বিনা খরচে মার্কেটিং!

আরে না না, মার্কেটিং শব্দটা আমরা যথেচ্ছ যেভাবে ব্যবহার করি সেটা বুঝিয়ে আকর্ষণীয় কোনো অফার দেয়া হচ্ছে না। উইদাউট অফেন্ডিং এনি পারসন লিভিং অর ডেড বলতে চাই, মার্কেটিং টার্মটি দিয়ে অনেকে যেমনটা বুঝাই তা হলো মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করা। আর বিনা খরচে ওই কাজ এই আক্রার বাজারে ভাবাটাও কঠিন।

‘মার্কেটিং’য়ের আসল সংজ্ঞাটা অবশ্য আপনারা অনেকেই জানেন। তবে এখন মার্কেটিংয়ের যে ধরনটা নিয়ে কথা বলবো তার হদিস আবার মার্কেটিং ওয়ান-ও-ওয়ান কোর্সে পাওয়া যাবে না। সেটা হলো বিনা খরচে বা একেবারেই নামমাত্র খরচে মার্কেটিং। আপনার পণ্য বা ব্র্যান্ডের খবর মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে ঠিকই, তবে তার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ না রাখলেও চলবে। বিষয়টা কঠিন। কারণ মার্কেটিয়ার মাত্রই জানেন অনেকসময় কোটি কোটি টাকা খরচ করেও কাঙ্ক্ষিত ‘রিচ’ (reach) পাওয়া যায় না। অনেকসময়ই পণ্যের খবর গ্রাহক বরাবর হয় পৌঁছায় না। কখনো পৌঁছালেও হয় মিস্ কমিউনিকেশন হয়, বা একটা গ্যাপ রয়েই যায়। মানে বড়জোর বিজ্ঞাপন ভালো হয়, ইফেকটিভ হয় না। বিজ্ঞাপনের গল্প মানুষের মনে ধরে, তবে বিজ্ঞাপনে দেখানো ব্র্যান্ডটা কী সেটা মানুষ মনে রাখতে পারেনা। এমনকী অনেক সময় সেটা কোন ক্যাটাগরির পণ্য বা সেবা সেটাও দর্শক বা গ্রাহক ঠাহর করতে পারেন না। ওই প্রডাক্ট যে আসলে বাজারে ঘোরাফেরা করছে তা-ও জানা হয় না।

তো এই বিনা খরচে বা নামমাত্র খরচে মার্কেটিংয়ের সাম্প্রতিক তিনটা উদাহরণ বলবো। তিনটিতেই দেখবেন নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার কথা মানুষকে জানানোর পেছনে টাকা না ঢালার পরও সেটির কথা কীভাবে প্রত্যাশার চেয়েও অনেক অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। তিনটি উদাহরণেই ব্র্যান্ডের নাম ছড়িয়েছে তেমন একটা খরচ না করেই। তবে ওই যে বলছিলাম না কাজটা কঠিন? তাই একটা কেস স্টাডির সাথে আরেকটার মিল পাবেন সামান্যই।

টেসলা মহাকাশ যাত্রা

কোনো বাজেট ছাড়াই টেসলা’র এই মার্কেটিং স্টান্ট ইদানিংকালের অন্যতম স্মরণীয়।

ঘটনাটাকে অনেকেই হয়তো এভাবেই মনে রাখবেন। আবার অনেকে বলবেন স্পেস এক্স-এর নতুন ফ্যালকন হেভি রকেটে করে এক টেসলা গাড়ির মহাকাশ গমন। দু’টোতেই টেসলা’র উপস্থিতি। তবে প্রডাক্ট লঞ্চ বলুন বা নতুন রকেট লঞ্চ, অফিশিয়াল লঞ্চিং ছিলো কেবল ফ্যালকন-এরই। আর ফাঁকতালে আনঅফিশিয়াল লঞ্চিং হয়ে গেলো টেসলা ব্র্যান্ডের নতুন সুপারকার রোডস্টারের। উইদাউট স্পেন্ডিং আ সিংগেল পেনি। টেসলা’র গাড়ির লঞ্চের জন্য একটা টাকাও খরচ করতে হয়নি; অথচ সেদিনের এই লাইভ ইভেন্টের কোটি কোটি ভিউয়ারের কাছে গাড়ির নতুন মডেলটির ছবি আপনাআপনিই পৌঁছে গেছে। বিজনেস ম্যাগনেট এলন মাস্কের কি আর টাকার অভাব যে উনি তার ‘টেসলা’ ব্র্যান্ডের নতুন সুপারকার ‘রোডস্টার’-এর লঞ্চের জন্য বাজেট রাখতে আরেকবার ভাববেন? অথচ চুপিসারে কী দারুণ মার্কেটিং অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেললেন এই ইনভেন্টর। কোনো বাজেট ছাড়াই টেসলা’র এই মার্কেটিং স্টান্ট ইদানিংকালের অন্যতম স্মরণীয়।

রেড বুল স্ট্র্যাটস মিশন

লাইভ এ ইভেন্টটি বছর কয়েক আগে ‘রেড বুল স্ট্র্যাটস মিশন’-এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। হয়তো সেটি থেকেই মাস্ক-এর মার্কেটিং টিম আইডিয়াটা ডেভেলপ করেছে। ওই মিশনে অস্ট্রিয়ান স্কাইডাইভার ফেলিক্স বমগার্টনারের বিশ্বের দীর্ঘতম ফ্রি-ফলিংয়ের বিশ্ব-রেকর্ড করার ঘটনার লাইভ দৃশ্য দেখেছে অগণিত দর্শক। আর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর দর্শকরা শুধু ফেলিক্সের ফ্রি-ফলটাই দেখেনি, একটানা রেড বুল-এর ব্র্যান্ডেড প্যারাশুট আর ল্যান্ডিং লোকেশনে প্রমিনেন্ট ব্র্যান্ডিংও দেখেছে।

আমারি ভালোবাসা: বিনিময় মূল্য লাখ

দিনশেষে ব্র্যান্ড আমারি’র নাম ছড়িয়েছে ফ্রি-তেই।

অনেকেই বলেন নেতিবাচক মার্কেটিং বলতে নাকি কিছু নেই। সবই কাজে লাগে কোম্পানির প্রচারের স্বার্থে। কথাটা আংশিক সত্য। কারণ কখনো কখনো নেতিবাচক মার্কেটিং ব্র্যান্ডের জন্য অশনিসংকেত বয়ে আনতে পারে। তো হোটেল আমারি-র সাম্প্রতিক প্রমোশন অফার আপাতদৃষ্টে ব্র্যান্ডটির জন্য খারাপ মনে করালেও বুদ্ধি খাটালে ভবিষ্যতে এটাকেই ক্যাশ করতে পারে হোটেলটি।

যেটা হয়েছে তা বেশ অদ্ভুত কিসিমের। হোটেলটির ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে বিশেষ অফারে লিমোজিন ড্রাইভ, হেলিকপ্টার রাইড, বুফে, স্পা, হানিমুন স্যুইটের প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছিলো ৯ লক্ষ টাকা, ভ্যাটসহ এগারো লাখের কিছু বেশি। এই নিয়ে মাত্র একটা ফেসবুক ওয়ালপোস্ট, তারপর আর যায় কই। ওয়ার্ড অব মাউথে ছড়াতে ছড়াতে দু’দিনের মধ্যেই ৬ হাজারের মতো কমেন্টস, ৯ হাজারের কাছাকাছি রিঅ্যাকশন আর ৩ হাজারের উপরে শেয়ার মিলিয়ে হোটেলটির কথা পৌঁছে যায় ৯ লাখেরও বেশি লোকের কাছে। আর হ্যাঁ, পুরোটাই অর্গানিক রিচ। পোস্ট বুস্ট করে ওই পরিমাণ রিচ পেতে যে টাকা খরচ হতো এবং গ্লোবালি একেকটা লাইক, কমেন্ট কিংবা শেয়ারের যে আর্থিক ভ্যালু আছে সেই হিসেবে আমারি’র ৯ লাখ টাকার বেশি মূল্যের ফায়দা হয়েছে একটা পোস্ট থেকেই। এটা ঠিক, ট্রল, মিম আর কম্পিটিটরদের কাছ থেকে কাউন্টার পোস্ট পেয়ে আমজনতার ভালো রোষের মুখে পড়েছে তারা, তবে দিনশেষে ব্র্যান্ড আমারি’র নাম ছড়িয়েছে ফ্রি-তেই। ভাবমূর্তি বদলাতে এ মুহূর্তে একটা সুকঠিন আর সুপরিকল্পিত মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি দরকার তাদের।

চোখের ইশারায় সিনেমার প্রচার

গোটা ভারত তো বটেই, পাশের দেশগুলোও কাত হয়ে গেলো একটি মুক্তিপ্রতীক্ষিত সিনেমার গানের অংশে অভিনেত্রীর (প্রিয়া প্রকাশ ওয়ারিয়র) চোখের ইশারায়। সোশাল মিডিয়া সরগরম মাত্র ১৯ সেকেন্ডের ওই ক্লিপে। যে প্রিয়া ওয়ারিয়রকে সেদিনের আগে তেমন কেউ চিনতোই না, সপ্তা না পেরোতেই তার ইনস্টাগ্রামে তিন মিলিয়নেরও বেশি ফলোয়ার। আরো মজার বিষয় হলো প্রিয়া ওই সিনেমা, যার নাম ওরু আদার লাভ, সেটায় পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু তার গানের ক্লিপটি ভাইরাল হয়ে যাবার সুবাদে মুভিটির টিজার ট্রেলারে শুধুমাত্র প্রিয়া আর সহশিল্পী রোশান আবদুল রাহুফকেই দেখিয়েছেন পরিচালক। এবং সেটারও রিচ ভয়াবহ। মালয়ালাম মুভি ইন্ডাস্ট্রি ভারতের অন্য অনেক প্রদেশের চেয়ে বেশ ছোটো। সে তুলনায় অলমোস্ট ফ্রি-তে হয়ে যাওয়া মার্কেটিংয়ের সুবাদে যে পরিমাণ ‘রিচ’ পেয়েছে ওরু আদার লাভ, তা ঈর্ষণীয়। সেটাকে কাজে লাগিয়ে বক্স অফিস থেকে কতো টাকা ঘরে তুলতে পারে সেটাই দেখার বিষয়।