সারা দুনিয়ার জন্যেই সে সময়টা ছিল খুব উদ্বেগের। ইতিহাসের পাতা তখন খুব দ্রুত উল্টাচ্ছে, কিন্তু কোনদিকে? হলিউডের নির্বাক মুভির ক্লাসিক যুগ শেষে চলে এসেছে টকিজ কারণ গোটা দুনিয়াতেই যে তখন হাউকাউ বেঁধে গেছে। কমরেড মাও জেদং তার বিখ্যাত লং মার্চ শুরু করলেও দক্ষিন আমেরিকার নিকারাগুয়ায় বিপ্লবী সান্ডিনো খুন হয়ে গেছেন, আর ক্ষমতায় এসেছে খুনে সমোজা। বলিভিয়া আর প্যারাগুয়ে ছিঁড়ে ছিবড়ে খাওয়ার তাল করছে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল আর শেলের মতো বহুজাতিক কর্পোরেশন।
ওদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হতশ্রী জার্মানিতে এক অস্ট্রিয়ান কর্পোরাল আর্য জাতির গৌরবের কথা বলে জার্মানদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছেন। সেই বছর, সেই ১৯৩৪ সালে, সেই গোঁফওয়ালা, এডলফ হিটলার ‘ফুরার’ উপাধি গ্রহণ করে সূচনা করলেন সহস্র বছরের থার্ড রাইখের। রাইনের মাটি থেকে নিকেশ শুরু হলো ‘অপরাধী’, সমকামী, রোগাক্রান্ত আর ‘ছোট জাতের’।
সীমানা পেরিয়ে ইতালিতেও যোগ্য সঙ্গী পেলেন হিটলার। আরও এক পাকা বামের (থুক্কু সাবেক স্যোসালিস্ট), নাম বেনিতো মুসোলিনি। বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের গুরু হিটলারকেও ছাড়িয়ে গিয়ে রিপাবলিকান ফ্যাসিস্ট পার্টির প্রধান নিজ দেশেই আয়োজন করে ফেলে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ফুটবল। ফুটবলের মহৎ শক্তিকে নোংরা রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহারের সবচেয়ে লজ্জার এক প্রদর্শনীতে পরিণত হয় ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপ।
সেই যুগে ৩৫ লাখ লিরা খরচ করে আয়োজিত বর্নাঢ্য এই টুর্নামেন্টের সবকিছুই ছিল ফ্যাসিস্ট দর্শনের ছাপ দেওয়া। দুই বছর আগেই, ডক্ট্রিন অফ ফ্যাসিজম নামের বই লেখা মুসোলিনি টুর্নামেন্টের লোগো হিসেবে বাছাই করেন এক পায়ে বলের দখল নিয়ে ফ্যাসিস্ট স্যালুট দেয়া হারকিউলিসকে, হয়তোবা অন্য সব ফ্যাসিস্টদের মতোই নিজেকেও দেবতাপুত্র হিসেবে ভাবতেন বলেই। শুধু তাই না, প্রতি ম্যাচেই স্টেডিয়ামের গ্যালারির বক্স অফ অনারে বসে ইতালির খেলোয়াড়দের নাৎসি স্যালুট গ্রহণ করতেন এই ‘দুই নম্বর’ হিটলার।
মে মাসের ২৭ তারিখ শুরু হওয়া টুর্নামেন্টটি শেষ হয় মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে। আর অবধারিতভাবেই চ্যাম্পিয়ন হয় ফ্যাসিজমের জয়গান গাওয়া মুসোলিনির ইতালি দল। ফরম্যাটটাও ছিলো অদ্ভুত, নাৎসিদের মতোই। প্রথমবারের মতো ৩৬টা দল বাছাই পর্ব খেললেও চূড়ান্ত পর্বে খেলে ১৬টি দল। তবে, বিশ্বকাপের প্রথম দিনেই আটটা নকআউট ম্যাচ খেলা হয়। জয়ী দলগুলো চলে যায় সোজা কোয়ার্টার ফাইনালে।
প্রথম বিশ্বকাপের ল্যাটিন আধিপত্যের রেশ কাটিয়ে এবারের খেলা ছিল পুরোই ইউরোপময়। আফ্রিকার প্রথম দল মিশর ছাড়াও ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ অ-ইউরোপীয় সব দলই একদিনেই বাদ। অবশ্য, মনে রাখতে হবে, আগের টুর্নামেন্টে ইতালি না খেলায় চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে এবারের আসরই বয়কট করে। বিশ্বকাপের প্রায় শতবর্ষী ইতিহাসে ঐ একবারই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের ছাড়াই বসে বিশ্বকাপের আসর।
আর বিশ্বকাপের বিষয়টা তখনও নাজুক! সেটা বোঝা যায় ইংরেজেদের ‘অভিজাত’ আচরণে। ঘরোয়া লিগের গুরুত্বপূর্ণ খেলা ফেলে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড আর ওয়েলস বিশ্বকাপের মতো ‘ফালতু’ টুর্নামেন্ট খেলার আগ্রহই দেখায়নি। এমনকি সেসময় চলছে পেশাদার আর শৌখিন ফুটবলার ইস্যুতে ঐতিহাসিক তর্ক। অলিম্পিক আর বিশ্বকাপের মতো প্রতিযোগিতার চেতনার সঙ্গে পেশাদার ফুটবল যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার বহর। এই সুযোগে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি কেল্লা ফতে করে নিলেন। অবশ্য সহজে আয়োজক হলেও কাপ জিততে ইতালিরও ঘাম ঝরেছে। কারণ বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল ভ্রাতৃপ্রতীম বন্ধুরাষ্ট্র হিটলারের নাৎসি জার্মানি। ঝামেলা পাকালো ল্যাটিন আমেরিকায় খুনের মচ্ছব চালানো কনকিস্টাডরদের বংশধর স্পেনও। ৩১ মের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালি-স্পেন দুই দলের মধ্যে হলো ভয়াবহ এক যুদ্ধ। রূপকার্থে না, সত্যিকারের বিধ্বংসী এক মারপিট। সাড়ে তিন ঘণ্টা মারমার কাটকাট সে খেলার ফলাফল ১-১ হলেও ইতালি জিতেছিলো আরেক হিসেবে, ৭-৪ ব্যবধানে। কারণ মারধর খেয়ে এবং দিয়ে মাঠের বাইরেই চলে যেতে বাধ্য হয় ইতালির একাদশের চার আর স্পেনের সাত-সাতজন খেলোয়াড়। এই সাতজনের একজনতো আবার কিংবদন্তী গোলকিপার রিকার্ডো জামোরো, যার সমন্ধে বলা হতো পেনাল্টি বক্সে বিপক্ষের খেলোয়াড়কে নাকি তিনি সম্মোহিত করে ফেলতে পারতেন। ইতালি অবশ্য শেষমেশ জেতে। পরদিন ফিরতি খেলায় ১-০ গোলে। আর যেমনটা হয়, সব যুদ্ধে জিততে কিছু রাজাকারের দরকার হয়। মুসোলিনিও আর্জেন্টিনার দুই রাজাকারের সহায়তা পেয়ে যান ফাইনালে। ইতালির নাগরিকত্ব নেয়া ওরসি দুর্দান্ত ড্রিবলে চেক গোলকিপারকে ফাঁকি দিয়ে গোল পোস্টের খোঁজ বের করেন আর আরেক ইতালিয়ান বনে যাওয়া আর্জেন্টাইন গুয়াইতার এসিস্টে শিয়াভিওর গোলে চেকোশ্লোভাকিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে ট্রফি জেতে স্বাগতিকরা। চেক খেলোয়াড় অলড্রিচ নেজেদলি পাঁচ গোল দিয়ে হন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা, চারটি করে গোল দিয়েছিলেন জার্মান এডমুন্ড কোনেন ও ইতালির শিয়াভিও।
ইউরোপের মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপটা মনে রাখা যেতে পারে অস্ট্রিয়ান দলের অধিনায়ক ম্যাথিয়াস সিন্ডেলারের কারণেও। লিকলিকে শরীরের এই অস্ট্রিয়ান ফুটবলার ছিলেন হিটলার আর মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধাচারী। নাৎসি অধিকৃত ভিয়েনায় পরবর্তীতে তার মৃত্যুও হয় রহস্যময়ভাবে। (সে এক গল্প, এ স্থলে সেটা নাই বা বলা হল)। প্রথম বারের মতো রেডিওতে বিশ্বকাপের লাইভ কমেন্ট্রি প্রচারের পাশাপাশি এই বিশ্বকাপে ৩ লাখ পোষ্টার, স্ট্যাম্প এমনকি সিগারেটের বিজ্ঞাপন মিলে ফ্যাসিজমের বিশ্বকাপ প্রচার-প্রসারের এক নতুন বিজ্ঞাপনী মঞ্চ হয়ে দাঁড়ায়।
আদতে ইতালির আয়োজনের এই বিশ্বকাপ ছিল স্বৈরশাসন আর বিশ্বকাপের মধ্যে শুরু হওয়া এক অপবিত্র সম্পর্কের অভিষেক। খেলাভক্ত সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য দুর্ভাগ্য এই যে, এই নোংরা অপচ্ছায়া বার বার ফিরে এসেছে এই দারুণ প্রতিযোগিতাটিকে কলুষিত করতে