হিরোশিমা আর নাগাসাকির মার্কিন পারমাণবিক বিস্ফোরণ সয়েও বেঁচে যাওয়া মানুষদের জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘হিবাকুশা’। অবশ্য হিটলারের গ্যাস চেম্বার থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরা হলোকস্ট সারভাইভারদের আলাদা কোন নাম ছিলো না। তবে নাম না থাকলেও তাদের জীবনও ছিলো হিবাকুশাদের মতোই। আমেরিকার ‘শান্তির বোমা’ নাকি হিটলারের ‘নাজি মেশিন’ কোনটা বেশি ভয়াবহ সেটার নির্নয় না করা গেলেও ২য় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতার শিকারদের এক ভয়াল অভিজ্ঞতার স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবনটা পার করতে হয়, হয়েছে এবং হচ্ছে। একটু ভুল বলা হলো, আসলে গত শতাব্দীর ভয়াবহতম সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরো মানবজাতিই যেন হিবাকুশাদের মতো নতুন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বাঁচতে শুরু করে। একদিকে বেঁচে থাকার স্বস্তি, অন্যদিকে ভয়াল অভিজ্ঞতা আর ভবিষ্যত নিয়ে শংকা।
রাশিয়ার পরে চীনেও শুরু হয় মাও জেডঙের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট শাসন। পোকায় কাঁটা মানচিত্রে ভারতবর্ষে আসে স্বাধীনতা। শুরু হয় রুশ-মার্কিন ঠাণ্ডা যুদ্ধের। এশিয়ার মতো আফ্রিকান কলোনিগুলোও স্বাধীন হবার তাড়নায় লড়াইয়ে যেতে শুরু করে। এসবই বিশ্বযুদ্ধের পরের প্রভাব।
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার কয়েক বছর পরের গল্প এটি। সে বছর বদলে যাওয়া বিশ্বকে চমকে দিয়ে হাজির হলো রঙ্গীন টেলিভিশন (যদিও আধুনিক কবিতার তথাকথিত ‘ঈশ্বর’ টিএস এলিয়ট টেলিভিশনকে চিহ্নিত করেন মানবজাতিকে চিন্তাশূন্য করার মাধ্যম হিসেবে। নিজের ওভার হাইপড দীর্ঘ কবিতা ওয়েস্টল্যান্ড বাদেও উনি অন্তত এই একটা বিষয়ে একদম প্রফেটিক ট্রুথ ঝেড়েছিলেন)। একজন অসম্ভব প্রতিভাবান সমপ্রেমী বৃটিশ বিজ্ঞানী এলান টুরিং আধুনিক রূপ দিলেন কম্পিউটার নামের যন্ত্রটিকে, ওদিকে ক্যালিফোর্নিয়ার সোনালী সৈকতে আবির্ভাব ঘটলো মেরিলিন মনরো নামের এক লাস্যময়ীর আর তার পূর্বসূরী, অনিন্দ্যসুন্দরী মাতা মেরি, থুক্কু, ইনগ্রিড বার্গম্যানের বিবাহ বহির্ভূত সন্তান জন্মদান নিয়ে বছরখানেক ছিছিক্কারে মেতে থাকলো গসিপ ম্যাগাজিনগুলো।
সে বছরে বার্ট্রান্ড রাসেল নোবেল পেলেন, পাবলো নেরুদা প্রকাশ করলেন ক্যান্টো জেনারেল, অক্টাভিও পাজের দ্যা ল্যাবিরিন্থ অফ সলিচ্যুড দেখলো আলোর মুখ। আর পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে বিশ্বকে সাবধান করে দিলেন স্বয়ং আইন্সটাইন।
যদিও সেসবে অশান্তি কমলো না একরত্তিও। দুনিয়া গিজগিজ করতে লাগলো সোভিয়েত আর মার্কিন গুপ্তচরে। আজ পুঁজিবাদ এই মুল্লুকে ধরা খাচ্ছে তো পরের দিন বিপরীত মুল্লুকে লাল পতাকা। আর মার্কিন দেশে শুরু হলো ম্যাককার্থিজম। কাউকে পছন্দ না হলেই ট্যাগ লাগিয়ে দাও- ঐ যে শালা কমিউনিস্ট! ব্যস! হয়ে গেলো! ‘আসল’ কমিউনিস্ট মাও অবশ্য চীনের ক্ষমতা দখল করে দু-চারটা মন্দ কাজের পাশাপাশি বহুগামিতাও নিষিদ্ধ করলেন। এর চেয়েও জরুরি যেটা, বাচ্চাকাচ্চা বিক্রি (চীনে তখন এ ব্যবসা ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে, আরো জানতে দেখতে পারেন মার্কিন মিশনারির সন্তান নোবেল জয়ী লেখক পার্ল এস. বাকের দ্য গুড আর্থ) বন্ধ করে দিলেন।
বৃটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য তখন অস্তগামী। কিন্তু বৃটিশের শয়তানি ভূত যে চড়ে বসেছে মার্কিনিদের ঘাড়ে। এই বছর পুয়ের্তোরিকোর স্বাধীনতা সংগ্রামী পেদ্রো আলবিজুকে ৭৯ বছরের কারাদণ্ড দিলো যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য আরও বড় অশান্তির সূচনা হলো কোরিয়া উপদ্বীপে। উত্তর আর দক্ষিণ দুই কোরিয়ার মধ্যে শুরু হয় ধুন্ধুমার এক যুদ্ধ আর জাতিসংঘের পতাকা গায়ে জড়িয়ে সেই যুদ্ধে আরো উসকানি দেয় মার্কিন বাহিনী। আজ অবধি সেই যুদ্ধের শেষ হয়নি, কোরিয়া উপদ্বীপের রণাঙ্গণ আজও অশান্ত।
সব মিলিয়ে সেসময়টা ছিলো হিবাকুশাদের জন্য একই সঙ্গে আশা, আশংকা, স্বপ্ন আর ভয়ের। শতাব্দীর একেবারে মাঝের বছরটি হাজির হয় নতুন দুনিয়া শুরুর সব উপাদান নিয়ে। তবে সব ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় ব্রাজিলে মঞ্চস্থ এক আসর। বিশ্বকাপের আসর। এক যুগের অপেক্ষার অবসান ঘটানো এক বিশ্বকাপ। ব্রাজিলের হিবাকুশাদের স্বপ্ন আর বেদনায় নীল হবার বিশ্বকাপ। ভারতের খালি পায়ে খেলতে না চাওয়ার গুজব ছড়ানো এক বিশ্বকাপ। একজন হতভাগা বারবোসার বিশ্বকাপ। বুকফাঁটা কষ্টে ভেঙ্গে পড়া মারাকানার বিশ্বকাপ। ওয়েলকাম টু দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড, ওয়েলকাম টু ওয়ার্ল্ড কাপ ১৯৫০।
যুদ্ধ না বাঁধলে জার্মানি নাকি ব্রাজিল কে স্বাগতিক হতো তা বলা মুশকিল। ১৯৪২ সালের কাপ আয়োজনের জন্য দু’দলই বিড করেছিলো। এর আগের দুইবার আসর ইউরোপে হওয়ায় ব্রাজিলের ভাগ্যেই হয়তো শিকে ছিঁড়তো, তবে যুদ্ধের সময়ে হিটলারের জার্মানি যেসব অমানুষী কাণ্ডকীর্তি করেছে তাতে স্বাগতিক হওয়া দুরের কথা, তাদের খেলারই সুযোগ দেওয়া হয়নি ১৯৫০ সালে। অবশ্য খেলা দূরস্থান, তখন জার্মানির পূর্ব আর পশ্চিম অংশ নিয়ে মার্কিন আর রুশিরা বানরের পিঠাভাগ করছে রোজ। আদপে যুদ্ধের পরে তখন দুনিয়ার এই দশা যে, কেউ বিশ্বকাপের আয়োজনই করতে চাইছিলো না। সবাই ব্যস্ত দেশ পুনর্গঠনে। শেষমেশ ব্রাজিল রাজি হলো। বুকে বড় আশা, প্রথমবারের মতো কাপ জিতবে তারা। স্বাগতিক হওয়ার সুবাদে সরাসরি চূড়ান্ত পর্ব খেললো ব্রাজিল আর হিটলারের সহচর হলেও আগের টুর্নামেন্ট জেতায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইতালি। অবশ্য বেচারাদের কপাল খারাপ, টুর্নামেন্ট শুরুর বছরখানেক আগে এক দুঃখজনক বিমান দুর্ঘটনায় ওদের বেশ কজন খেলোয়াড় মারা যাওয়ায় সুদূর ব্রাজিলেও তারা গেলো বিমানের বদলে নৌকায় থুক্কু জাহাজে চেপে।
কিন্তু সেবার কোয়ালিফাইং রাউন্ডের পরে মূল প্রতিযোগিতায় কে খেলবে কে খেলবে না তা নিয়ে রীতিমত তালগোল লেগে গেলো। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, নানা মতবাদের তখন জয়জয়কার। আস্ত দেশেরই জন্ম হয়েছে এক গণ্ডা! নতুন নতুন দেশ আর তাদের সাথে পোস্ট-ওয়ার এবং পোস্ট-কলোনিয়াল ইফেক্টে বিশ্বকাপে পুরোদস্তুর এক জগাখিচুড়ি লেগে গেলো যার প্রভাব প্রথমেই পড়লো বিশ্বকাপের দল বাছাইয়ে। কোয়ালিফাইং রাউন্ড থেকেই ঝামেলার শুরু। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর কমিউনিস্ট ব্লকের হাঙ্গেরি ও চেকোশ্লোভাকিয়া তখন নিজেদের কড়া পর্দার ভেতরে রাখছে। যুদ্ধের পর তারা পুঁজিবাদি পশ্চিম ইউরোপ বা অন্য কারো সঙ্গেই সংসর্গ রাখছে না। তাই ওরা খেললো না, অথচ আগের দুই আসরের রানার্স আপ ছিলো হাঙ্গেরি আর চেকরা। হিটলারের জন্মভূমি অষ্ট্রিয়া অনভিজ্ঞতার অভাবে খেলেইনি আর হিটলারের চেয়েও বড় খুনি, রাজা লিওপোল্ডের বেলজিয়ামও খেলেনি কোয়ালিফাইয়িং রাউন্ড। এতে করে যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকা তুরস্ক আর সুইজারল্যান্ড সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়ে গেল।
একই সুযোগ পেলো দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি, বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে আর উরুগুয়ে। কারণ ব্রাজিল ফেডারেশনের সঙ্গে গোস্বা করে আর্জেন্টিনা খেলেনি সাথে খেলেনি ইকুয়েডর আর পেরুও। ওদিকে এশিয়াতেও ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া আর বার্মা না খেলায় সরাসরি সুযোগ পায় ইন্ডিয়া।
এই প্রথমবারের মতো অবশ্য বৃটিশ সাহেবদের মনে হইলো যে, বিশ্বকাপ তাদের ঘরোয়া লিগের মতো কুলীন না হলেও, যথেষ্ট জাতের একটা টুর্নামেন্ট যাতে তারা অন্তত অংশ নিতে পারে। তবে, বৃটিশদের ব্যাপার বলে কথা! বাছাইপর্বের একটা স্পেশাল সেগমেন্ট থাকলো শুধু বৃটিশ দেশগুলোর জন্য। দুটো দেশ সেখান থেকে মূল পর্বে খেলবে। কোয়ালিফাই করলো ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড। যদিও স্কটিশরাও দেখিয়ে দিল যে কেন তারা আজও স্বাধীন না! স্কটিশ ফুটবল এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জর্জ গ্রাহাম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যদি ব্রিটিশ কোয়ালিফাইং রাউন্ডে স্কটল্যান্ড ফার্স্ট না হয় তবে তিনি দলকে বিশ্বকাপেই পাঠাবেন না। ফলে কোয়ালিফাই করেও স্কটল্যান্ড বিশ্বকাপে খেললো না। একই কাহিনি ঘটালো তুর্কিরাও। শেষ মুহূর্তে তুরস্ক প্রত্যাহার করায় ওদের বদলে বাছাইপর্বে বাদ পড়া পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড আর ফ্রান্সকে নিমন্ত্রণ জানালো ফিফা। এদের মধ্যে ফ্রান্স রাজি হলেও একেবারে শেষ মুহূর্তে খরচের অজুহাতে ব্রাজিল গেলো না, আর ১৬ দলের বিশ্বকাপকে ১৩ দলে নামিয়ে আনলো ইন্ডিয়া। আজ অবধি বিশ্বকাপ ইতিহাসে ইন্ডিয়ার ব্যাপক অংশগ্রহণ(!) ঐটুকুই। তবে ইন্ডিয়ার এই অংশ না নেওয়া আর সেটির সম্ভাব্য কারণগুলো যুদ্ধপরবর্তী নতুন দুনিয়াটাকে বোঝার জন্য জরুরি। সবচেয়ে জনপ্রিয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদী মিথ হচ্ছে, ‘ভারতকে খালি পায়ে খেলতে দেওয়া হয়নি, প্রতিবাদে তারা অংশ নেয়নি।’ ব্যাপারটা পুরাই ভুয়া। নব্য জাতীয়তাবাদীদের ফালতু হামবড়ামির উছিলা মাত্র ( ক্রীড়া লেখক ও ইতিহাসবিদ কৌশিক বন্দোপাধ্যায়ের এই বিষয়ে বিশদ কাজ রয়েছে, আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন)।
এর আগেই ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে ভারত, ফ্রান্সের সঙ্গে খালি পায়ে খেলেই ৮৯ মিনিটের গোলে ২-১ ব্যবধানে হেরে যায়। এরপর ফিফা ভারতকে খালি পায়ে না খেলার ব্যাপারে সতর্ক করেছিলো। তবে এই বিষয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা আসেনি। অনেকে অবশ্য এখন নতুন এক আলাপ তুলে বলেন, অতো দূরের দেশ ব্রাজিলে যাওয়ার খরচ আর হ্যাপা অনেক, সে কারণেই ভারতবীরেরা বিশ্বকাপে যায়নি। অবশ্য সেই অজুহাতও ধোপে টিকবার নয়, কারণ ফিফা আর ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন আমন্ত্রিত দলের খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
ইন্ডিয়ার তৎকালীন অধিনায়ক শৈলেন মান্নার জবানিতে জানা যায় আসল ঘটনা। ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন তখন নাকি বিশ্বকাপকে গুরুত্বই দেয়নি। তাদের মূল টার্গেট ছিলো অলিম্পিকে খেলা। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নতুন দুনিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপ যে মর্যাদার এক নতুন আসর হতে চলেছে সেটা ইন্ডিয়া মানে সেদেশের ফুটবল কর্তারা বুঝে উঠতে পারেননি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে ৫২ অলিম্পিকে ইন্ডিয়া খেলেছিল খালি পায়েই। আর ১৫ই জুলাই হেলসিংকির শীতে ১০-১ গোলে হেরে খালি পায়ে তাদের হারের ষোলকলা পূর্ণ হয়। ইন্ডিয়ার পক্ষে একমাত্র গোলটা সেদিনে দেন আহমেদ মোহাম্মদ খান নামের ভারতীয় এক মুসলিম। অবশ্য সে দলের কোচও ছিলেন আরেক কিংবদন্তি আব্দুর রহিম। শুধু কি তাই? আজিজুদ্দিন, লতিফ, নুর মোহাম্মদ, সালেহ, সাত্তার, সৈয়দ খাজা মইনউদ্দিনরা তখন এই দলের সদস্য। সে যাকগে, খেলার মধ্যে ধর্ম টানলে ঝামেলা হতে পারে, ব্যাপারটার উল্লেখ কেবল এটুকু জানানোর জন্যে যে, বৃটিশরা ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দুইভাগ করলেও তখনকার দিনে কোন কোন মাঠে এখনকার চেয়েও সম্প্রীতি বেশি ছিলো। মোদ্দা কথা, ভারত আসলে বিশ্বকাপকে পাত্তা দেয়নি, তাই যায়নি। কিন্তু পরবর্তী যুগে খালি পায়ের মিথ তুলে বেশ একটা জাতীয়তাবাদী জোশ তেলার চেষ্টা করাটা আসলে পোস্ট কলোনিয়াল সিনড্রোমের একটা বড় উদাহরণ। এই সিন্ড্রোম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি করেছে। পশ্চিমাদের সবই ‘খারাপ’, ওরা সবসময় আমাদের সঙ্গে ‘ষড়যন্ত্র’ করে- এসব সস্তা বুলি দিয়ে অবশ্য রাজনীতিবিদ আর ধর্মগুরুরা করে কম্মে খাচ্ছেন। যাকগে সে আলাপ বাদ দিয়ে আবার টুর্নামেন্টে ফিরে আসি। নতুন দুনিয়ায় প্রথমবারের মতো ফুটবলে ব্যবসাপাতির একটা ব্যাপার-স্যাপার দেখা গেলো। যার প্রভাব পড়লো ফরম্যাটে।
আয়োজকরা স্টেডিয়াম ও কাঠামো নির্মাণের খরচ উঠিয়ে আনার জন্যে মরিয়া হয়ে ছিলেন বলে শুরুর থেকে চলে আসা নক-আউট পর্বের নিয়ম উঠে গেলো, বাড়লো খেলার সংখ্যা। দলগুলোকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা হলো, আর এত কাণ্ডকীর্তির ফলে আগের দুই আসরের ১৬টি করে খেলার বদলে এবার খেলার সংখ্যা হলো ৩০টি। শুধু তাইনা, প্রতিটা দলের অন্তত তিনটা খেলার সুযোগ থাকায় দলগুলোর এতো লম্বা ভ্রমণ কেবল এক খেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকার সুযোগ রইলো না। প্রথমে ফিফা মৃদু আপত্তি জানালেও স্বাগতিক ব্রাজিলের হুমকিতে চালু হলো নতুন নিয়ম। নতুন যুগে, বিশ্বকাপের বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় আসর হয়ে উঠাতে এই সিদ্ধান্ত অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। সেই যুগে ফুটবলে টাকা পয়সার ব্যাপারটা কেমন ছিলো সেটার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মেক্সিকো আর সুইজারল্যান্ড দুইদলেরই জার্সি ছিল মোটে একসেট এবং সেগুলোর রঙও ছিলো লাল। গ্রুপ পর্বের খেলায় জার্সির রং নিয়ে গোল বাঁধলে মেক্সিকো ভদ্রতা করে সুইজারল্যান্ডকে নিজেদের সাথে বয়ে আনা আনা লাল জার্সি পড়ে খেলতে দেয় আর নিজেরা স্থানীয় এক ক্লাবের থেকে জার্সি ভাড়া করে খেলতে নামে। লাল জামা গায়ে দিয়ে নিরপেক্ষ সুইস খোকাবাবুরা আদেমির আর জিজিনহোর ব্রাজিলের সঙ্গে ড্রও করে ফেলে। তবে গ্রুপের বাকি দুই খেলায় জিতে গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিলই। বাকি তিন গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন স্পেন, সুইডেন আর উরুগুয়ের সঙ্গে একই সাথে তারা উন্নীত হয় ফাইনাল রাউন্ডে।
মিডিয়ার সৃষ্টি ইংল্যান্ড দল জাত্যাভিমান ভুলে ব্রাজিল থেকে কাপ নিয়ে যাবে এইরকম হুংকার দিয়ে পয়লা রাউন্ডেই চিতপটাং হয়ে পড়ে। চিলির সঙ্গে প্রথম ম্যাচটি ইংলিশ সিংহরা জিতলেও দ্বিতীয় ম্যাচে হারলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে! একে তো ইয়াংকিদের ফুটবল নিয়ে আগ্রহ কম তায় এইরকম হম্বিতম্বি করে এসে এইরকম হার! অবশ্য সে খেলার আরেকটা দিকও বিবেচনার যোগ্য, আঙ্কেল স্যামদের এই জয়ের কৃতিত্ব কিন্তু এক কালো মানুষের। হাইতি থেকে আসা এক শরনার্থী ল্যারি গেটজিন্সের ৩৮ মিনিটের গোলে ইংল্যান্ড হেরে যায়। বৃটিশ পত্রপত্রিকার কাছে ব্যাপারটা এতোটাই আশ্চর্যের ছিলো যে তারা সংবাদ ছেপেছিলো ইংল্যান্ড আসলে ১০-১ গোলে জিতেছে কিন্তু টেলিগ্রাফের ভুলে সেটিকে ০-১ মনে হচ্ছে। স্যার স্ট্যানলি ম্যাথুজের দল সেদিন বোলো হরিজেন্তেতে হাইতি থেকে আসা অভিবাসী ছাত্র, ডিসওয়াশার আর একদল ভাগ্য অন্বেষণকারী নিয়ে গঠিত দলটির কাছে যেভাবে হারলো, ২৯ জুনের সেই খেলাটিকে আজও বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় আপসেট হিসেবে গোনেন অনেকেই। সেটির কারণও আছে, সেদিন খেলায় ইংল্যান্ডের পক্ষে বাজির দর ছিলো ৫০০:১।
এরপরে ফ্রাংকোর স্পেনের কাছেও হারে রাণীর ছেলেরা। সেদিন মারকানায় একমাত্র গোলটি দেন টেলমো জারা। যার লা লিগার রেকর্ড এই কদিন আগে ভাঙলেন বার্সার একান্ত আপন বাধ্য ছেলে লিওনেল মেসি। সেই খেলার ফলাফল প্রকাশ নিয়েও আবার দেখা যায় শাসকদের ভিন্নরকম দম্ভ। স্পেনে তখন সামরিক শাসক ফ্রাঙ্কোর যুগ চলছে। খেলায় জেতার পর স্পেন দলের কর্মকর্তা মুনোজ কালেরো উত্তেজিত হয়ে মাদ্রিদে এক বার্তা পাঠান। নাজিদের হয়ে রাশিয়াতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার খেয়ে এসেও ফ্যাসিস্টদের দালালির অভ্যাস থামাতে না পারা মুনোজ সেই বার্তায় লিখেছিলেন, ‘আমরা সাদা কুকুরগুলোকে হারাইছি। ইংলিশ চ্যানেলে ১৫৮৮ সালের হারের শোধ নিছি’। স্পেনের জয়কে তিনি উৎসর্গ করেন ‘দুনিয়ার সবচেয়ে মহান কাউডিলোর (সামরিক নেতা) উদ্দেশ্যে। অবশ্য পরের ম্যাচটা তিনি আর কাউকেই উৎসর্গ করে উঠতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়না। কারণ ফাইনাল রাউন্ডের সেই ম্যাচে ব্রাজিলের কালো আদমিরা ফ্রাংকোর ছেলেদের গুনে গুনে আধাডজন গোল দেয়। তারপর ব্রাজিল সুইডেনকে হারায় ৭-১ গোলে। অন্যদিকে উরুগুয়ে সুইডেনকে ৩-২ গোলে হারালেও স্পেনের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে। ফলে ১৬ই জুলাই মারাকানার ফাইনালে ব্রাজিলের কেবল ড্র করলেই চলবে এইরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেদিন পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি মানুষ মাঠে এসেছিল খেলা দেখতে। কেউ বলেন, সংখ্যাটা ১ লাখ ৯৯ হাজার আবার কেউ বলেন ২ লাখ ৫ হাজার। পুরো ব্রাজিল প্রস্তুত উৎসবের জন্য। ব্যতিব্যস্ত ফুটবল কর্তারা ব্রাজিল দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য খেলার আগেই নিয়ে এলেন উপহার- স্বর্নের ঘড়ি, যাতে খোচিত ছিলো ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের জন্য’ শব্দগুলো। পত্রিকাগুলো ফার্স্ট এডিশন ছাপিয়ে তৈরি বিজয়ের খবর দেশের সব মানুষকে জানাতে। ৫ লাখের বেশি টি-শার্ট বিক্রি হয়ে গেল যাতে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্ব বিজয়ের গল্প লেখা। আগের বছরই কোপা আমেরিকায় ৫-১ গোলে উড়িয়ে দেয়া উরুগুয়ের সঙ্গে ‘সহজ’ জয়ের আশায় খেলা ফ্রিয়াকা দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই স্বাগতিকদের এগিয়েও দেয়।
কিন্ত মারাকানায় দুনিয়া কাঁপানো উৎসব থামিয়ে দিয়ে সে গোলের ২০ মিনিট পরে সমতা আনেন শিয়াফিনো আর ৭৯ মিনিটে উইং থেকে এক গোলে গোটা দুনিয়াকে স্তব্ধ করে দেন ঘিগিয়া। লাখ দুয়েক লোকের নিশ্বাঃসের শব্দটুকু পাওয়া গেলো না, কান্নাগুলো যেন সব বোবা হয়ে গেলো। লাখো লাখো মানুষ নিয়েও মাঠটা মুহূর্তেই হানাবাড়ি হয়ে গেলো! শেষ বাঁশি বাজার পর একজন ধারাভাষ্যকার মিনমিনে গলায় পরাজয়টাকে ব্রাজিলের ইতিহাসের জঘন্যতম ট্রাজেডি হিসেবে অ্যাখ্যা দিলেন। পুরো ব্যাপারটাতে হতবুদ্ধি হয়ে যান ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমেও। তার নিজের নামে নাম দেয়া কাপটি হাতে নিয়ে তিনি কি করবেন সেটাও ভেবে উঠতে পারছিলেন না। তার পকেটেও ছিলো বিজয়ী ব্রাজিলকে উদ্দেশ্য করে লেখা অভিনন্দন বার্তার স্ক্রিপ্ট। মসিউ রিমেকে উদ্ধার করেন, উরুগুয়ের অধিনায়ক ওবডোলিউ ভারেলা। তিনি এসে নিশঃব্দে কাপটি নিজের হাতে তুলে নেন।
সেই ভারেলা, যিনি গোটা দলকে আগের রাতে উত্তেজিত করেছিলেন। ব্রাজিলের নিশ্চিত বিজয়ের খবর ছাপা হওয়া সংবাদপত্রের একগাদা কপি কিনে সেগুলোতে মূত্র বিসর্জন করে দলকে জয়ের জন্য প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন। তবে ভারেলা ছিলেন সত্যিকারের খেলোয়াড়ি মনোভাবের মানুষ। দলকে জেতানোর জন্য তাতিয়ে দেওয়া ভারেলা খেলা শেষে রিপোর্টারদের ছবি তোলার অনুরোধ প্রত্যাখান করেন। শুধু তাইনা, রিওর বারগুলোতে গিয়ে ক্রন্দনরত ব্রাজিল সমর্থকদের সান্ত্বনা দিয়ে তাদের সঙ্গে বসে বিয়ার পান করেন। ব্রাজিলিয়ানরা তাকে চিনতেও পারেনি, ভেবেছিলো তাদেরই কেউ। পরেরদিন নিজ দেশের রাজধানী মন্টিভিডিওর বিমানবন্দরে নেমে তিনি সমর্থকদের ভিড় দেখে, কাসাব্লাঙ্কা সিনেমার হামফ্রে বোগার্টের মতো রেইনকোট আর হ্যাট পরে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান।
কিন্তু ব্রাজিলের গোলকিপার মোয়াসির বারবোসা নাসিমান্তো কারো চোখ এড়াতে পারেননি। নিঃসন্দেহে সে বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপার ছিলেন বারবোসা। দারুণ ফুটওয়ার্ক আর আত্মবিশ্বাসী বারবোসা ছিলেন নিজের সময়ের সমস্ত গোলকিপারের আদর্শ। কিন্তু, ফাইনালের দিন ডান প্রান্ত থেকে ঘিগিয়ার শটটা ধরতে গিয়ে তিনি শুয়ে পড়েন, হাত পিছলে বল জালে জড়িয়ে যায়। হৃদয় ভেঙ্গে দেওয়া সেই গোলের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তার গোটাজীবনও।
ব্রাজিলিয়ানরা তাকে কখনো ক্ষমা করেনি। এমনকি ১৯৯৩ সালে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের খেলা চলাকালীন সময়ে ব্রাজিলের তৎকালীন খেলোয়াড়দের শুভকামনা জানাতে তাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে গেলে, তাকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
দীর্ঘ ২২ বছরের ক্যারিয়ারে সময়ের অন্যতম সেরা গোলকিপার হওয়া সত্ত্বেও গ্লাভস না পড়ে বেশিরভাগ সময় খালি হাতে গোলকিপিং করা বারবোসার বাকি জীবন কাটে দারিদ্র্যে আর বঞ্চনায়। সামান্য পেনশনের টাকায়, স্ত্রীর বোনের বাড়িতে থাকতেন তিনি। নিজের ৭৯তম জন্মদিনের ১০ দিন পর মারা যাওয়া বারবোসা পরে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ব্রাজিলে যেকোন অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ৩০ বছরের জেল অথচ আমি কোন অপরাধ না করেই ৪৩ বছর ধরে শাস্তি ভোগ করছি। বারবোসার ভাগ্য আসলে হাজার হাজার হিবাকুশাদের মতো, যারা বিনাদোষে প্রতিনিয়ত শাস্তি পাচ্ছে এই অসাম্যের দুনিয়ায়।
তবে গল্পের শেষ এইখানেই নয়। সেদিন মারাকানায় খেলা ২২ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন কে বেঁচেছিলেন জানেন? উরুগুয়ের বিজয়সূচক গোলদাতা আলসিডেস ঘিগিয়া। বছর তিনেক আগে, তিনি নিজ শহর মন্টিভিডিওতে মারা যান। আর, তারিখটা ১৬ই জুলাই, মারাকানার সেই ফাইনালের ঠিক ৬৫ বছর পূর্তিতে।