টাইগাররা নয়, অবশেষে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিল টাইগ্রেসরা

১৩ এপ্রিল ১৯৯৭। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের তেনাগা ন্যাশনাল স্পোর্টস কমপ্লেক্সের মাঠ। ষষ্ঠ আইসিসি ট্রফির ফাইনাল। মাশরাফি, সাকিব, ‍তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরা; মানে এখনকার তারকা খেলোয়াড়েরা তখন কতটা খেলা বোঝেন, বলা শক্ত। তবে সবাই-ই বোধহয় রেডিওর আশেপাশেই ছিলেন। শেষ ওভারে বাংলাদেশের দরকার ছিল ১১ রান। হাতে মাত্র ২ উইকেট। ক্রিজে ব্যাটসম্যান বলতে এক খালেদ মাসুদ পাইলট। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি বাংলাদেশ জিতে নিয়েছিল ১ উইকেটে। মাথায় পরেছিল টেস্ট না খেলা দলগুলোর মধ্যে সেরার তকমা। আর সারা দেশ মেতে উঠেছিল প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জয়ের অনাস্বাদিত-পূর্ব আনন্দে।

আইসিসি ট্রফির শিরোপা হাতে আকরাম খান

২২ মার্চ ২০১২। মিরপুরের শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ড্রেসিং রুমে মাশরাফি, সাকিব, ‍তামিম, মুশফিকরা সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন। একাদশ এশিয়া কাপের ফাইনাল ওভারের খেলা চলছে। প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলছে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। শেষ ওভারে প্রয়োজন ৯ রান। ক্রিজে তখনো আছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। কিন্তু জিতিয়ে ফিরতে পারলেন না। ২ রানে হেরে গেল বাংলাদেশ। কাঁদতে থাকা মুশফিকের মাথা বুকে নিয়ে ছলছল চোখে শূন্যে তাকিয়ে থাকা সাকিবের ছবিটা হয়ে রইল এক নতুন বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন। অল্পের জন্য যাদের হাত থেকে ফসকে গিয়েছিল এশীয় সেরার তকমাটা।

একাদশ এশিয়া কাপ কাঁদিয়েছে মুশফিক-সাকিব-তামিমদের

৬ মার্চ ২০১৬। শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মিরপুর। ত্রয়োদশ এশিয়া কাপের ফাইনাল। টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটে প্রথম। এবার শেষ ওভারে মাশরাফি, সাকিব, ‍তামিম, মুশফিকরা সবাই মাঠেই ছিলেন। অবশ্য কাগজে-কলমে সেদিন শেষ ওভারের খেলা হয়ই-নি। কারণ ভারত ম্যাচটি জিতে নিয়েছিল ৭ বল হাতে রেখেই। আরও একবার এশিয়ার সেরা হওয়ার হাত-ছোঁয়া দূরত্বে এসেও ফিরে আসতে হয়েছিলো খালি হাতে।

ভারতের কাছে হেরেও এশিয়া কাপ হাতছাড়া হয়েছে আরও একবার

১০ জুন ২০১৮। ২১ বছর পরে আবারো মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে। মাঠ অবশ্য ভিন্ন। এবার কিনরারা একাডেমি ওভাল। সেখানে চলছে এশিয়া কাপের ফাইনাল। তবে মাশরাফি, সাকিব, ‍তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরা সবাই মিরপুরের শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। অনুশীলনে। কারণ মালয়েশিয়ায় পুরুষদের নয়, বসেছে নারীদের সপ্তম এশিয়া কাপের আসর।

নারীদের এশিয়া কাপটা ভারত একরকম নিজেদের সম্পত্তিই বানিয়ে ফেলেছিল। প্রথম ছয় আসরেরই চ্যাম্পিয়ন তারা। সেই একাধিপত্যে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে বাংলার মেয়েরা। প্রথমে ব্যাট করতে পাঠিয়ে তাদের আটকে দিয়েছে মাত্র ১১২ রানে। তবে জবাব দিতে নামার পর ভারতও ছেড়ে কথা বলেনি। একসময় তো মনে হচ্ছিল খেলা ওরা বের করেই নিয়েছে। নিগার সুলতানা পরপর ৩ বলে চার মেরে বাংলাদেশকে ফেরান খেলায়।

শেষ ওভারে বাংলাদেশের দরকার ৯ রান। ঠিক ছেলেদের প্রথম এশিয়া কাপ ফাইনালের মতোই। হাতে উইকেট আছে পাঁচটা। ড্রেসিংরুমে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় শামীমা, ফারজানা, নিগার, রুমানা, সালমারা। যদিও বাংলাদেশের মানুষ নারী ক্রিকেট সেভাবে দেখে না কখনোই, কিন্তু গতকাল অনেকেই ছিল টিভির সামনে। বিশেষ করে শেষ ওভারে তো বটেই।

টিভি পর্দায় তখন সম্মিলিত দৃষ্টি পুরুষ ক্রিকেট দলেরও। মানে মাশরাফি, সাকিব, ‍তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহদের। শেষ ৩ বলে দরকার ৩ রান। অনেকেরই হয়তো মনে পরেছে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চের কথা। সর্বশেষ টি২০ বিশ্বকাপে সেদিন ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা বাংলাদেশের জয়ের জন্য শেষ ৩ বলে দরকার ছিল ২ রান। পরপর ৩ বলে কোনো রান না তুলেই ৩ উইকেট হারিয়ে সেই ম্যাচটাও হারতে হয়েছিল।

পুরো টুর্নামেন্ট দুর্দান্ত খেলা বাংলাদেশ পরপর ৩ বলে ৩ উইকেট হারিয়ে ম্যাচটা হেরেছিল

এদিনও যেন সেই দুঃস্বপ্নটাই ফিরে আসছিল। ৩ বলে প্রয়োজন ৩ রান। সেদিনের মতোই ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে চতুর্থ বলে আউট হলেন সানজিদা। যে রুমানা ওভারের শুরুতে চার মেরে খেলা মুঠোয় পুরেছিলেন, পঞ্চম বলে দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে গেলেন তিনিও। জয়ের জন্য শেষ বলে সেদিনের মতোই প্রয়োজন ২ রান। প্রতিপক্ষও সেই একই- ভারত। আর মেয়েদের ক্রিকেটে তারা আরও পরাক্রমশালী।

কিন্তু ছেলেদের সেদিনের সেই ব্যর্থতা ঘুচিয়ে দিল মেয়েরা। শেষ বলে জাহানারার ব্যাট বলকে দূরে ছুঁড়ে দিল। সেই বল ফেরত আসার আগেই সে আর সালমা দৌড়ে দুবার জায়গা বদল করে নিল। প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠেই এশিয়া কাপ জিতে নিল বাংলার দামাল মেয়েরা। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এশীয় ক্রিকেটের সেরার তকমা মাথায় তুলল। প্রথমবারের মতো আইসিসির পূর্ণাঙ্গ তথা টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর অংশগ্রহণের কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতল। নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন।

প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠেই এশিয়া কাপ জিতে নিল বাংলার দামাল মেয়েরা

আর এই অর্জনের মুহূর্তটা মাঠ থেকে যোজন দূরে আরেক স্টেডিয়ামে বসে উপভোগ করলেন মাশরাফি, সাকিব, ‍তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরা। তারা যে আনন্দে নেচে উঠলেন, সেটা হয়তো নিছক শিরোপা জয়ের আনন্দ নয়। সাথে যে শাপমোচনের আনন্দও নেই, তা কে বলতে পারে! সেই ভিডিও শেয়ারও করেছেন তামিম ইকবাল।

এমনটা ফুটবলে আরো কয়েক বছর আগে থেকেই ঘটছে। ছেলে ফুটবল দলের পারফর্মেন্স যখন তলানিতে এসে ঠেকেছে, নারীরা তখন ফুটবলে দেখাচ্ছেন অগ্রযাত্রার অসম্ভব এক স্বপ্ন। তবে ক্রিকেটে অর্জনে মেয়েরা ছেলেদের পেরিয়ে যাবে, এটা কথার কথা হিসেবে বলাটাও কেবল অসম্ভবই নয়, রীতিমতো অবান্তর কথাই ঠেকতো। সেই অসম্ভবও আজ মেয়েরা বাস্তবে পরিণত করেছে। আর আশার কথা, ক্রিকেটে কেবল মেয়েরাই নয়, সেরা সময় পার করছে ছেলেরাও। সাম্প্রতিক আফগান সফর বাদ দিলে, এখনই আমাদের ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ সময় চলছে।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে চলুক, অগ্রযাত্রা অক্ষুণ্ণ থাকুক শ্রেষ্ঠত্বের পানে। তার জন্য অবশ্য আরো একটি অনুঘটকের প্রয়োজন আছে। ক্রিকেটের হর্তাকর্তাদের সুবুদ্ধির উদয় হওয়া, যাতে তারা নিত্যনতুন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে এই অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার আয়োজন না করেন।