২০১৪ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নিজ দেশের দর্শকদের সামনে জার্মানির বিপক্ষে ব্রাজিলের সাত গোল খাওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সবচেয়ে কড়া মন্তব্য করেছিল ইসরায়েল।
সেবছর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনির আগ্রাসন নিয়ে সমালোচনা করেছিলো ব্রাজিল। পাল্টা জবাবে ইসরায়েল বলেছিল, ব্রাজিলের কূটনীতি ওদের রক্ষণের মতোই ব্যর্থ, ইসরায়লের বিপক্ষে কথা বলার জন্য এই ‘বামনদের‘ ক্ষমা চাইতে হবে।
অথচ ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশে আর্জেন্টিনার পরেই ব্রাজিলে সবচেয়ে বেশি (দুনিয়ায় ৯ম), ৯৫ হাজার ইহুদির বসবাস (সূত্রঃ ২০১৪ সালে ব্রাজিলের শুমারি)। আর হাজার কুড়ি ব্রাজিলীয় ইহুদিতো খোদ ইসরায়েলেই বসবাস করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজিদের বিরুদ্ধাচারণ করা ব্রাজিল এমনকি ইসরায়েলের সৃষ্টিতেও সহায়তা করেছিল। দুই পক্ষের বাণিজ্য আর কূটনৈতিক সম্পর্কও বেশ ভালো। আবার ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ব্রাজিলই ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শিমন পেরেজের মতো ‘প্রগতিশীল’ ইহুদির আমলে ব্রাজিল-ইসরায়েল সম্পর্ক উষ্ণ থাকলেও বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো কট্টরপন্থীদের সময়ে দুদেশের সম্পর্কে অবনতি হয়েছে। যার বড় প্রমাণ নেতানিয়াহুর গত বছরের ল্যাটিন আমেরিকা সফরে নাজিদের কোলাবরেশনের গন্ধ মাখা আর্জেন্টিনা সফর ঘটলেও ব্রাজিলে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর না যাওয়া। অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই নাজিদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠে আর্জেন্টিনা। ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশটি চে গেভারার মতো বিপ্লবী, কার্লোস লামাসের মতো নোবেলজয়ী তাত্ত্বিক-রাজনীতিবিদের জন্ম দিলেও সাধারণীকৃত বিবেচনায় দেশটার ক্ষমতাসীনেরা কেন জানি সবসময়ে ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’-কেই আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছে। প্রতিবেশী উরুগুয়ে আর ব্রাজিলে যেখানে ফুটবল ছিলো কালো মানুষের লড়াইয়ের প্রতীক ( বিস্তারিত জানতে পড়ুন- এদুয়ার্দো গালেয়ানোর ‘সকার আন্ডার শ্যাডো এন্ড সান’) সেখানে আর্জেন্টিনায় ফুটবল হয়েছে কলোনিয়াল সুপ্রিমেসি টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার (বিস্তারিত জানতে পড়ুন- সাইমন কুপারের ‘সকার উইথ এনিমিস’)। তবে নাজিদের আশ্রয় দেওয়া কর্নেল পেরনের আর্জেন্টিনাও একসময় ইহুদি লবির প্রভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আস্তে আস্তে শক্ত করে তোলে।
সে আলাপের আগে, ফকল্যান্ড যুদ্ধ নিয়ে হয় যাক ছোট্ট একটু আলাপ। ১৯৮২ সালের সেই যুদ্ধে আর্জেন্টিনা শুরুতেই পর্যদুস্ত হতো যদি না ব্রাজিল তাকে সমর্থন দিতো। ব্রিটিশ যোদ্ধাদের রিও ডি জেনেরিও বন্দর ব্যবহারের অনুমতি না দিয়ে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার দিকে পরোক্ষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। যাতে তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ‘আয়রন লেডি’ মার্গারেট থ্যাচার এতোটাই ক্ষিপ্ত হন যে, তিনি আমেরিকাকে ব্রাজিল দখলের আহবান জানান ( ব্রিটিশ গণমাধ্যম এক্সপ্রেস ইউকে ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর এই বিষয়ে গোপন নথির ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশ করে)।
ঠাণ্ডা যুদ্ধের শেষের সেই সময়টা পুরো ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে মার্কিন মদদপুষ্ট সামরিক সরকারগুলোর অত্যাচার চললেও জনতার মধ্যেও ঐক্য গড়ে ওঠার সময়। কিন্তু আলোচনার ফোকাস কেবল ফুটবলে নিবদ্ধ করলে অবশ্য ব্যাপারটা দুঃখজনকভাবে ভিন্নরকম। ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ জিততে আর্জেন্টাইন সামরিক শাসক ভিদেলার হাতের পুতুল সাজেন আর্জেন্টিনার মারিও কেম্পেসরা, অন্যদিকে ১৯৮২ সালে ব্রাজিলের সুন্দর ফুটবলের শুদ্ধতম প্রতীক সক্রেটিস ঘোষণা দিয়েছিলেন, সামরিক সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা না দিলে তিনি জাতীয় দলের হয়ে আর খেলবেন না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেম্পেসদের ফুটবলের ইতিহাসটা নিপীড়কের আর সক্রেটিসেরটা নিপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ানোর। তাই বিশ্বকাপ না জিতেও মানুষের মনে আসলে জিতে যান সক্রেটিসরাই। ব্রাজিল যখন সেনা শাসকের বুটের তলে তখন নিজের ক্লাব করিন্থিনিয়াসে ঘোষণা দিয়ে গণতন্ত্র চর্চা শুরু করেছিলেন তিনি। সমর্থকেরা আদর করে যার নাম দিয়েছিলেন ‘করিন্থিনিয়ান মডেল ডেমোক্রেসি’।
অবশ্য, পাশের দেশ আর্জেন্টিনার একজন দিয়েগো মারাদোনার উদাহরণটাও দেওয়া উচিত, এই ‘মিসফিট’ লোকটি কি করে যেন শোষিতের পক্ষে দাঁড়িয়ে যান! কার্লোস মেনেমের মতো লোকের সঙ্গে প্রথম জীবনে দহরম-মহরম থাকলেও পরে তিনি বন্ধু হন শোষিতের নেতা ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর (সূত্রঃ মারাদোনা, এমির কুস্তেরিকার নির্মিত অসামান্য এক চলচ্চিত্র)
দুর্নীতিবাজ মেনেমের প্রসঙ্গ দিয়েই আবার ফিরে আসি ইসরায়েল প্রশ্নে। মেনেম কিন্তু ক্ষমতায় এসেছিলেন সামরিক শাসক হঠিয়ে, জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে। কিন্তু কিভাবে ক্ষমতায় এসে পশ্চিমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশটাকে লুটেরাদের হাতে তুলে দিতে পারেন একজন তথাকথিত জনগণের নেতা সেটির প্রমাণ আর্জেন্টিনার কিংবদন্তী ফিল্ম ডিরেক্টর ফার্নান্দো সোলানেসের ২০০৪ সালে ডকুমেন্টারি মেমোরিয়া দেল সাকোয়ে।
মূলতঃ মেনেমের সময় থেকেই আর্জেন্টিনার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক অতিদ্রুত ভালো হতে শুরু করে। একসময়ে আর্জেন্টিনাতো ল্যাটিন আমেরিকায় ইজরায়েলের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্ররাষ্ট্রে পরিণত হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধে বীভৎসতার বন্যা বইয়ে দেওয়া নাজি অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল আর্জেন্টিনা ইসরায়েলে দূতাবাসও স্থাপন করে।
সে অবশ্য ব্রাজিলেরও আছে, এবং দুদেশের কারোরই ফিলিস্তিনের সঙ্গে পূর্ন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। আসলে ইসরায়েল প্রশ্নে ল্যাটিন দেশগুলা বরাবরই কিছুটা ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে থাকে। নিজেরা বছরের পর বছর নিপীড়িত হলেও ইসরায়েল প্রশ্নে ল্যাটিন দেশগুলো নিপীড়ক ইসরায়েল লবির সঙ্গেই থাকে। কিন্তু ফোকাস শুধু ফুটবলে রাখলে অবশ্য গত ২০ বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচ্য দুইদেশ বলটা খেলে না। ব্রাজিল জাতীয় দল তার আগে মোট ৩ বার খেলে ৩ বারই জেতে আর সর্বশেষ খেলে, ১৯৯৫ সালে তেলআবিবে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা ৫ বারের মধ্যে ২ বার হারে, এমনকি শেষবার যখন খেলে, সেই ১৯৯৭ সালেও বাতিস্তুতা, ক্লদিও লোপেজ আর আরিয়েল ওর্তেগার দল জেরুজালেমের মাঠে ২-১ গোলে হারে ইসরায়েলি ফুটবল দলের কাছে।
এই জেরুজালেমের মাঠেই লিওনেল মেসিদের খেলার কথা ছিলো বিশ্বকাপের আগে, গা গরমের ম্যাচে। বিশ্বমতের চাপে খেলাটা বাতিল হয়, লজ্জার হাত থেকে বাঁচেন নিজের সময়ের দারুন একজন খেলোয়াড়, লিওনেল মেসি। তবে ইসরায়েলের মতো দুর্বল ফুটবল দলের সঙ্গে বিশ্বকাপের আগে খেলা আয়োজন করাই বলে দেয়, আর্জেন্টিনার সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক কত উষ্ণ!
সমর্থকেরা মেসির সঙ্গে লড়াইয়ের আরেকটা যোগসূত্র খুঁজে পান। সেটা হচ্ছে কাতালান, স্পেনের যে প্রদেশটি মেসির বাসভূমি, যেখানকার ক্লাব বার্সালানোই তাকে বিশ্বসেরা বানিয়েছে। এই কাতালানরাও স্বাধীনতাকামী, অথচ লাতিনদের মতো তারাও কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখে। কাতালান নেতা কার্লেস পুজদেমন আর মেসির সহখেলোয়াড় জেরার্ড পিকে ইসরায়েলি লবির ঘনিষ্ঠ বলে একাধিকবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। এত কথা আসছে, ফেসবুকে বাঙালি সমর্থকদের ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাস ও ইসরায়েল প্রশ্নে কিছু মনগড়া, অর্ধসত্য ভাইরাল পোস্টের প্রেক্ষিতে। তবে সবকিছুর শেষে যেটা বলা জরুরি যে, এখনকার ফুটবলে সক্রেটিস বা ম্যারাডোনাদের আশা করে লাভ নেই। ক্লাব আর ফিফা যেভাবে ফুটবল খেলাটাকে বিরাজনৈতিকরণ করে চলেছে তাতে ফুটবলের সাম্যের পলিটিকাল স্পিরিটটা মরতে বসার পথে। ২৩ জুনের ম্যাচে দুই আলবেনীয় বংশোদ্ভুত জর্দান শাকিরি আর গ্রানিট শাকা সুইজারল্যান্ডের জার্সি গায়ে গোল করে সার্বীয়দের উদ্দেশ্য করে যে উল্লাসটা করলেন সেরকমটা একসময়ে ফুটবলের চিরপরিচিত দৃশ্য ছিলো বটে, কিন্তু আর খুব বেশিদিন সেটা থাকবে বলে মনে হচ্ছেনা।
লাইবেরিয়ার সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় জর্জ উইয়াহ নিজের দেশে গৃহযুদ্ধ থামিয়ে সে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, দেশকে আশা জাগাচ্ছেন কিন্তু তার বিপরীতেই আছেন মোহাম্মদ সালাহ।
লিভারপুল কিংবা মিসরের এই ফুটবলারের কাছে সমর্থকদের পলিটিকাল স্পিরিট দেখতে চাওয়ার আশা থাকলেও তিনি রুশ অধিকৃত চেচনিয়ার নেতা পুতিনের সাঙাৎ রমজান কাদিরভের বন্ধুত্ব অর্জনে সচেষ্ট হয়েছেন। কাদিরভ অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইন্সট্রাগ্রামে তুমুল জনপ্রিয়।
কিন্তু স্বাধীনতা প্রত্যাশী চেচেনদের সাথে সালাহ কি সঠিক আচরণ করলেন? উত্তর হ্যাঁ কিংবা না- দুটোই হতে পারে। কারণ, সালাহও হয়তো ম্যারাডোনার মতোই নিজের ভুল বুঝে মেনেমের বদলে ক্যাস্ট্রোর মতো কাউকে বেছে নেবেন বন্ধু হিসেবে। সুতরাং হে বঙ্গীয় ফুটবল ভক্তগণ মেসিদেরকে ফুটবলের বাইরে মহিমান্বিত বা খাটো করতে চাওয়ার চেষ্টাটাই যে বদমায়েশি সেই সিদ্ধান্তে আপনারা কবে নাগাদ পৌঁছাচ্ছেন?