বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে গত ২৬ থেকে ২৮ জুলাই এই শহর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় পারফরমেন্স আর্ট নিয়ে বিশাল এক আয়োজন, ‘শিল্পের শহর’। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী’র পরিকল্পনায় শহরবাসীর মাঝে শিল্পবোধ ছড়িয়ে দিতে ‘শিল্পের শহর ঢাকা’ কার্যক্রমের সূচনা হয় গত ২৬ জুলাই। ‘ঢাকা হবে শিল্পের শহর, ঢাকা হবে বিশ্বের অন্যতম নান্দনিক নগরী’ এই শ্লোগান নিয়ে এই আয়োজন শুরু করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে বছরব্যাপী সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ঢাকা শহর সম্পর্কে সমাজে যেসব নেতিবাচক অভিব্যক্তি রয়েছে সেসব দূরীভূত করে ঢাকা’কে শিল্পচর্চার নান্দনিক নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য।
শিল্পী মাহবুবুর রহমানের কিউরেটিংয়ে এই আয়োজনে অংশ নেন এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের ১৮তম আসরের জন্য নির্বাচিত ১৫ জন পারফর্মেন্স আর্টিস্ট। আসছে সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিতব্য এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের ১৮তম আসরে নিজেদের কাজ নিয়ে তারা সকলেই হাজির হবেন আন্তর্জাতিক দর্শকদের সামনে। শিল্পীদের পারফরমেন্স কেমন ছিল? কীভাবে এই নগরীতে নিজেদের শারীরিক অভিব্যক্তি দিয়ে প্রকাশ করেছেন মনের ভাব? তিনদিন ব্যাপী পারফরমেন্সের নিয়ে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক-
শিল্পী আবু নাসের রবি চেয়েছিলেন মানুষের মনের আত্মিক আনন্দের উপলদ্ধিটুকু ছড়িয়ে দিতে। সেই অনুপ্রেরণায় তিনি সাদা পোশাকে, সাদা ছাতা মাথায়, বাঁশি বাজিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছেন টিএসসি থেকে শাহবাগের পথে। মুখে মেখেছিলেন সাদা ফোম।
শিল্পী জয়দেব রোয়াজা বিউটি বোর্ডিং সংলগ্ন স্থানে নিজের শরীরে কালো রঙ মেখে পারফরমেন্স করেন। কালো রঙ ছিল এই দূষিত নগরের প্রতীক। যে নগরী ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে তার ঐতিহ্যকে, তার অতীত স্থাপত্যের নান্দনিকতাকে।
শিল্পী ফারাহ নাজ মুন পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে অবস্থিত লালকুঠিতে নিজের পারফরমেন্স সাজিয়ে ছিলেন ঐতিহাসিক স্থাপত্যটির ইতিহাসের অন্বেষায়। সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই লাল কুঠিতে শিল্পী ফারাহ নাজ মুন আলো জ্বালিয়ে খোঁজ করেছেন সেই সময়ের মানুষ আর এই স্থাপত্যের সাথে জড়িত গল্পগুলো।
শিল্পী সঞ্জয় চক্রবর্তী, নিজের পারফরমেন্সে স্মরণ করেছেন সকল মুক্তমনের সাহিত্যিককে। যারা নিজের লেখনীর দায়ে বাধা পেয়েছেন, সমাজ এবং প্রতিবেশের কাছে। শিল্পী ২০১৭ সালের প্রথম পারফরমেন্সের রেশ ধরে টানা ২য় বারের মত একই স্থান, টিএসসিতে পরিবেশন করেছেন নিজের কাজ। পরবর্তীতে তিনি হেঁটে চলেন বাংলা একাডেমির সামনের পথে, এরপর শহীদ মিনারের মূল বেদীতে তার পারফরমেন্স সমাপ্ত হয়।
শিল্পী অসীম হালদার সাগর কাজ করতে পছন্দ করেন সাধারণ মানুষের মাঝে। যেখানে তারা তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে, অভিমত জানাতে পারে। সেকারণেই, ‘সামটাইমস, সামথিংস অ্যাবাউট নাথিং’ শিরোনামের কাজটি পরিবেশিত হয় শাহবাগে অবস্থিত ডাস্টবিনের সামনে।
শিল্পী ইমরান সোহেল ও সৈয়দ মুহাম্মদ জাকির মানুষের সাথে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটকে পরিচয় করিয়ে দিতে চান, যেই প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেটি আমাদের চারপাশের পরিবেশের বৈশ্বিক আবহে।
শিল্পী সুজন মাহাবুবের কাজের অংশ হয়ে থাকে রোজকার মানুষ, নিত্য বহতা সময়কে। নিয়মিত ও প্রাসঙ্গিক পরিবেশনা তার পারফরমেন্সে স্বাতন্ত্র নিয়ে আসে। ‘অন্বেষণ’ শিরোনামের এই কাজে তিনি হেঁটে চলেছেন শহরে। তার দুই চোখ, একটি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ও মনের চোখকে প্রতিনিধি করে তিনি যেন নিরুত্তাপ অবলোকন করছেন এই শহরকে।
শিল্পী জাহিদ হোসেনের ‘সোশ্যাল ডিজায়্যার’ পরিবেশনাটির সূচনা করেছিলেন ২০০৩ সালে, ছাত্র জীবনে। দ্বিমাত্রিক উপস্থাপনায় প্রথম কাজের পর তিনি এই বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করতে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় ছিল এবারের পরিবেশনা।
শিল্পী জুয়েল এ রব পুরান এই ঢাকার সদরঘাটের পথে নিজেকে বন্দি করেছেন চটের বস্তায়। অবলোকন করেছেন পথচারী মানুষকে। যে মানুষগুলোকে শিল্পী নিজের পারফরমেন্সের সাথে সম্পৃক্ত করতে চান, যোগাযোগ স্থাপন করতে চান।
শিল্পী অর্পিতা সিংহ লোপা সোনালি কাপড়ে জড়িয়ে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। পুরনো ঢাকার অতীতের স্বর্ণালী সময়কে উপস্থাপিত করেছেন তার হাতের সোনালি রঙ দিয়ে, যেন মনে করিয়ে দিয়েছেন সেই মুহূর্তগুলোকে যা আজ ধ্বংসের পথে।
জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে পারফরমেন্স করেন শিল্পী সুমনা আক্তার। সমাজের নীপিড়িত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে সুমনা আক্তার পরিবেশন করেন ‘স্ক্রিম’ শিরোনামের পারফরমেন্স। নীরবতা নয়, এখন সময় এসেছে প্রতিবাদের এবং সেটি চিৎকারের মাধ্যমে, এমনটাই চাওয়া এই শিল্পীর।
শিল্পী শুভ অ সাহা দোয়েল চত্তরে তার পারফরমেন্স পরিবেশন করেন। ঢাকা গেটকে তিনি পূর্বের রূপে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, যেই গেট সময়ের আবহে ময়লা হয়ে গেছে, খানিকটা এই শহরের মানুষের কলুষিত মনের মতই।
শিল্পী সরকার নাসরিন টুনটুন তার পারফরমেন্সে পরিবেশন করেছেন নিজের মানসিক চিন্তাকে, যেখানে তিনি আত্মিকতা প্রকাশ করেছেন পরিবেশের সাথে।
এছাড়াও ‘শিল্পের শহর ঢাকা’ শীর্ষক কর্মসূচির অংশ হিসেবে শহরের বিভিন্ন স্থানে বাউল শিল্পীদের পরিবেশনা, স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত প্রতিভাবান শিল্পীদের পরিবেশনা, শিশুদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক এবং অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনীসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।