মৃত্যুর শতবর্ষে দাঁড়িয়ে হীরালাল সেনকে পুনরাবিষ্কার

দীর্ঘদিন ধরে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক-এর গৌরব তিলক লাগিয়ে রাখা হয়েছে দাদাসাহেব ফালকে-র কপালে। তাকেই ধরে নেয়া হয়েছে উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে। যুক্তি, উপমহাদেশের প্রথম ফিচার ফিল্মটি (নির্বাক) তারই বানানো- রাজা হরিশ্চন্দ্র (১৯১৩)। কিন্তু সে যুক্তিতে যে খারিজ হয়ে যান স্বয়ং লুমিয়ের ব্রাদার্সই। তাদের সিনেমাগুলোও যে কাহিনিচিত্র নয়। ট্রেনের ছুটে আসা, রানির অভিষেক ইত্যাদির দৃশ্যায়নই ছিল তাদের চলচ্চিত্রের উপজীব্য। অনেকটা তথ্যচিত্রের মতো। আর যদি লুমিয়ের ব্রাদার্সকে পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে মেনে নেয়া হয়, সেই একই যুক্তিতে কেবল বাংলারই নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশেরই প্রথম চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেন।

সেটা অবশ্য অনেক যুক্তি-প্রমাণের বিষয়। কেননা হীরালাল সেন অনেকগুলো চলচ্চিত্র বানালেও, তার সবগুলোই ১৯১৭ সালে এক অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হয়ে যায়। তার কোম্পানির নাম ছিল লন্ডন-বায়োস্কোপ। অফিস ছিল কোলকাতার হেদোতে। এখন যে জায়গাটার নাম আজাদ হিন্দ বাগ। সে বছরের এক রাতে সেখানকার আকাশ রাঙা হয়ে ওঠে। পরদিন জানা যায়, লন্ডন বায়োস্কোপ-এর গুদাম আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে হীরালাল সেনের সারা জীবনের পরিশ্রম ও সাধনা লব্ধ ধনসম্পদ- তার সকল ফিল্মের রিল এবং তার ক্যামেরা।

হীরালাল সেনের জন্মদিনে জন্মভিটায় দিনব্যাপী চলচ্চিত্রায়োজন

তার জীবনে অবশ্য সেটিই একমাত্র ধাক্কা ছিল না। তার প্রথম বায়োস্কোপ কোম্পানির নাম ছিল রয়েল বায়োস্কোপ। ভাইয়ের সাথে মিলে সে কোম্পানি খুলেছিলেন। পরে বনিবনা না হওয়ায় আলাদাও হয়ে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে ১৯০২ সালে কোলকাতায় চলে আসেন জে এফ মাদান। বোম্বেতে তার দুটো পার্সি থিয়েটার ছিল। সেগুলোর বাবদে প্রচুর টাকাও কামিয়েছিলেন। কোলকাতায় এসে খুলে বসেন এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানি। পরের দিকে তার কোম্পানির কাছে মার খেয়ে যায় হীরালালের কোম্পানি।

এরই মধ্যে সেই অগ্নিকাণ্ডে সব হারিয়ে বসেন হীরালাল। তবু আবার নতুন করে শুরুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে রোগগ্রস্ত শরীরে শেষরক্ষা হয়নি। ক্যান্সারে মারা যান ১৯১৭-এর ২৬ অক্টোবর। তারপর ভারতের রাজধানী যেমন কোলকাতা থেকে ফিরে যায় দিল্লিতে, তেমনি চলচ্চিত্রের কেন্দ্রভূমির মর্যাদাও হারায় শহরটি। ভারতের চলচ্চিত্রের তীর্থস্থানে পরিণত হয় বোম্বে।

আর হয়তো একারণেই উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রের নির্মাতা হয়েও, বিদেশি চলচ্চিত্র কোম্পানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজে দেশীয় চলচ্চিত্র কোম্পানি খুলেও, দেশের প্রথম চলচ্চিত্র বানিয়েও উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনকের তকমা কপালে লেখাতে পারেননি তিনি। উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস রচয়িতারা তার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা স্বীকার করেও, প্রথম ফিচার-ফিল্ম নির্মাতা হিসেবে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনকের খেতাব দিয়ে দেন দাদাসাহেব ফালকে-কে।

অন্যদিকে বাঙালিরাও হীরালাল সেনের ব্যাপারে দীর্ঘদিন উদাসীন ছিল, যেমন উদাসীনতা দীর্ঘদিন কাজ করেছে দুই বাংলার চলচ্চিত্রের ব্যাপারেও। এ ব্যাপারে প্রথম উচ্চকণ্ঠ হন ঢাকার বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী। তারা খুঁজে খুঁজে বের করেন হীরালালের জন্মস্থান- মানিকগঞ্জের বকজুড়ি গ্রাম। একটু একটু করে ইতিহাসের পাতায় জমা ধুলো সরিয়ে বের করে আনতে শুরু করেন হীরালালের কৃতি ও কীর্তি। তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের পত্রিকা ধ্রুপদী-তে মইনুদ্দীন খালেদ একটি প্রবন্ধ লেখেন- প্রথম চলচ্চিত্রকার : হীরালাল সেন। দাবি করেন, উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকারের খেতাবটা তারই প্রাপ্য।

হীরালাল সেনের শততম মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনদিনব্যাপী কর্মসূচী পালিত হচ্ছে

তবে বাকি ছিল আরো অনেক ঠিকুজি-কুলুজি উদ্ধার করার। সে কাজে ব্রতী হন তরুণ চলচ্চিত্র গবেষক শরীফ রেজা মাহমুদ। তিনি এক এক করে উদ্ধার করেছেন হীরালাল সেনের জন্মতারিখ, তার বাড়ির খোঁজ, তার কোলকাতার উত্তরাধিকারীদের সন্ধান, তার চলচ্চিত্রগুলোর তথ্য-উপাত্ত প্রভৃতি। জানা গেছে হীরালাল সেন কেবল বিভিন্ন দৃশ্যকেই রূপালি পর্দার ফ্রেমে বাঁধেননি, অমরেন্দ্র দত্তের অনেকগুলো মঞ্চনাটকেরও দৃশ্যধারণ করে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে আছে আলীবাবা ও চল্লিশ চোর, ভ্রমর, হরিরাজ, বুদ্ধদেব প্রভৃতি।

তবে হীরালাল সেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল সম্ভবত ১৯০৫ সালে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র, যদিও আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচেনি সেটিও। গুরুত্বপূর্ণ বলেই হয়তো নামটাও বিশাল- অ্যান্টিপার্টিশন ডেমোনস্ট্রেশন অ্যান্ড স্বদেশি মুভমেন্ট, অ্যাট দ্য টাউন হল ক্যালকাটা অন ২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৫। এই তথ্যচিত্রের ভিত্তিতে এমন দাবিও করা হচ্ছে, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বাইরে, মানে এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার মধ্যে হীরালাল সেনই প্রথম স্বদেশি চলচ্চিত্রের নির্মাতা।

শুধু চলচ্চিত্রক্ষেত্রেই নয়, উপমহাদেশের প্রথম বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র নির্মাতাও তিনি। তার বানানো অন্তত দুটো বিজ্ঞাপনের কথা জানা যায়; একটি জবাকুসুম হেয়ার অয়েলের, আরেকটি এডওয়ার্ডস টনিকের।

অর্থাৎ হীরালাল সেনের কৃতি ও কীর্তি নিয়ে যে সব অজ্ঞানতাবশত ধোঁয়াশা ছিল, সে সব দ্রুত দূরীভূত হতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে ভুলে যাওয়া হীরালালকে নতুন করে জানার নানা কার্যক্রম। তার জন্মদিনে তার জন্মভিটায় দিনব্যাপী চলচ্চিত্রায়োজনের পর এবার ২৬ অক্টোবর মৃত্যুবার্ষিকীতে পালন করা হচ্ছে তিনদিনব্যাপী কর্মযজ্ঞ। সে আয়োজন ঢাকাতে তার স্মৃতিতে প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে কোলকাতায় তার বাড়িতে গিয়ে। এমন বড় আয়োজনের কারণও অবশ্য আছে। এ বছরই হীরালাল সেনের মৃত্যুর শতবর্ষ।

সব মিলিয়ে এবার বাঙালি জোর গলায় দাবি করতেই পারে, দাদাসাহেব ফালকে নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার নির্দ্বিধায় হীরালাল সেন। আর তাই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনকের খেতাবটাও তারই প্রাপ্য। শুধু তাই নয়, দুই বাংলা থেকেই এমন দাবিও করা হচ্ছে যে, হীরালাল সেন পুরো এশিয়ারই প্রথম চলচ্চিত্রকার। যদিও এখনো সে বক্তব্য প্রমাণের অপেক্ষায়।