করোনাভাইরাস: ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্থ করে মারাত্মক ভাবে

গত বছরের শেষ দিকে বিশ্ব জানতে পারে করোনাভাইরাস সম্পর্কে। এই ভাইরাসের সংক্রমণের উপসর্গগুলো খুবই সাধারণ জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট হলেও এর পরিণতি হতে পারে প্রাণঘাতী। এই ভাইরাস শ্বাসনালী ও ফুসফুসকে সরাসরি আক্রমণ করে। যাবতীয় সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকেই।

সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে, এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠার পর অনেকের ফুসফুস গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমে যেতে পারে ২০-৩০ শতাংশ, এমনটাই জানা গেছে স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি প্রতিবেদন থেকে। তবে এখনও এ বিষয়ে খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি কারণ এখনও এই বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

নভেল করোনাভাইরাস, যার আরেক নাম সার্স-কোভ-২ নিশ্বাসের সাথে মানুষের দেহে প্রবেশ করে থাকে। আশেপাশে কেউ হাঁচি বা কাশি দিলে বা ভাইরাস সংক্রমিত কোনো জায়গায় হাত দেয়ার পর ওই হাত দিয়ে মুখ, চোখ বা নাক ঘষলেও ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

শুরুতে গলা, শ্বাসনালী এবং ফুসফুসে আঘাত করে এবং বিস্তার লাভ করে। পরে শরীরের বিভিন্ন অংশে ভাইরাস ছড়িয়ে দেয় এবং অন্যান্য কোষগুলো আক্রান্ত করতে শুরু করে। এই শুরুর সময় তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।

প্রথম সংক্রমণের পাঁচ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এই সময়কাল একেক জনের ক্ষেত্রে এই সময়সীমা একেক রকম হতে পারে।

বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, সংক্রমিতদের মধ্যে ৮০% কোনো বিশেষ পরিচর্যা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠেন। আক্রান্ত ছয় জনের মধ্যে এক জনের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

রয়েল অস্ট্রেলিয়ান কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস-এর ‘প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট’ প্রফ জন উইলসন একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমকে জানান, কোভিড ১৯ এর গুরুতর সংক্রমন গুলোর মধ্যে নিউমোনিয়া হওয়ার মাত্রা বেশি থাকে।

তিনি জানান, করোনার সংক্রমন কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে রয়েছেন যাদের ভাইরাস সংক্রমন হয় কিন্তু কোনো উপসর্গ থাকে না তাদের মধ্যে।

দ্বিতীয় ভাগে যারা আছেন তাদের হালকা জ্বর, কাশি ও কফ, মাথাব্যথা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে লক্ষণ প্রখর না হলেও তাদের কাছ থেকে অন্যরা গুরুতর আক্রান্ত হতে পারেন বলে জানান অস্ট্রেলিয়ান ওই অধ্যাপক।

সর্বশেষ ভাগে রয়েছেন যাদের সংক্রমনের ফলে নিউমনিয়া এবং অন্যান্য লক্ষণ তীব্র হতে পারে।

ডব্লিউএইচও এর মতে বয়স্ক এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা রয়েছে যাদের তাদের জন্য কোভিড-১৯ বেশি ক্ষতিকর। বিশেষ করে হৃদযন্ত্রের অথবা ফুসফুসের সমস্যা যাদের রয়েছে তাদের ঝুঁকি সবথেকে বেশি।

উইলসন জানান, করোনাভাইরাসের কারণে নিউমনিয়া হলে তা ফুসফুসের কোনো একটি অংশ নয় বরং পুরো ফুসফুসকে সংক্রমিত করে, আর এই কারণে সাধারন নিউমনিয়ার তুলনায় এর ফলাফল বেশি গুরুতর হয়ে থাকে।

তিনি জানান, এই ভাইরাসটি ফুসফুসের কোষগুলোকে দুর্বল করে ফেলে, যদিও এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব। তবে যাদের হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা বা ডায়বেটিকস-এর মতো অন্যান্য শারীরিক সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এটি গুরুতর রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে যাদের বয়স ৬৫-এর উপর, ধুমপায়ী এবং ১২ মাস বা তার থেকে কম বয়সী শিশুদের জন্য এই ভাইরাস হতে পারে মৃত্যুর কারণ।

তিনি জানান, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার পরও বয়স বাড়ার সঙ্গে করোনার কারণে নিউমনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। কারণ বয়সের সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে।

একটি স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, কোভিড-১৯ ছাড়া অন্যান্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে নিউমোনিয়া হলেও খুব সামান্য মাত্রায় ফুসফুসের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি থাকে। এক জন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ফুসফুসে প্রায় ৪৮ কোটি অ্যালভিওলাই থাকে। ভাইরাসের সংক্রমণে অ্যালভিওলাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে যা সুস্থ হওয়ার পর সেরে উঠতে পারে। তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে তা কিছুটা কঠিন। যারা ধুমপায়ী তাদের শ্বাসনালী ও ফুসফুস তুলনমূলক দুর্বল হওয়ায় ক্ষতির মাত্রা বেশি হয়। তাদের কোভিড-১৯ সংক্রমনের ঝুঁকিও তুলনামূলক বেশি থাকে অধুমপায়ীদের তুলনায়।

চায়নার মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ধূমপায়ীদের কোভিড-১৯ সংক্রমনের ফলে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি একজন অধূমপায়ীর থেকে ১৪% বেশি থাকে। মানুষের শ্বাসনালী ও ফুসফুসে সুক্ষ শিরার মতো সিলিয়া থাকে। এই শিরাগুলো শ্বাসনালী ও ফুসফুসের ধূলিকণা, শ্লেষ্মা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রন করে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করা। কিন্তু ধূমপায়ীদের এই সিলিয়াগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অকেজো হয়ে যায়। আর সে কারণেই ফুসফুসের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অনেকে সিগারেটের বদলে ভেইপ করে থাকেন। তবে ভেইপিংয়ের ফলেও ফুসফুস ও শ্বাসনালী একই রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।