মানুষ এক যুদ্ধবাজ প্রাণি। মানুষের ইতিহাসই যুদ্ধের ইতিহাস। তবে এই যুদ্ধবাজ প্রাণির যে গল্প, তাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামের অধ্যায়টা অন্য যেকোন সময়ের সাথে তুলনামূলক ভয়ের। লাখে লাখে মানব সন্তানের মৃত্যুই নয়, মানুষে মানুষে ঘেন্না, অবিশ্বাস আর হিংস্রতা সে সময় পুরো বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিলো, যেমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি। আর সেই যুদ্ধের আগের সময়টা ছিলো উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর ঘোরতর অন্যায়ের। খুনি আর হিংসুটেরা নিজেদের শক্তির দাপটে চাপা দিতে চাইছিলো সমস্ত ভালোবাসা আর সহমর্মিতাকে।
ত্রিশের দশকের শেষ সময়। সালটা ১৯৩৮। সে বছর রঙ্গিন ছবি তোলার প্রযুক্তি পৃথিবীতে আসলেও রাজনীতি তখন ভয়াল রকম সাদা আর কালোর বিভাজনে প্রকট। জার্মানিতে হিটলার, স্পেনে ফ্রাঙ্কো, ইটালিতে মুসোলিনি, ভারতবর্ষে ইংরেজ আর ল্যাটিন আমেরিকাজুড়ে চলছে মার্কিন কর্পোরেটদের ভয়াল শাসন আর শোষন।
ঐ বছরে, সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করা ফরাসিদের দেশে আয়োজিত হয় বিশ্বকাপের তৃতীয় আসর। মুসোলিনির ইতালি জেতে আবারও। ইতালিয়ান কোচ ভিত্তোরিও পোজো হন টানা দুই বিশ্বকাপ জেতা কোচ, যে কীর্তি আজ অবধি কেউ ছুঁতে পারেনি। তবে এই ‘উলটো’ সময়ে সাফল্যর গল্পের চেয়ে স্রোতের প্রতিকূলে চলা আর অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার গল্পগুলাই আসল বিজয়ের গল্প। এই বিশ্বকাপ সে কারণে আসলে সব ছাপিয়ে ওঠা দুইজনের গল্প। একজন ব্রাজিলিয়ান কালো মানুষ, দাসের সন্তান লিওনিদাস আর আরেকজন অস্ট্রিয়ার এক কামারের পুত্র, সেদেশের ইতিহাসে কেবল সেরা ফুটবলারই না, শতাব্দীর সেরা ক্রীড়া ব্যাক্তিত্ব, ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার।
বিস্ময়ের ব্যাপার আজ ঠিক আট দশক পরে যেই বিশ্বকাপটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তাতে খেলেনইনি সিন্ডেলার। হিটলার দখল করে নেওয়ার ফলে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা সত্ত্বেও বাদ পড়ে অস্ট্রিয়া। আর সে দলের সেরা খেলোয়াড়দের বাধ্য করা হয় ‘সংযুক্ত’ জার্মান দলে খেলতে। বাধ সাধেন লিকলিকে শরীরের জন্য ‘কাগজের মানুষ’ বলে পরিচিত সিন্ডেলার। তিনি সাফ জানিয়ে দেন যে, নাজিদের দলে তিনি খেলবেন না। ব্যাপারটা অবশ্য বোঝা গিয়েছিলো ৪ জুন শুরু হওয়া বিশ্বকাপের দুই মাস আগেই। সিন্ডেলারের নিজের শহর ভিয়েনার প্রাটের স্টেডিয়ামে নাজি দখলকৃত অস্ট্রিয়া শেষবারের মতো স্বাধীন দল হিসেবে খেলে দখলদার জার্মানির সঙ্গেই। খেলাটির বিজ্ঞাপন করা হয়েছিল ‘কামিং হোম টু দ্যা রাইখ’ হিসেবে। নাজিরা স্বপ্ন দেখেছিলেন এই ম্যাচে ‘আর্য’ জার্মানির গৌরব আর পরাক্রম দেখিয়ে কাঁপিয়ে দেবেন ফ্যুরারের জন্মভূমির লোকদের। কিন্তু সিন্ডেলারের নেতৃত্বে সাবেক হয়ে যাওয়া অস্ট্রিয়ার পতাকা লাল-সাদা রঙের পোষাক পড়ে খেলে অস্ট্রীয় দলটি। জার্মান একাদশকে নাস্তানাবুদ করে টানা নব্বই মিনিট একের পর এক আক্রমণ করেও গোলের কাছে বল নিয়ে ফাঁকা পোষ্টে না মেরে ঘুরে চলে আসে, ইচ্ছে করে বল বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে হানাদারদের হাস্যকর করে তোলে অস্ট্রিয়ানরা। পরাধীনতার বিরুদ্ধে সেদিন এক নীরব অস্ট্রীয় প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠে ফুটবল। একই সঙ্গে ক্যাপ্টেন সিন্ডেলারও সরব হন খেলার একদম শেষ দিকে দুই গোল দিয়ে জিতে নাজি অফিসারদের সামনে জয়োল্লাস করে। নীল রক্তের গর্বে গর্বিত জার্মানদের সব মিলিয়ে হাজার হাজার দর্শকের সামনে হাস্যস্পদ করে তোলেন সিন্ডেলার অ্যান্ড গং।
স্বাভাবিকভাবেই এহেন আচরণ নাজিদের পছন্দ হয়নি। পরের বছর, ১৯৩৯ সালে, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে রহস্যময় ভাবে নিজের ফ্ল্যাটে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস দুর্ঘটনায় মারা যান সিন্ডেলার। যার ড্রিবলিং আর ক্রিয়েটিভিটি কেবল দর্শকদের দারুন আনন্দই দিতো না, অন্যন্য ফুটবলাররা তার খেলা দেখতে আসতেন, ‘আদর্শ’ ফুটবলটা কিভাবে খেলতে হয় তা বোঝার জন্য, তিনি বড্ড অকালে দুনিয়া ছাড়তে বাধ্য হলেন।
সিন্ডেলারের দক্ষতা আর মনের জোর নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে অনেকে মনে করতেন, সেসময়ের দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড় ছিলেন লিয়োনিডাস। প্রচন্ড গতি, ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ছিলো তুখোড় ফুটবল মেধা। বিশ্বকাপ চলাকালীন তো এক ফরাসী সাংবাদিকতো বলেই ফেললেন যে, এই ব্রাজিলিয়ান কালা আদমীর আসলে ছয়টা পা আর সেগুলো দিয়ে সে কালো জাদু করে। বেচারাকে দোষ দিয়ে লাভ কি! লিওনিডাসের গতি আর ক্ষিপ্রতা দেখে সেরকম বিভ্রম হতো নাকি খোদ মাঠে থাকা খেলোয়াড়দেরই!
সম্প্রতি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আর গ্যারেথ বেলের যে দুইটি ‘বাইসাইকেল’ কিকের গোলে বিশ্ব মাতোয়ারা সেইরকম গোল ছিলো লিওনিডাসের কাছে ‘দুধভাত’। আর সেগুলো নাকি এতোটাই সুন্দর ছিলো যে, বেশিরভাগ সময় সেগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে গোলকিপাররা তালি দিতে দিতে জালে জড়িয়ে যাওয়া বল কুড়িয়ে আনতেও ভুলে যেতো।
অবশ্য বিশ্বকাপটা লিওনিডাসের হয়নি। তবে তার দল অন্তত অংশ নিয়েছিলো। আগেরবারের আসরের মতো এই আসরটাও ছিলো ইউরোপের, আর টানা দুইবার একই মহাদেশে হওয়ায় রাগে অংশ নেয়নি প্রথমবারের দুই ফাইনালিস্ট উরুগুয়ে আর আর্জেন্টিনা। ল্যাটিন থেকে আর একটি মাত্রই দেশই অংশ নিয়েছিলো, কিউবা। এযাবৎ তাদের একমাত্র বিশ্বকাপ সেটাই। আরেকটা মাত্র অ-ইউরোপীয় দেশ ছিলো, সেটি এশিয়া থেকে খেলা প্রথম দেশ, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ, যার বর্তমান নাম ইন্দোনেশিয়া। এই দেশটিও আর কখনো বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি। অস্ট্রিয়া বাদ পড়ায় দলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫টি আর আগেরবারের মতোই আটটি নকআউট ম্যাচ হওয়ার কথা থাকলেও অস্ট্রিয়ার অনুপস্থিতিতে ওয়াকওভার পায় সুইজারল্যান্ড। দৈবের বশে এই সুইজারল্যান্ডই হিটলারের ‘আর্য’ জার্মান দলকে হারিয়ে দেয়। প্রথমার্ধে ২-০ তে পিছিয়ে থাকলেও ২-৪ গোলে হেরে যায় সিন্ডেলার বাদে অস্ট্রিয়ার সেরা পাঁচজন খেলোয়াড় নিয়ে গড়া জার্সিতে স্বস্তিকা চিহ্ণ নিয়ে খেলা নাজিদের দলটি। জার্মান কোচ সেপ হারবার্গার দলের হারের জন্য অস্ট্রিয়ানদের গা ছাঁড়া ভাবকেই দায়ী করেন। নাজিদের উচিত শিক্ষা দেয়া ছাড়াও এই খেলা আরও একবার শিক্ষা দেয় যে ফুটবলটা দলীয় খেলা। আর কেউ না হোক, জার্মানি অবশ্য এই শিক্ষাটা পুরোপুরি গ্রহণ করেছিলো। কারণ পরে যতগুলো বিশ্বকাপ তারা খেলেছে কোনটিতে কোয়ার্টার ফাইনালের আগে জার্মানি বাদ পড়েনি। তবে হিটলারের দল ফল খারাপ করলেও মুসোলিনির দল ঠিকই কার্য হাসিল করে। আজ্জুরিদের সবচেয়ে বড় বাঁধা ছিলো লিওনিদাস আর চীনের প্রাচীর বলে পরিচিত ডোমিংগোস দা গিয়ার দল ব্রাজিল।
তবে মাথায় রাখতে হবে সেই টুর্নামেন্টের সব কজন রেফারি ছিলো ইউরোপীয়। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের সঙ্গে খেলায় ইতালির স্ট্রাইকার সিলভিও পিওলা পেনাল্টি বক্সে ঢুকে দুম করে পড়ে ফেলেন, এমনভাবে চিৎকার করতে লাগলেন আর দা গিয়ার দিকে আঙ্গুল তুলে এমনভাবে কাদঁতে লাগলেন যেন এ জীবনে আর উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। সে মরাকান্নায় রেফারি অবশ্য ফাঁসির আদেশ না দিয়ে, দিলেন সামান্য একটা পেনাল্টি। রেফারির সিদ্ধান্ত শুনেই পিওলা তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন আর তার সহ-খেলোয়াড় গুইসেপে মিয়াজ্জা বল নিয়ে রাখলেন পেনাল্টি স্পটে। ছোটখাটো, ফর্সা মিয়াজ্জা যখন পেনাল্টি নেওয়ার জন্য দৌড় শুরু করলো তখন দুম করে গেলো তার প্যান্ট খুলে। পুরো মাঠ হতচকিত, ব্রাজিলের গোলকিপার ওয়াল্টার খিলখিল করে হাসছে। তার মধ্যেই নেংটুপুটু মিয়াজ্জা এক হাতে প্যান্ট ধরে জোরালো শটে গোল দিয়ে দিলো। নেংটা, বাটপার যাই বলা হোক না কেন, মুসোলিনির ইটালি ফাইনালে! ইতালির সংবাদমাধ্যমের সে কি উচ্ছাস! গাজেত্তো দেল্লো স্পোর্টস তো বলেই বসলো, ফাইনালে ওঠার মধ্যে দিয়েই প্রমাণ হলো, ফ্যাসিস্ট নীতিই সঠিক, আর্যদের তুলনায় কালা আদমিরা তুচ্ছ। যদিও কিছুদিন আগে এই ব্রাজিলের কাছেই হারার পর, ইতালির সেই একই সংবাদমাধ্যম লিখেছিলো, বর্বর নিগ্রোগুলা পাশবিক জোরে জিতলো ঠিকই কিন্তু হেরেও ইতালিয়ানরা প্রমাণ করলো তারা এই জানোয়ারগুলোর চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধির অধিকারী।
ফাইনাল খেলা হয় জুনের ১৯ তারিখে, প্যারিসে। পিওলার দুই গোলে ৪-২ এ হাঙ্গেরিকে হারলো আজ্জুরিরা। না জিতে উপায়ও ছিলো না! খেলার আগে মুসোলিনি ইতালির খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্য একটা ছোট টেলিগ্রাম পাঠায়, যাতে মাত্র তিনটা শব্দ লেখা ছিলো, ‘জয় নাহয় মৃত্যু’। পরের দিন বিশ্বকাপের সমাপনীতে সামরিক উর্দি পরে কাপ গ্রহণ করে বিজয়ী দল। তখন কে জানতো এই কলঙ্কিত বিশ্বকাপের পর আর এক যুগ কোন বিশ্বকাপ হবে না!
তবে, সেই অন্ধকার সময়েও লিওনিডাসের যাদু দর্শকদের বিমোহিত করেছিলো, মাত্র চার খেলায় সাত গোল দিয়ে তিনি হয়েছিলেন আটত্রিশের টুর্নামেন্টের সেরা গোলদাতা। বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে খুব বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ না খেললেও দীর্ঘায়ু হয়েছিলেন, ৯০ বছর বয়সে ২০০৪ সালে মারা যাওয়ার আগে শরীরের অনবদ্য কারিকুরির জন্য ‘রাবার ম্যান’ নামে পরিচিত যুগশ্রেষ্ঠ এই খেলোয়াড় ধারাভাষ্যকার হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছিলেন।
মারা যাওয়ার পর সিন্ডেলারের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কিনা আমরা মর্ত্যের লোকেরা জানিনা। তবে দেখা হলে এই দুই মহারথী নির্ঘাত ১৯৩৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সঙ্গে পোল্যান্ডের খেলাটি নিয়ে আলাপ করতেন। স্ট্রাসবুর্গের সেই খেলাটির সময় অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিলো, পুরো মাঠ জুড়ে ছিলো কাদা।
এরই মধ্যে বল পায়ে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে থকথকে কাদায় পায়ের জুতা খুলে যায় লিওনিডাসের। তবুও তিনি অবিচল, খালি পায়েই শট নিয়ে গোলপোষ্টের জালে জড়িয়ে দেন বলটি। আকাশের মেঘ, মাঠভর্তি কাদা, আর খালি পায়ের লিওনিডাস যেন যুদ্ধে আক্রান্ত মানবতার মতো অসহায়। তবুও সেখান থেকেই গোল দেওয়াটা এই বার্তা দেয় যে, মানবতা জিতবেই, সব বাঁধা ডিঙ্গিয়ে।