফেলেছে। খেলায় হারার পর হন্ডুরাস থেকে সালভাদরিয়ানদের বিতাড়িত করা হতে থাকে, সীমান্তে চরম উত্তেজনা শুরু হয়, এক পর্যায়ে, ১৪ই জুলাই তারিখে সালভাদরের বাহিনী হন্ডুরাস আক্রমণ করে।

দুই দেশের মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ। দিন চারেক পর অর্গানাইজেশন অফ আমেরিকান স্টেটসের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ থামে। তবে, আজ অবধি নাকি ঐ ম্যাচের জের দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান। যাই হোক, এর মাস তিনেক পর নিরপেক্ষ ভেন্যু জ্যামাইকাতে অতিরিক্ত সময়ের দেওয়া গোলে হাইতিকে ১-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ করে নেয় এল সালভাদর। সেই তুলনায় ‘সভ্য’ ইউরোপে ‘ঝামেলা’ হয়নি। আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড সরাসরি সুযোগ পায় আর সঙ্গে আরো আটটি দেশ। এদের মধ্যে দিনো জফ, সান্দ্রো মাজোলা, রিভাকে নিয়ে গড়া দল ইতালি আর উয়ে সিলার, বেকেনবাওয়ার আর জার্ড মুলারের দল পশ্চিম জার্মানিও ছিল। আগে দুবার চ্যাম্পিয়ন হওয়াতে চিরতরে জুলে রিমে ট্রফি জিতে নিজেদের দেশকে ফুটবলের সর্বকালের সেরা দাবির স্বপ্ন নিয়েই বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে আজ্জুরিরা।

সত্তরের আজ্জুরিরা, জুলে রিমে ট্রফি নিজেদের করে নেওয়ার সুযোগ ছিল তাদেরও

বাছাইপর্ব শেষে মোট ১৬টি দল চারগ্রুপে ভাগ হয়ে খেলে। এইবারই প্রথম লাল আর হলুদ কার্ড ব্যবহার করেন রেফারিরা আর প্রথমবারের মতো দুইজন বদলি খেলোয়াড় নামানোর সুযোগ পান কোচেরা। সম্ভবত আগের আসরে মার খেয়ে কাবু হওয়া পেলে, গারিঞ্চার ব্রাজিলের পরিনতি যাতে আর কারো বরণ করতে না হয় সেটি মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত। মাঠেও দেখা যায়, আগেরবারে ‘নেতিবাচক’ আর ‘শারীরিক’ ফুটবলের বদলে সৌন্দর্যের পসরা। ‘যুদ্ধাহত’ সালভাদর এ গ্রুপের তিন খেলাতেই হারে। নিজেদের মধ্যে গোলশূন্য ড্র করা মেক্সিকো আর সোভিয়েত ইউনিয়ন বাকি দুই খেলায় জিতে যায় পরের রাউন্ডে। পয়েন্ট আর গোল ব্যবধান সমান হলেও টসে জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় কমিউনিষ্ট দেশটি।

গ্রুপ বি থেকে দুই জুলেরিমে প্রত্যাশী ইতালি আর উরুগুয়ে কোয়ালিফাই করে। অবশ্য ইতালি শেষ গ্রুপ ম্যাচে ইসরায়েলের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র দেখে অনেকেই ভ্রু কুচকায়। কেউ বলে, এইটা আসলে জায়নবাদীদের জন্য প্রীতি উপহার আবার কেউ অবশ্য মনে করেন, স্রেফ শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ঢিলেঢালা খেলার ফরম্যাট ফলো করে আজ্জুরিরা। সি গ্রুপের দল ব্রাজিলের অবশ্য এসব ঢিলে খেলার কোন চিন্তাই ছিলো না। ওদের দলের কেবল ছিলো গোলের নেশা, সুন্দর, আক্রমণাত্নক খেলার। গ্রুপের তিনটা খেলাতেই জিতে ব্রাজিল যায় পরের রাউন্ডে।

সত্তরের সেলেসাওরা

সেলেসাওরা অতিরক্ষণাত্মক ইংল্যান্ডের সঙ্গে মাত্র এক গোল দিলেও রুমানিয়াকে তিনটা আর চেকোশ্লোভাকিয়াকে দেয় চারটা করে গোল। ওদের খেলা দেখে অন্যের ব্যাপারে সদা কৃপণ ব্রিটিশ গণমাধ্যম পর্যন্ত বলে ওঠে, এই দলের খেলা এতো সুন্দর যে এই খেলা আইন করে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ইংল্যান্ডও অবশ্য বাকি দুই খেলায় জিতে কোয়ার্টারে উঠে যায়। অবশ্য ইংল্যান্ডের সঙ্গের ম্যাচের ব্রাজিলের গোলটা নিয়ে আলোচনা না করলেই না। সেদিন ইংল্যান্ডের এগারোজনই নিজেদের পেনাল্টি বক্স পাহারা দিচ্ছিলো, ভাষ্যকারদের একজন তো বলেই বসলেন যে, গোটা ইংল্যান্ড, মায় রাণি পর্যন্ত পেনাল্টি বক্স পাহারা দিচ্ছেন। এরই মধ্যে ব্রাজিলের পাওলো সিজার পাস দেন টোস্টাওকে। তিনি একে একে তিনজনকে কাটান এবং এরপর পেলেকে পাস দেন। পেলেকে আটকানোর জন্য থ্রি লায়ন মানে তিনজন বীর ডিফেন্ডার তিনদিক দিয়ে এগিয়ে আসে। পেলে শট নেওয়ার ভান করলে, সিংহরা তেড়েফুড়ে আসে, পেলে আস্তে করে থেমে গিয়ে বাঁ দিকে থাকা জর্জিনহোর দিকে বলটা ঠেলে দেন। বস্তিতে বেড়ে ওঠা জর্জিনহো ছোটবেলা থেকেই পুলিশের গুলি, আর গুণ্ডাদের মার এড়ানো শিখেছেন তার কাছে ঐসব ননীর পুতুল ব্রিটিশগুলো তো নস্যি! অবলীলায় একজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে তিনি গোলকিপার গর্ডন ব্যাংকসের পাশ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন।

পেলে-জর্জিনহো-টোস্টাওদের সামনে অসহায় গর্ডন ব্যাংকস

রাণির গোটা বাহিনী মিলেও সাধ্য হয়নি জর্জিনহোর, ব্রাজিলের সে অনিন্দ্যসুন্দর গোল ঠেকানোর। তবে গোলের সংখ্যা দিয়ে গ্রুপ পর্যায়ে এই অনবদ্য ব্রাজিলকেও ছাপিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি। সেই দলের ‘গোলা’ নামে পরিচিত  জার্ড মুলার।

গোল করাকে ডালভাত বানিয়ে ছাড়েন জার্ড মুলার

বুলগেরিয়া আর পেরুর সঙ্গে টানা দুই ম্যাচে হ্যাট্রিকসহ গ্রুপের তিন ম্যাচে মাত্র (!) সাত গোল করেন মুলার। জার্মানি হয় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন আর পেরু হয় রানার্স-আপ। পেরুর বিশ্বকাপ অবশ্য শেষ হয়ে যায় কোয়ার্টারেই। বিপক্ষ দলটা ব্রাজিল আর সেই ফুটবলের সামনে বুক চিতিয়ে লড়েও আন্দেজের মানুষদের কিছু করার থাকে না। রিভেলিনো ১১ মিনিটে গোল দেন, ব্রিটিশ বধকারী জর্জিনহো ৭৫ মিনিটে একটি গোল দেন, এর ফাঁকে দুইটি গোল দেন টোস্টাও। টুর্নামেন্টের মাত্র কিছুদিন আগে চোখের অপারেশন করা এই স্ট্রাইকারের গোলগুলো দর্শকদের চোখ ধাঁধিয়ে দিতো। ইতালিও সমান চার গোল দেয় মেক্সিকোকে। আগের ফাইনালের প্রতিশোধ নিতে পশ্চিম জার্মানি ৩-২ গোলে হারায় ইংল্যান্ডকে। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা ড্র হলে অতিরিক্ত সময়ে মুলারের সেই আসরের অষ্টম গোলে জার্মানরা সেমিফাইনালে চলে যায় আর গোলশূন্য ড্রয়ের পর ১১৭ মিনিটে পাওয়া গোলে উরুগুয়েও সোভিয়েতদের হারিয়ে শেষ চারে জায়গা করে নেয়। অর্থাৎ, এমন চারটা দল সেমিফাইনালে যাদের সবাই আগের আসরগুলো থেকে কাপ জিতেছে। ফলে এদের মধ্যে জার্মানি বাদে যে চ্যাম্পিয়ন হবে সেই আজীবনের জন্য জুলে রিমে ট্রফি পেয়ে যাবে। হয়ে যাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলিং নেশন।

প্রথম বিশ্বকাপের বিজয়ী উরুগুয়ে ব্রাজিলের সঙ্গে সেমিফাইনালে ১৯ মিনিটের মাথায় গোল দিয়ে নিজেদের স্বপ্নের সলতেতে আগুন দেয়। কিন্তু জয়ের নেশায় পাগল ব্রাজিল গুনে গুনে তিন গোল শোধ দেয়, উঠে যায় ফাইনালে। গোটা দেশের মানুষ জুলে রিমের স্বপ্ন দেখতে থাকে। দেশ হিসেবে ব্রাজিল কিন্তু গোড়া ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারীদের। তারপরেও দেশটির সব গ্রামে কিন্তু চার্চ নেই, অথচ প্রতিটি গ্রামে একটা করে ফুটবল ক্লাব আছে। কারণ সেদেশের মেহনতি মানুষের কাছে রবিবারের প্রার্থনার চেয়ে ফুটবল অনেক বেশি জরুরি। সেই ৫০ সালের ট্রমা কাটিয়ে ৫৮ আর ৬২তে জেতা দলটি ৬৬তে জুলে রিমে ঘরে নিয়ে আসবে এই স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল দেশটির প্রতিটি মানুষ। তবে ইংল্যান্ডে গিয়ে পেলেরা পেরে উঠে না। নেতিবাচক ফুটবল আর শারিরীক আগ্রাসনের সামনে ওরা হেরে যায়। তবে সত্তরের ব্রাজিল ছিলো ফুটবল ধর্মের অনুসারীদের চোখে একদল পাখাবিহীন দেবদূত, সবুজ মাঠটাকে ক্যানভাস বানিয়ে নিত্য অনবদ্য চিত্রকলার সৃষ্টিকারী। জর্জিনহো, টোস্টাও, পেলে আর রিভেলিনোর মতো স্ট্রাইকার তো ছিলেনই এমনকি গারসন আর অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তোও মাঝে মাঝেই উঠে গিয়ে ছয়জনের আক্রমণভাগে পরিনত করতেন দলটিকে। ফুটবলের এতোটা ভয়াল সুন্দর রূপ বিশ্ব খুব কমই দেখেছে।

কার্লোস আলবার্তোর হাতে বিশ্বসেরা ফুটবলিং নেশনের স্বীকৃতি

দ্বিতীয় সেমিফাইনালটাও ছিলো মহাকাব্যিক। অবশ্য প্রথমে মনে হচ্ছিলো খেলাটা ম্যাড়মেড়েই হবে। খেলার আট মিনিটেই এগিয়ে যাওয়া ইতালি বুঝি ‘কাতানাচ্চিও’ খেলে বিপক্ষকে আর গোল করতে দেবে না। অদম্য জার্মানরা মেশিনের মতো খেলে ঠিক ৯০ মিনিটের মাথায় গোল দিয়ে খেলাটাকে অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যায়। সেখানেই রচনা হয় মহাকাব্যের। পরের মাত্র ৩০ মিনিটে ৫টা গোল দেখে শিহরিত হয় এজটেকা স্টেডিয়ামের লক্ষাধিক দর্শক। মুলার দুই গোল দিয়ে নিজের গোলসংখ্যা ১০ এ নিলেও ইতালীয়রা ৩টা গোল দেয়। শেষ দিকে প্রায় হাত ভেঙ্গে যাওয়া বেকেনবাওয়ার প্লাস্টারে হাত ঝুলিয়ে খেলে গেলেও তার দল গোলের দেখা পায় না।

ভাঙ্গা হাত নিয়ে সেমিফাইনালের একটা বড় অংশ খেলেছিলেন কাইজার

দুই বার করে বিশ্বকাপ জেতা ব্রাজিল আর ইতালির মধ্যে স্বপ্নের ফাইনাল নিশ্চিত হয়। সেবারই প্রথম গোটা দুনিয়ার মানুষ স্যাটেলাইটের কল্যাণে রঙ্গীন টেলিভিশনে সরাসরি একযোগে খেলা দেখার সুযোগ পায়। আর উপলক্ষ্যটাও ছিলো দুর্দান্ত। মাত্র ১৮ মিনিটেই জাদুর ঝাঁপি খুলে দেন পেলে। লাফিয়ে উঠে গোল করে দলকে এগিয়ে নেন। সেই গোল সম্বন্ধে তাকে সেই খেলায় মার্ক করার দায়িত্বে থাকা ইতালীয় ডিফেন্ডার বার্গনিচ বলেন, ‘আমরা একসঙ্গেই লাফালাম অথচ যখন আমি মাটিতে নেমে আসলাম তখনও দেখলাম পেলে শূন্যে।’ ফুটবলের রাজা পেলে। যার নামে সহস্র গান রচিত হয়েছে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে যার পায়ের জাদুতে বিশ্বকাপ পায় ব্রাজিল। তিনি বিশে পৌঁছানোর আগেই ব্রাজিল সরকার তাকে ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং তাকে ইউরোপে রফতানির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর তিনি আরো একবার বিশ্বকাপ জেতেন, নিজের ক্লাব স্যানটোসকে দুইবার বিশ্ব ক্লাব কাপ জেতান।

নিজের ক্লাব স্যানটোসকে একাধিকবার বিশ্বসেরা করেছেন পেলে

বিশ্বের ৮০টি দেশে তিনি ১৩০০ এর বেশি ম্যাচ খেলে ম্যাচপ্রতি একটির বেশি গোল দেন। তার খেলা দেখে দর্শক নির্বাক হয়ে যেতো, বিপক্ষ হতো স্তম্ভিত। তিনি শূন্যে উঠে হেড দিলে মতো যেন স্বর্গের সিড়িতে আরোহন করছেন, বিপক্ষ দলের ডিফেন্সকে তিনি বল পায়ে চিড়ে দিতেন এমনভাবে যেভাবে মাখনকে চিরে দেয় উত্তপ্ত ছুরি। তিনি যাদের কাটাতেন তাদের মাথা বন বন করে ঘুরতো, পায়ে পা বেধে পেঁচিয়ে যেতো আর ফ্রি কিক থেকে গোল দিলে বিপক্ষ দোনোমনো করে শেষতক পিছন ফিরে গোলপোষ্টের দিকেই তাকিয়ে থাকতো, কারন ওতো সুন্দর গোল কেই বা চাইবে না দেখতে! মেঘমল্লারে যেভাবে বৃষ্টি হয়, দীপক রাগে যেভাবে আগুন জ্বলে তেমনিভাবে পেলের খেলা দেখার জন্য যুদ্ধ অবধি থেমে যেত। পেলের খেলা দেখার লোভেই সব বিবাদ ভুলে যুদ্ধবিরতিতে যায় বায়াফ্রা-নাইজেরিয়া। ভাবা যায়!

সর্বকালের সেরা ফুটবলার

আর বিশ্বকাপে নিজেকে তিনি প্রমাণ করেন সর্বকালের সেরা হিসেবে। ইতালির সঙ্গে ফাইনাল শেষ হবার চার মিনিট আগে তার দল ৩-১ এগিয়ে থাকলেও শেষ গোলটা ব্রাজিল আর পেলের খেলার সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে থাকে। গোলকিপারের থেকে বলটা নিয়ে ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা একে অপরকে পাস দেয়, কাটায়, পাস দেয়। এভাবে করে নয়জনের পা ঘুরে বল আসে পেলের পায়ে। আর তিনি আয়েশী ভঙ্গিতে ডান দিকে আলতো করে বলটা ঠেলে দেন। অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো ঝড়ের বেগে নিজেদের ডিফেন্স থেকে এসে বলটা জালে জড়িয়ে দেন। ঐটাই ছিলো বিশ্বকাপে পেলের শেষ অবদান। আলবার্তোর হাতে ট্রফি। ব্রাজিল চিরতরে জুলে রিমে ট্রফির অধিকার পায়।

ফাইনাল জিতে জুলে রিমে ট্রফি চিরতরে নিজের করে নেওয়া ব্রাজিল দল

বিশ্বের সেরা দলের তকমা ব্রাজিলের হয়ে যায় চিরতরের জন্য। অবশ্য এর চেয়ে অনেকগুণ লড়াই করে সে বছর ঝড়ের কবলে পড়া বাংলার মানুষ ঠিক বছরখানেকের মধ্যে আরো অনেক বড় এক অর্জন নিজেদের করে নেয়। তারা পায় স্বাধীনতা, বাংলাদেশ। ব্রাজিলের জুলে রিমের মতো বাংলাদেশের মানুষ পায় নতুন এক পতাকা।

স্বাধীন একটা দেশ, নিজের একটা পতাকা

কিন্তু ব্রাজিলের জুলে রিমে ট্রফিটা হাতছাড়া হয়ে যায়। না, অন্য কোন দেশ ছিনিয়ে নিতে পারেনি। ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের ভবন থেকে ১৯৮৩ সালে ট্রফিটি চুরি যায়। সেই কাপটার ভেতরে থাকা সোনার লোভে চোরেরা সেটি গলিয়ে বিক্রি করে দেয় বলে দাবি করে এক সূত্র। যদিও ব্যাপারটা আজ অবধি নিশ্চিত না, কিন্তু সেই ট্রফিটাও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকটা আমাদের স্বাধীনতার মতোই। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে ভূলন্ঠিত করে, দুই রতি সোনার লোভে সোনার দেশটাকে ছারখার করে দিচ্ছে চোরেরা। অথচ ওঁরা থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু ব্রাজিলের ঐ অনবদ্য সত্তরের গৌরব যেমন কেউ ভুলতে পারবে না তেমনি আমাদের একাত্তরের গৌরব কখনো মুছে ফেলা যাবে না। আমাদের একেকজন কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি যোদ্ধার অর্জন পেলে, টোস্টাও আর কার্লোস আলবার্তোদের চেয়েও যে অনেক মহৎ, অনবদ্য।