ঢাকাঃ যে শহর থাকে ফাঁকা

ধরুন আপনি আছেন ধানমন্ডি বা মোহাম্মদপুর, কিংবা মিরপুর। সেখান থেকে যাবেন শাহবাগ। পৌঁছে গেলেন আধা ঘণ্টার মধ্যেই। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে মনে হলো, এবার একটু বসুন্ধরা সিটিতে যাওয়া যাক। লাগল মিনিট পনের। সেখানে খানিকক্ষণ থেকে মনে হলো, বসুন্ধরার সাথে যমুনা ফিউচার পার্কের একটা তুলনা করবেন। সেখানেও পৌঁছে গেলেন মিনিট চল্লিশের মধ্যে।

জ্যামবিহীন স্বস্তির ঢাকা শহরের দেখা পাওয়া যায় বছরে দুই বার- দুই ঈদে

যেন এক স্বপ্নের ঢাকা। বাস্তবে, জ্যামাক্রান্ত ঢাকায় এক দিনে দুই জায়গায় যাওয়ার সংকল্প করাটাই বেশ সাহসের ব্যাপার। আর সে পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হয় রীতিমতো সংগ্রাম। অথচ এই জ্যামটা সরিয়ে নিলে ঢাকা কিন্তু এমন বড় কোনো শহর নয়, যার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে এক-দেড় ঘণ্টার বেশি লাগতে পারে। ব্যাপারটা টের পাওয়া যায় প্রতি বছরে দুবার করে- দুই ঈদে।

ঢাকা শহরের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। তবে এই বিশাল জনসংখ্যার একটা বড় অংশই ঠিক ঢাকার স্থায়ী অধিবাসী নয়। ঢাকার জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশটাই এ শহরে কেবল এক প্রজন্ম ধরে বাস করছে। অল্প কিছু অংশ আছে দুই-তিন প্রজন্ম ধরে। আর আছে ঢাকাইয়া কুট্টিরা। ঈদ এলে এক প্রজন্মের অধিবাসীরা তো শহর ছাড়েই, শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ির পথ ধরে দুই-তিন প্রজন্মের অধিবাসীদেরও একটা অংশ।

ঢাকার রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি আনন্দ হয় উঠতি বয়সের ছেলেছোকড়াদের

ফলাফল, দেড় কোটি মানুষের চাপ নিতে অভ্যস্ত শহরটা হঠাৎ করেই জনশূন্যতার স্বস্তিতে ভরে ওঠে। ট্রাফিক জ্যাম হয়ে ওঠে বিলাসিতা। ফাঁকা রাস্তায় মহানন্দে শহর জুড়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। আর তাতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ হয় উঠতি বয়সের ছেলেছোকরাদের।

স্বস্তির ঢাকায় যা একটু অস্বস্তি, তা এই উঠতি বয়সীরাই নিজ দায়িত্বে ছড়াতে থাকে। বন্ধুরা মিলে ফাঁকা সড়কগুলোতে দুরন্ত গতিতে মোটরসাইকেল ছুটাতে থাকে। যাদের বন্ধুমহলে একটা-দুটো গাড়ি আছে, তাদের তো পোয়াবারো। রোজকার ঢাকায় গাড়ি ছুটানোর তেমন সুবিধে না হলেও, ঈদের ঢাকা সে বাবদে স্বর্গ। যাকে বলে মাস্তির চূড়ান্ত। এদের গতির ঝড়ে, ঈদের ছুটিতে বিভিন্ন হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে যে সব জুনিয়র ডাক্তাররা মুখ কালো করে মাছি মারেন, মাঝেমধ্যে তারা কাজের খোরাকও পেয়ে যান।

এই উঠতি বয়সীদের চেয়ে খানিকটা বেশি বয়সী যারা, ঈদের সময় মোটরসাইকেল আর গাড়ি করে জনশূন্য ঢাকার নানা প্রান্তে ছুটে বেড়ানোটা তাদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে, অন্য সময়ে জ্যামের কারণে তাদেরকেই বেশি সংগ্রাম করতে হয় বলে, জ্যামহীনতার স্বস্তি একটু বেশিই আপ্লুত করে। তবে খানিকটা বয়স হয়ে যাওয়ায়, তাদের মাস্তিও খানিকটা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই তারা অযাচিত গতির ঝড় তুলে স্বস্তিহীন শহরে খুব বেশি অস্বস্তি উৎপাদন করে না। বরং শহরের বিভিন্ন প্রান্তের যে সামাজিকীকরণগুলো বছর জুড়ে মুলতবি থাকে, এই সুযোগে তারা সোৎসাহে সেগুলো সেরে ফেলেন।

একটু বেশি বয়সীদের মধ্যেও ঈদের সময় মোটরসাইকেল আর গাড়ি করে জনশূন্য ঢাকার নানা প্রান্তে ছুটে বেড়ানোটা বেশ জনপ্রিয়

ঈদের ঢাকার এই স্বস্তিদায়ক রূপের সদ্ব্যবহার করে আরেকটি দল- বিবাহ-পূর্ব, সদ্য-বিবাহিত ও সম্প্রতি-বিবাহিত জুটিগুলো। অস্বস্তিপূর্ণ এই শহরে প্রেম করাটাও স্বস্তিদায়ক নয়। অন্যদিকে ঈদের ঢাকা একা ঘোরার জন্যই চমৎকার, সেই ঘোরাঘুরিতে জীবনসঙ্গী সঙ্গে থাকলেতো আনন্দ বেড়ে যায় বহুগুণ। কাজেই যে জুটিগুলো ঈদে থেকে যায় ঢাকায়, তারা এ সুযোগ হেলায় হারাবে কেন? তারা সুযোগে প্রচুর প্রেম করে নেয়।

বড়-বুড়োরা অবশ্য, বড় এবং বুড়ো হওয়ার কারণে, ঈদের ঢাকার ফাঁকা আনন্দে খুব বেশি অংশগ্রহণ করেন না। কিন্তু যখন পুরো ঢাকা জুড়েই একটা স্বস্তির আবহ ছড়িয়ে থাকে, সেই সঙ্গে শহরের বাতাসে ছড়িয়ে থাকে উৎসবের রেণু, তারাও থাকেন বেশ ফুরফুরে মেজাজে।

পুরান ঢাকায় ঈদের মাস্তিতে রংটা যেন একটু বেশিই লাগে

সেই সঙ্গে শহর জুড়ে ঈদের নানা আয়োজন তো থাকেই। অবশ্য ঈদের মৌসুমী আয়োজনগুলো বাদ দিলেও, ঢাকায় আনন্দ অনুষঙ্গ তো কম নেই। এক পুরান ঢাকায় খেতে যাওয়ার পরিকল্পনা আঁটতে বসলেই, কোনটা ছেড়ে কোনটা চেখে দেখতে মাস্তি বেশি হবে, তাই নিয়ে বচসায় এক বেলা কাটিয়ে দেয়া যায়। শহরের কোথায় গিয়ে হাওয়া খাওয়াটা বেশি মাস্তির হবে, সেই আলোচনাতেও কম মতভেদ হয় না। এমনকি কোন্দল হয় চা খাওয়া নিয়েও। ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় আছে একাধিক খ্যাতিমান চা-বানানে-ওয়ালা। ঈদের মাস্তির অংশ হিসেবে তাদের মধ্যে কার চা নির্বাচিত হবে, তা নিয়েও সমর্থকদের মধ্যে চলে গলাবাজি।

সব মিলিয়ে, গ্রামে ফেরার মহাযজ্ঞে অংশ না নেয়ায় ঢাকার মানুষদের যে খুব ক্ষতিবৃদ্ধি হয়, তেমনটা একদমই নয়। ঈদের সময়ে, ঢাকা ফাঁকা হয়ে গেলে, স্বস্তির সেই ঢাকায় তাদের মাস্তিটাও কম হয় না। আর যদি মাস্তিটা হয় পুরান ঢাকায়, উৎসব-প্রিয় ঢাকাইয়া কুট্টিদের হাতে পরে তাতে নিশ্চিতভাবে রংটা একটু বেশিই লাগে।