হে মান্যবর,
দুষ্প্রাপ্য ধাতু ‘ভাইব্রেনিয়াম’-এর অফুরন্ত খনির কল্যাণে আপনার কাছে আছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। যার ধারেকাছে আর কোনো জাতি এখনো পৌঁছাতে পারেনি। আর তারই সুবাদে আপনি নিশ্চিত অবগত আছেন বাংলাদেশে এখন চলছে বসন্তকাল। তারই এক সোনাঝরা গোঁধূলিবেলায় আমরা যখন একান্ত কোনো আপনজনের প্রতীক্ষায় সিনেপ্লেক্সের উঠোনে পায়চারি করছিলাম, ঋতুরাজ বসন্তে আমাদের মাঝে এসে হাজির হলেন আরেক ‘মহারাজ’। ইয়োর হাইনেস, কিং টি-চালা। এ যেন আমাদের কাছে স্বপ্নরাজ্য ওয়াকান্ডা-কে বাস্তবে পাবার মতোই আনন্দের ব্যাপার। ২ ঘন্টা ১৪ মিনিটের আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ মহারাজ। সামান্য ধন্যবাদ ডিরেক্টর রায়ান কুগলার, আপনার ভূমিকায় অভিনয় করা চ্যাডউইক বোজম্যান, মূল অ্যান্টাগনিস্ট মাইকেল বি জর্ডান, পার্শ্বচরিত্রে লুপিতা নিয়োঙ্গো, ফরেস্ট হুইটেকার, ডেনিয়েল কালুইয়া আর অবশ্যই অবশ্যই মার্টিন ফ্রিম্যানের প্রাপ্য। কী দারুণ মুভিটাই না সাজিয়েছেন আপনারা। হ্যাটস অফ!
হে সম্পদশালী,
ওয়াকান্ডার খনিতে ওই ভাইব্রেনিয়ামের প্রাচুর্যের কারণেই আপনার সম্পদের পরিমাণ নেহায়েৎ কম নয়। সাকল্যে ৯০.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক আপনি ব্ল্যাক প্যান্থার, যেখানে আয়রন ম্যান বা টনি স্টার্কের মোট সম্পদ ১২.৪ বিলিয়ন। ডিসি কমিকসের সবচেয়ে সম্পদশালী সুপারহিরো ব্যাটম্যান বা ব্রুস ওয়েনের সম্পদও তারচে’ ঢের কম- ৯.২ বিলিয়ন। জাস্টিস লিগে ব্যারি যখন ব্যাটম্যান ব্রুস ওয়েনের সুপারপাওয়ার কী তা জানতে চায়, “আই অ্যাম রিচ”, বলে ব্রুসের ঔদ্ধত্যপূর্ণ উত্তরটা সে সময় হাততালি কুড়োলেও এখন শুধুমাত্র আপনার কারণেই সেটিকে বেশ মামুলি মনে হচ্ছে। ওয়াকান্ডার মাটিতে যে পরিমাণ ভাইব্রেনিয়ামের উপস্থিতি, তার মোট অর্থমূল্য পুরো বিশ্বের জিডিপি-র চেয়েও বেশি হয়ে যাবে। তবে প্রাচুর্য থাকলেও আপনি যে হৃদয়ের সম্পদেও কম যান না, সেটাও মুভিতে বারেবারে প্রমাণিত।
হে বিজয়ী বীর,
একজন সুযোগ্য নেতা, পরাক্রমশালী যোদ্ধাকে ওয়াকান্ডার রাজা হিসেবে পেয়ে শুধু ওয়াকান্ডাবাসীই না, পুরো পৃথিবীই আজ নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর। কেনো হবে না বলুন? আমরা তো জানিই, সেই ২০০৮ থেকে যাত্রা শুরু করা মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের আজতক মুক্তি পাওয়া বিভিন্ন মুভিতেই নানা পরিস্থিতিতে ওয়াকান্ডা রাজ্যের রেফারেন্স আমরা টের পেয়েছি, গোচরে বা অগোচরে। ক্যাপ্টেনের (আমেরিকা) দুর্ভেদ্য ঢালটা যে শক্তিশালী বিরল ধাতু ভাইব্রেনিয়াম দিয়ে তৈরি তা কি আমরা জানি না? সিভিল ওয়্যারের শেষে ফেলে আসার কারণে ক্যাপ্টেনকে ঢালহীন সর্দাররূপে চিন্তা করে আমাদের হৃদয় যখন ব্যথিত, তখন ইনফিনিটি ওয়্যারের ট্রেইলারে আপনার বলিষ্ঠ কণ্ঠে “গিভ দিজ ম্যান আ শিল্ড” উক্তিতে আমরা পুনরায় সাহস ফিরে পাই। অ্যাভেঞ্জারসের আকাশযানটির পেছনেও যে আপনার এবং ওয়াকান্ডা ডিজাইন গ্রুপের নিবিড় ভূমিকা রয়েছে, তারও রেফারেন্স কিন্তু আমরা পেয়েছি।
হে রাজাধিরাজ,
যে ওয়াকান্ডাকে এতকাল তৃতীয় বিশ্বের দেশের অবগুণ্ঠনের আড়ালে রেখেছিলেন তাতে আমরা মনে মনে আপনাকে আমাদেরই একজন ভেবে পুলকিত হতাম। এখন এই ‘টেকনোলজিকাল মার্ভেল’ ওয়াকান্ডার প্রযুক্তিকে বিশ্বমানবতার কল্যাণে উন্মুক্ত করে দেয়ার গণদাবিতে আপনি সম্মত হলে আমরা যারপরনাই কৃতার্থ হই। মুভির মূল গল্পের সাথে এই দাবির সম্পর্ক গভীর। যদিও উন্মুক্ত করবেন নাকি করবেন না সে সিদ্ধান্তখানা আপনার নেয়া হয়েই গিয়েছে। স্পয়লার দেয়াটা সমীচিন হবে না বিধায় নিজেকে সংবরণ করলাম।
সাধারণ অনেক পাঠকের মতো আপনিও প্রশ্ন করতে পারেন, ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়্যারেও তো আপনাকে দেখা গিয়েছিলো, তবে কেনো আজ এই মানপত্র। গুস্তাখি মাফ ইয়োর হাইনেস, একটু মনে করিয়ে দিতে চাই- তখন আপনি ব্ল্যাক প্যান্থার ঠিকই, তবে অফিশিয়ালি রাজ্যাভিষেক ঘটেনি। তখনও আপনি প্রিন্স অব ওয়াকান্ডা। টি-চাকার মৃত্যুর পর ওয়াকান্ডা’র আকাশে যখন বেদনার কালো ছায়া। সবার মনে জিজ্ঞাসা- কে তাদের আশা দেবে, কে দেবে ভরসা। ঠিক তখনই মনকে শক্ত করে শক্ত হাতে সালতানাত সামলানোর ভার তুলে নিলেন। আর এবার চোখের সামনে আপনার সিংহাসনপ্রাপ্তি দেখার পর আপনার উদ্দেশ্যে দু’কলম না লিখলে বড়ই না-ইনসাফি হয়ে যায় জাঁহাপনা।
হে মহান অতিথি,
শত ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে আপনি আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছেন। বসন্তের আকাশে-বাতাসে আজ খুশির কলতান। আমাদের মন আজ আবেগে উদ্বেল। শুধু আমরাই কেনো। পুরো বিশ্বের অনেকেই তো। আর তাইতো মার্ভেলের মুভির ইতিহাসে আগাম টিকিট বিক্রির পরিমাণের বিবেচনায় ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ ভেঙে দিয়েছে আগের সকল রেকর্ড। অবশ্য ইতিহাস তৈরি করা তো আপনার জন্য নতুন কিছু নয়। সুপারহিরো মুভি কিংবা কমিকস যেকোনো ইতিহাস আমলে নিলেও তো আপনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরো। এই অনন্য ইতিহাস আর কারো পক্ষে তৈরি সম্ভব নয়।
হে প্রযুক্তির আশীর্বাদধন্য,
আপনার দেশ ওয়াকান্ডার কথা আর কী বা বলবো। ঝরনার ধারে আপনার অভিষেকের মুহূর্ত আর টপ ভিউ গুলো দেখার পর বারবার মন ছুটে যেতে চায় ওই দেশে। যদিও জানি সে তো প্রায় পুরোটাই গ্রাফিক্সের খেল। তারপরও এমন সুন্দর, প্রায় সত্যিকার কল্পরাজ্য তৈরির সাফল্য তো এটাই। আর ওয়াকান্ডার প্রযুক্তির কথা আর কি-ই বা বলবো। কী সেই অত্যাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, কী তার ম্যাগনেটিক ট্রেনের চেয়েও অনেক অনেক আধুনিক পরিবহনব্যবস্থা, সর্বাধুনিকের চেয়েও বেশি অ্যাডভান্সড যোগাযোগব্যবস্থা, অস্ত্র, রণতরী, পোশাক… বলিহারি যাই।
হে আপনজন,
যেমনটা একটু আগেই বললাম, তৃতীয় বিশ্বের দেশের প্রতিনিধি হিসেবেই বলুন কিংবা আপনার গায়ের চামড়া বলুন, সবদিক দিয়েই আপনি আমাদের অনেকটা কাছের। আর কাছের মানুষের কাছেই তো দুঃখের কথা শেয়ার করা যায়। এই দেখুন না একজন কট্টর ডিসি ফ্যান হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত মার্ভেল মুভি উপভোগ করে যাচ্ছি। মনে বড় আশা, একবার তো তারা ভয়াবহভাবে পা হড়কাবে। একবার তো একটু সুযোগ দেবে সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সটায় তালগোল পাকানোয়। তাতে ডিসি হয়তো একটা মোক্ষম সুযোগ পেলেও পেয়ে যাবে। কিন্তু না। পা তো হড়কায়ই না। উল্টো ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্স হতাশায় ডোবায় আরো। আর এবার এই ব্ল্যাক প্যান্থার দিয়ে তো আমি আশ্চর্যের চূড়ান্তে। তবে টু বি ভেরি অনেস্ট, আপনার ব্ল্যাক প্যান্থার দেখে আসলেও মনে হয়নি মার্ভেল মুভি দেখছি। মার্ভেল মুভি হয়েও গড়পড়তা মার্ভেল মুভির থেকে আলাদা। হিউমার আছে, কিন্তু সেগুলোর টাইমিং বেশ সুখকর। আরোপিত নয়। মুভিতে প্রায় খুঁতহীন ভালো প্লট। আর এই প্রথম এমন একজন মার্ভেল সুপারহিরো পেলাম যিনি আসলে জানেন তিনি কী চান। কী তার উদ্দেশ্য। অনেককেই তো দেখলাম ক্লাইমেক্সের আগ পর্যন্ত কনফিউজডই থেকে যান।
হে গুণী,
হাই-বাজেট সুপারহিরো মুভির সিজিআই কতোটা ভালো তা নিয়ে কথা বলা মানে জায়গা অপচয়। ব্ল্যাক প্যান্থারের কাস্টিংও দুর্দান্ত। তা নিয়েও কিছু বলার নেই। কিন্তু অ্যাকশন সিনের কথা বলা অবশ্যই দরকার। একটা তো ম্যাট্রিক্স-এর মনে দাগ কেটে যাওয়া অ্যাকশন সিকোয়েন্সকে মনে করিয়ে দেয়। না না পাঠক, ছাদের সেই অ্যাক্রোবেটিক সিনটির কথা বলছি না। কোনটা সেটা হলে গিয়ে রাজার মুভি দেখলেই বুঝবেন। আর হ্যাঁ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক স্কোরের কথাও বলতে হবে। থর র্যাগনারকের ভালো মিউজিকের ধারাবাহিকতা ভালোভাবেই অব্যাহত রয়েছে ব্ল্যাক প্যান্থার-এ।
হে মহানুভব,
পৃথিবীরক্ষার বৃহৎ স্বার্থেই আপনাকে এখন অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়। এই ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে আমাদের মাঝে এসে আপনি যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন তা আমরা আজীবন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবো। একজন কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরোকে আমেরিকানরা, থুক্কু বিশ্ববাসী কীভাবে মেনে নেবে তা এই ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ দিয়েই প্রমাণ করা দরকার ছিলো। আপনাকে অভিনন্দন। দুনিয়াজুড়ে বেশিরভাগ দর্শক ইতিবাচকভাবেই নিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে আপনি যেহেতু মহানুভব, একটি কথা এ অবসরে বললে নিশ্চয়ই মাইন্ড করবেন না। আপনার সিংহাসনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আসা এরিক কিলমংগারকে (মাইকেল বি জর্ডান) কিন্তু রাজা হিসেবে আপনার চেয়ে একটু স্মার্টই মনে হচ্ছিলো এক এক সময়। এরিক-এর চরিত্রটাও দেখুন। এই প্রথমবারের মতো মনে হয় কোনো একটা সুপারহিরো মুভির ভিলেইন ক্যারেক্টারের ফিলোসফি আমার মনে ধরেছে। কারণ হয়তো তিনি তেমন এলিয়েনেটিক ক্যারেক্টার নন যার লক্ষ্য পৃথিবী ধ্বংস করে দেয়া। এরিক চায় ওয়াকান্ডার সিংহাসনে বসতে। তবে তার জন্য বেশ শক্ত যুক্তি রয়েছে তার। আর সেই যুক্তি শুনে আমারও মনে হয়েছে যে যুক্তিতে উনি ওয়াকান্ডার তখতে বসতে চান তা অবশ্যই ভেবে দেখার মতো। সারাজীবন তিনি আমেরিকায় বড় হয়েছেন। দেখেছেন তার চামড়ার কমিউনিটি কতোটা বঞ্চিত। তিনি তো ওয়াকান্ডার যে আসল শক্তি, সেই ভাইব্রেনিয়াম আর টেকনোলজিকাল অ্যাডভান্সমেন্ট ব্যবহার করে বাইরের বিশ্বের কাছে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাতে চাইবেনই। এই নিয়েই দ্বন্দ্ব। পাঠক, এ থেকে আবার ভাববেন না কাহিনী বলা শেষ। ইয়োর হাইনেসের ব্যক্তিত্ব, শক্তি, ক্ষমতার সাথে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার অনেককিছু শুধুমাত্র মুভিটা দেখলেই বোঝা যাবে। তবে আবারো ক্ষমা করবেন ইয়োর ম্যাজেস্টি। প্রত্যেক সুপারহিরো মুভিতে একজন ব্যাডঅ্যাস ক্যারেক্টার থাকতে হয়। সেটার খেতাবটাও আপনাকে দেয়া যাচ্ছে না। সেটাও আপনার নয়, জেনারেল ওকোয়ি (ডানাই গারিরা) চরিত্রের প্রাপ্য। তবে রাজা তো রাজাই। আপনার তুলনা আপনি নিজেই।
মুভি শেষের ‘বাকি’ কথা না হয় বাকিই থেকে যাক। আশা করি, আপনাকে হলে গিয়েই দেখবেন দর্শকরা। আমরা জানি, ইনফিনিটি ওয়্যারের মধ্য দিয়ে আপনি আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। তবে এককভাবে আরো ক’বার আপনাকে দেখার শখ রয়েই গেলো। দীর্ঘজীবী হোন প্রিয় মহারাজ। শুভেচ্ছা। ওয়াকান্ডা ফর এভার! বাংলাদেশ ফর এভার।