আজ থেকে চল্লিশ বছরেরও বেশি আগে সত্যাজিত রায় নিজের এক গল্পে এন্ড্রয়েডের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই এন্ড্রয়েড অবশ্য এখনকার দিনের অপারেটিং সিস্টেম নয় বরং যে রোবট মানুষের মতো দেখতে সেটির উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি এই আলাপ তুলেছিলেন। যদি কেউ অনুকূলে সত্যজিতের দূরদৃষ্টির উদাহরণ খোঁজেন তবে ভুল করবেন, বরং সত্যজিতের দর্শনের সম্যক পরিচয় পাওয়া যায় বিখ্যাত সেই গল্পের প্লটে আর উপস্থাপনায়।
প্রথাগত সায়েন্স ফিকশন গল্পের মতো দূর ভবিষ্যত কিংবা গ্রহান্তরে বা পোস্ট এপোকেলিপটিক পরিবেশে না, বরং আমাদের চেনা আটপৌরে পরিবেশে ভবিষ্যতের আবহ তৈরি করেন। আর তাই সত্যজিতের গল্প কল্পবিজ্ঞানের চেয়েও বেশি হয়ে উঠে দর্শন।
যে দর্শন বলে যে, প্রযুক্তি দ্রুত গতিতে বাড়লেও মানুষের বিবর্তনের গতি অতি ধীর। আর তাই এই টানাপোড়েনে তৈরি হয় নতুন সংকট। হোমো স্যাপিয়েন্সের হাতে আগুন থেকে কৃত্রিম রোবটের সময়তক এই সংকটের মূল বিষয়বস্তু এক হলেও কেবল প্রকরণটাই ভিন্ন।
কথা হচ্ছে অনুকূল নামক গল্পটা নিয়ে। এন্ড্রয়েড তথা মানুষের মত দেখতে রোবট চাকর নিয়ে। রোবট-মানুষের সম্পর্ক নিয়ে, নতুন যুগের সমস্যা নিয়ে। যেটি আবারো আলোচনায় আসলো সুজয় ঘোষের সুনির্মিত শর্টফিল্ম অনুকূলের কল্যানে।
সুজয় মনে করেন এটি সত্যজিতের সবচেয়ে ‘মাল্টি-লেয়ার্ড’ গল্প, যাকে বোঝার জন্য বহুবছর অপেক্ষা করেছেন তিনি।
কিন্তু কেন? সত্যজিতের এই গল্পতো আমরা বেশিরভাগই ছোটবেলাতেই পড়েছি, তবু কেন এটি বুঝতে সুজয়ের এতো দিন লাগলো?
এটিই ‘মাল্টি লেয়ারের’ আসল কথা।
প্রথমেই সুজয়ের ফিল্ম ফর্ম নিয়ে কথা বলা যাক। জটিল মনস্তত্ব আর ঘোরলাগা কাহিনীকে ফুটিয়ে তুলতে তিনি প্রায় পুরো কাহিনীটি উপস্থাপন করেন ডার্ক লাইটে। হিন্দির প্রফেসর নিকুঞ্জ (নামটা খুব খেয়াল করে, নিকুঞ্জ মানে বাগান আর এই আপাতমস্তক রুচিশীল ভদ্রলোককে বেশীরভাগ সময়েই সুবাস ছড়াতে দেখা গেলেও ভেতরের সাপটিও একসময় বেরিয়ে আসবে বলে আমরা দেখি। তবে সুশীল সমাজের মতো সেটিও কামড়ায় খুব সংগোপনে) আধুনিক রোবো-চাকর অনুকূলকে কিনে আনেন এবং শহরের বাড়িটিও বেশ ছিমছাম, যেন এক ‘নিকুঞ্জ’। তবে সেখানে সূর্যের আলো নেই, যদিও পুরনো দিনের কাঠির বাড়ি, তবে নিকুঞ্জের এক ধরনের একাকী জীবনের প্রতীক সেই পরিবেশ।
এমনকি বাড়িতে ঢোকার সময় তিনি বলেন যে, অনুকূল আজ পর্যন্ত বাড়িটি কেবল আমার ছিলো, আজ থেকে আমাদের। প্রচুর বই পড়া, সংগীতে আগ্রহী, আর্টের সমঝদার, এককথায় একজন ‘রুচিশীল’ মানুষের একাকিত্বের ব্যাপারটা বোঝা যায়। আবার এইরকম মানুষ ‘ঝামেলা’ পছন্দ করেননা বলে মানুষ সঙ্গীর থেকে রোবট পছন্দ করেন, ‘ঝামেলাহীন’ রোবট তার জন্য আদর্শ সঙ্গী।
অন্যদিকে পুঁজিবাদী মালিকদের জন্যও অনুকূলরা আদর্শ। অনুকূল ঘুমায় না, ক্লান্ত হয় না, বেতন বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করে না। সাদা, কালো ডোরাকাটা পোষাক, যেমনটা কয়েদিরা পড়ে, সেটিও ইঙ্গিত দেয় যে, অনুকূল এমনকী বন্দীত্ব নিয়েও মাথা ঘামায় না।
এইখানে সুজয় ঘোষ যেন চার্লি চ্যাপলিনের মর্ডান টাইমসের কথা মনে করিয়ে দেন। যেমনটা কমিক চরিত্র খাটমাল মনে করিয়ে দেন ফ্রিটজ লাংয়ের মেট্রোপলিসের কথা। সেই সময়ে মেশিন আর মানুষের লড়াইয়ের কথা। অনেকটা জন হেনরির স্টাইলে খাটমাল বলে উঠেন ‘ রোবট চাকর নয়, মানুষ চাকর চাই, রোবটমুক্ত বাংলা চাই।’
কিন্তু হেনরি বা লাং তো কমিকাল ছিলেন না, খাটমাল কমিকাল হয়ে উঠলেন না কেন? উত্তরটা লুকিয়ে আছে সমাজতত্ত্বের দর্শনে। প্রযুক্তির উন্নতিতে বাঁধা দিয়ে সেটিকে আটকানো না, বরং মানুষের উপকারেই তার স্বার্থকতা। আর তাই মানুষ বনাম মেশিনের লড়াইয়ের রোমান্টিকতা বর্জন করে আরো বেশি বাস্তব এপ্রোচ জরুরি এইটা বোঝাতেই খাটমালকে কমিকাল দেখানো। সত্যজিতের এইটা খুবই প্রিয় টেকনিক ( উদাহরণ হীরক রাজার দেশে)।
কিন্তু তাহলে নিকুঞ্জের ভাই রতনের বেলায় কি হবে? হতে পারে রতন মাতাল, বদমেজাজী, কিন্তু ১৫ বছরের চাকরিটা তো সে একটা রোবটের জন্যই খোয়ালো। তার কি রাগ হবে না?
ভালো ফিল্মের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনরকম বাহুল্য না থাকা। আর আপাত বাহুল্য দৃশ্যই আদতে দারুন গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়। যেমনটা রতনের মূত্র ত্যাগের দৃশ্য।
এই জৈবিক ব্যাপারগুলো ( আইরনিকালি মানবজীবনের বাহুল্য কাজ মনে হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ) মানুষের সাথে রোবটের পার্থক্য করে। তাই টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে রতন মানুষসুলভ ‘স্মার্টনেস’ দিয়ে অনুকূলকে ঘায়েল করে।
তবে লুটিয়ে পড়া অনুকূলের চোখের কোনে জমা পানি দিয়ে (জৈবিক ব্যাপার) পরিচালক ইঙ্গিত দেন যে, অনুকূল ক্রমে ‘মানুষ’ হয়ে উঠছে।
ইস্ত্রির আঘাতে অনুকুলকে ঘায়েল করার আগে পরিচালক অবশ্য রতনকে দিয়ে জরুরি আরেকটা দার্শনিক ইঙ্গিত দেন। রতন বলে উঠে, তোমরা রোবটরা মানুষের তৈরি, কিন্তু একসময় তোমরাই মানূষের চেয়ে স্মার্ট হয়ে উঠো, তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করো।
ধর্ম বা ঈশ্বর কনসেপ্টের সাথে মেলে কি?
ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয় নিকুঞ্জ আর অনুকূলের মহাভারত বিষয়ক আলাপে। নীলকন্ঠী বা বিষ হজম করেও শিবের মরণ হয় না, কারণ সে দেবতা। দেবতাদের মরণ নেই। নেইভ অনুকুল অবাক হয়ে ভাবে তারও তো মৃত্যু নেই, তবে কি সেও …?!
ব্যাপারটা ব্লাস্ফেমি হয়ে যাচ্ছে, তাই আমরাও নিকুঞ্জের মতো বলে ফেলি, বাদ দাও, এটা ভিন্ন ব্যাপার।
আচ্ছা ঈশ্বর না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু নীতিবোধ? সত্যপরায়নতা?
এইখানে চলে আসে সিনেমার ক্লাইমেক্স। মানুষ নিকুঞ্জ, রোবট অনুকূলকে বোঝান যে সত্য মিথ্যা ব্যাপারটা আপেক্ষিক, ধর্মের জন্য, কর্তব্যর জন্য, ফ্যাসাদ এড়ানোর জন্য মিথ্যা বলাটা তো পাপ নয়ই, সেটা উচিত কাজ। আহা! মানুষের চিরন্তন দার্শনিক দ্বন্দ্ব।
এই ক্ষেত্রে লাখো লাখো বছর ধরে চলে আসা পুরাণ আর ধর্মগ্রন্থের মতো নিকুঞ্জও বলেন, এটা নির্ভর করবে মানুষের বিবেক, যা কিনা কেবল মানুষেরই আছে! বা অন্তত এতোদিন তাই ভাবা হতো।
এরপরে শর্টফিল্মের চরিত্রের সাথে সাযুজ্য রেখে দেখা যায় দ্রুত পরিসমাপ্তির দিকে যাচ্ছে কাহিনী। অনুকূল চাকর হতে পারে, কিন্তু তাকে মারধর করলেও সেও ইলেক্ট্রিক শক দেয়ার অধিকার রাখে বলে আগেই দেখা গেছে। তবে তাকে পছন্দ না করা রতন সেটি মানতে রাজি না।
তবে মাতাল, বদমেজাজী রতনের ভাগ্যকাশে বৃহস্পতি দেখা যায়। তার কৃপন কাকার সমস্ত সম্পদের মালিক হয় সে। অন্য ভাতিজা নিকুঞ্জ কানাকড়িও পায় না।
এদিকে নিকুঞ্জ চাকরিছাড়া হয়। তার বদলে নিয়োগ হয় ‘স্মার্ট’ একজন শিক্ষক। বলাই বাহুল্য, সেটি একটি রোবট।
এই দুই খবর যেদিন আসে সেই ঝড়ের দিনে (উভয়ার্থে) রতন নিকুঞ্জের বাড়িতে আসে। হতাশ নিকুঞ্জ তখনও রতনের সাথে স্বাভাবিক আচরন করেন, কিন্তু রতন কোনভাবেই দমে না, অনুকূলকে খেপাতে থাকে।
এইসময়েই নিপাট ভদ্রলোক, ‘বিবেকবান’ নিকুঞ্জের মনে ঝিলিক দিয়ে উঠে এক সম্ভাবনা। মুখে রতনকে ধমক দিলেও কার্যত তাকে অনুকুলের মুখোমুখি করে দিয়ে অন্যদিকে চলে যান।
বাইরে প্রচণ্ড জোরে চমকানো বাজের আওয়াজে ঘরের ভেতরেও রতনের বিশালবপুটি লুটিয়ে পড়ে। উত্যক্ত করতে থাকা রতনকে এক ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলে অনুকূল।
ডাক্তার জানায় মৃত্যুর কারন ম্যাসিভ হার্ট এটাক। উকিল জানায়, কিপ্টে চাচার কোটি কোটি টাকার একমাত্র উত্তরাধিকার এখন নিকুঞ্জ।
মূহুর্তের জন্য ‘বিবেক’ হারানো নিকুঞ্জকে নিজের বুকে টোকা দিয়ে চোখ টিপ দিয়ে অনুকূল আশ্বস্ত করে যে, তার কাজটি ‘সত্য’ হয়েছে। ‘ধর্মত’ তার কোন পাপ হয়নি।
ধারণা করা হয় ছোটগল্প লেখার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণা ছিলো ফরাসি সাহিত্যিক মোঁপাসা তবে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন যে রবীন্দ্রনাথ এই ধারার কুতুব মিনার গড়ে তোলেন গীতিকাব্যর রস মিশিয়ে। ছোটগল্পের টানটান উত্তেজনার সাথে গীতিকাব্য মিশিয়ে এমনই এক অনবদ্য সৃষ্টি হয় যে রবীন্দ্রনাথের তাবত সৃষ্টির মধ্যে ছোটগল্পই হয়ে উঠে সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
আলী সাহেব নিজেও কম যান না, যেমন কম যাননা রবীন্দ্রনাথের আরেক স্নেহধন্য সত্যজিত রায়। মাপা শব্দে বিশদ ক্যানভাসের এই শিল্পীর মুন্সিয়ানা আরো বেশী অনবদ্য হয়ে উঠে তার সৃষ্টি শিশুসাহিত্যর আদলে গড়া বলে। অথচ বিষয়বস্তুর পরিধি সুগভীর।
সত্যজিতের বড় পরিচয় হিসেবে অনেকেই চলচিত্র নির্মাণকে ধরেন। এহেন দাবি কেবল এই প্রমাণ করে যে, তিনি সত্যিকারের সব্যসাচী। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছিলেন শিল্পের রাজসভায় সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য চলচিত্রই একদিন রাজমুকুট পড়বে। তাই সত্যজিতের ফিল্মমেকার হওয়াটা রবীন্দ্রনাথ-আলীর ধারাবাহিকতাই।
সেই সত্যজিতের কাহিনীকে সামান্য একটু পরিবর্তন করে দুর্দান্ত একটা শর্টফিল্ম বানিয়ে সুজয় ঘোষ ইঙ্গিত দিলেন যে, ব্যাটনটা তিনি বইতে পারবেন।
পুরো চলচ্চিত্রটি দেখুন: