পলাশীর যুদ্ধের মর্মস্পর্শী গল্প তো সবারই কমবেশি জানা আছে। দুইশ বছরের তিক্ততার এই কোম্পানির শাসন আমাদের বঞ্চিত করেছে আরও এক পাওনা থেকে। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন-বিলেতে শিল্পবিপ্লব-আমাদের জমিতে নীল চাষ আর আজ হারিয়ে যাওয়া মসলিনের গল্প–সব একই সুতোয় গাঁথা। আজও আমরা হারিয়ে খুঁজছি মসলিনকে। আর হারিয়ে ফেলার দ্বায়ে দায়ী এই উপনিবেশ আমলের শাসন। তাদের আমলেই সুনাম যেমন কুড়িয়েছে তেমন গুঁড়িয়েও দিয়েছে আমাদের এই ঐতিহ্য।
কাগজে কলমে মসলিনের এক প্রকার এখনো আমাদের বস্ত্র-পরিধানের প্রথম তালিকাতেই থাকে। নাম তার জামদানী। তবে তার সাথে কি তুলনা চলে সেই প্রাচীন কালের মসলিনের? এদেশে ব্যবসার ধান্দায় ইউরোপীয় কোন কুঠি বাকি রেখেছিল মসলিন রপ্তানি করতে? সেকারনেই কিনা ১৮ শতকের ইউরোপীয় চিত্রকলায় দেখা মিলত মসলিনের মত মিহি পোশাকের রমণীর বসন!!
মসলিনের যথাযথ প্রচারণার দ্বায় যেন কাঁধে তুলে নিয়েছিল সেসময়ের মুঘল শাসকরা। তাদের রাজ দরবারেই সরবারহ হত কয়েক প্রকার মসলিন। ভিনদেশে পাঠানো রাজ-উপটোকৌন তালিকাতেও প্রাধান্য পেত এই মসলিন। হবারই তো কথা। যে কাপড় কিনা সেঁধিয়ে ফেলা যায় আস্ত একটা রিং এর ভেতর!! তাই বিশেষ কিছুর অবস্থান আর অন্য কোন কিছু নিতেই পারে না।
সীমানা শুধু এই মুঘল রাজ্যে নয়, সুদূর আর্মেনিয়া-চীন-গ্রীস মসলিনের গপ্পো খুঁজে পাওয়া যাবে সর্বত্র। দিকে দিকে সুনাম কুড়োত আমাদের মেঘনা- ব্রহ্মপুত্র-শীতলক্ষ্যার পাড়ের ফুটি কার্পাস তুলোর সুতোয় বোনা এই মসলিন।
মসলিন নিয়ে স্তুতি অথবা আক্ষেপের বিরাম নেই। কোনটাই শেষ করার অবকাশ পাওয়া যাবে না, গল্পে অথবা লেখনীতে। তবুও হাল ধরেছেন কেউ কেউ। এগিয়ে এসেছে সরকার। ২০১৪ থেকে দৃক বেঙ্গল মসলিন এর সহায়তায় চলছে গবেষণা। সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয় অথবা তুলা বোর্ড সবার সহায়তায় কাজ করছে বিশাল এক দল। উদ্দেশ্য? হারিয়ে যাওয়া কার্পাস তুলা ফিরিয়ে আনা। আবারো যেন বাংলা উদ্ভাসিত হয় মসলিনের আলোয়।
এই প্রয়াসেই মসলিনের আদ্যোপান্ত নিয়ে নির্মিত হয়েছে তথ্যচিত্র, লিজেন্ড অব দ্য লুম। পরিচালনায় টিনাইনএফএক্স। মনোমুগ্ধকর এই তথ্যচিত্রে রয়েছে মসলিনের আদি ইতিহাস, কার্পাস বা ফুটি তুলার গল্প আর হারিয়ে যাওয়ার নির্মমতা। গতকাল জাতীয় জাদুঘরে কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ছিল এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। শুরুতে কিছুটা হাস্যরস আর এরপর মসলিন নিয়ে পরিকল্পনার ভবিষ্যতের আশাবাদের আলোর ছটায় শেষ করেন তার বক্তব্য। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সারা জাকের, শম্পা রেজা ও তৌকির আহমেদ। আরো ছিলেন দৃকের প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম যিনি গুরুত্বপূর্ণ এই গবেষণার অন্যতম কর্ণধার।
এখনো আড়ং এর মত প্রতিষ্ঠান তাদের একান্ত প্রয়াসে মসলিন নির্মাণের তাতীদের সাথে কাজ করে। গ্রাহকদের কাছে পৌছানোর চেষ্টা করে প্রিয় কাপড়ের এই পরিধেয় নিয়ে। সরকারী উদ্যোগে রুপগঞ্জে স্থাপন করা হয়েছে জামদানী পল্লী। বেশ হৈ চৈ করেই প্রায় নিয়মিত বিরতিতে আয়োজিত হচ্ছে জামদানি মেলা। তবে এখনো রয়ে গেছে আসল সেই কার্পাস ফুটি তুলার আক্ষেপ।
২০১৬ সালে বেশ বড় পরিসরে আয়োজন করা হয়েছিল মসলিন প্রদর্শনীর। সেখানে সাজানো হয়েছিল নানা দেশ থেকে সংগৃহীত মসলিনের নমুনা দিয়ে। সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছিল বুননের গল্প, তাতীদের গল্প। এরপর বেড়িয়েছে বই ও কমিকস। তারই ধারাবাহিকতায় আজ প্রদর্শীত হল এই তথ্যচিত্রটি। একটুখানি আশার আলো আজও রয়ে গেল, হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার।
ছবিঃ দৃক