নবমীর দিন। সকাল সকাল যে খবর সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, তার রেশ কয়েকদিনে যাবে না নিশ্চিত। ঢাকার বাইরে, পুজো মণ্ডপের মোটামুটি কাছে; দেড়শ বছরের পুরোনো এক হাসপাতালে বসে এক তরুণ সংবাদকর্মী শুনছেন আইয়ুব বাচ্চুর গান। সেলফোনে নয়, মণ্ডপের মাইকে আজ কলকাতার বা হিন্দি আইটেম গানের বদলে টানা বেজে চলছে বাচ্চুর গান। এদিকে বেকায়দায় থাকলেও তার একটা লেখা আজ দরকার, এখনি দরকার।
ফেসবুকে আজ একটাই বিষয় : আজ সকালে চলে গেছেন আইয়ুব বাচ্চু।
দুদিন আগেই অভিমানী বেপরোয়া কবি রুদ্রর জন্মদিন ছিল। যাকে স্মরণ করতে আমরা বারবারই বলে যাই- চলে যাও্য়া মানে প্রস্থান নয়। একদিন বাদেই, সকাল বেলা আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর সংবাদ মগজে মেনে নিয়ে যখন এই উৎসবের দিনে চারদিকে তার গান বেজে চলে; তখন আসলেই মনে হয়- চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। অন্তত, একজন আইয়ুব বাচ্চুর ক্ষেত্রে তো কখনোই নয়।
সংস্কৃতি থেকে জীবন, খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার, কৈশোর থেকে পড়ন্ত যৌবন; সবখানে একটা মানুষ স্থান সহজে নিতে পারেন না। ফিতে প্যাচ খেয়ে যাওয়া ক্যাসেট চালানো টু-ইন-ওয়ান থেকে ওয়াকম্যান কিংবা সিডি প্লেয়ার কিংবা পেন্টিয়াম ওয়ান-টু-থ্রি কম্পিউটারে উইনঅ্যাম্প মিউজিক প্লেয়ার কিংবা সেলফোনে নতুন নতুন মেমোরি কার্ড…কোথায় ছিলেন না তিনি! আর যদি হিসেব করেন কনসার্টের কথা, মাত্র দুটো দিন আগেও মাতিয়েছেন হাজারো দর্শকের জোয়ার। ফেসবুকে এখনো ঝলমল করছে সেই সদ্যস্মৃতি, শুধু কেমন করে যেন সেখান থেকে তিনি সাবেক হয়ে গেলেন আজ সকালে।
আশি কিংবা নব্বই দশকের ছেলেমেয়েদের জীবনে স্কুল পালানো, সেবার বই পড়া, প্রথম প্রেমের ছাদ-বারান্দা-রাস্তার মোড়ের চকিত চোখাচোখি হয়ে যাওয়া তুখোড় তরুণকালের মতোই এক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অনুসঙ্গ আইয়ুব বাচ্চু। স্মৃতিকে যখন হাতড়ে দেখতে হবে বা হঠাৎ কোনো জমায়েত, হোক তা সাগরপারে কিংবা পাহাড় কিংবা হাওরের পূর্ণিমা রাতে, তখন দেখবেন কেন যেন রাতের আবেগী সময়টা সব বন্ধুরা মিলে হাজারোবার শোনা-গাওয়া-বাজানো ‘সে তারা ভরা রাতে’ই গাওয়া হয়ে উঠবে। বাচ্চু চলে গেছেন, তাতে কী? ‘আমি পারিনি বোঝাতে’ গেয়ে আপনার যে বোঝাতে না পারার আজন্ম আকুতি কিংবা আফসোস, তা বাচ্চুর মতো করে আর কেউ বলতে পারেননি আর বলতে তো পারবেনও না! কিংবা এই গানটাও তো একবার শুনে দেখা যায়, যেখানে কোনো এক ‘জয়ন্ত’কে নিয়ে তার শুভকামনা—
সত্তরের দশকের বিখ্যাত মেটাল, বলতে গেলে সেরা মেটাল ব্যান্ড লেড জ্যাপেলিনের ড্রামার জন হেনরি বনহ্যামের আকস্মিক মৃত্যুর পর কয়েকদিন বেশ জল্পনা-কল্পনা চলছিল, কে হবেন লেড জ্যাপেলিনের পরবর্তী ড্রামার। মাস কয়েক বাদে লেড জ্যাপেলিন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়—লেড জ্যাপেলিনের এখানেই সমাপ্তি। বেহিসেবি, পাগলাটে বনহ্যামকে ছাড়া হয়ত তার টিমমেটরা দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেননি কোনোভাবে। আইয়ুব বাচ্চুকে ছাড়া আমরা কিভাবে ভাবব এলআরবিকে, বলা কঠিন। কনসার্টে বারবার সেই একই মানুষটির ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’ গেয়ে ওঠাটা তো কোনোভাবে রিপ্লেস করা যাচ্ছে না, যাবেও না, আর কারো কাছ থেকে শুনতেও চাই না এই ভীষণ আর একান্তভাবে যাপন করে চলা আবেগগুলো। তাই বারবার বাচ্চুর গানগুলোই বাজুক, বাজতে থাকুক।
মৃত্যু এড়াবার কিছু নয়। তবে আইয়ুব বাচ্চুর মতো এমন নায়কোচিত প্রস্থান ক’জনের হয়? সবসময়ের অনবদ্য পারফরমেন্সের মতো, ব্যক্তিজীবন থেকে তার বিদায় নেওয়াটাও হলো তেমনই। ঠিক যেন সেরা গিটারিস্টের ট্র্যাকখানা খতম হতেই গিটার থেকে ইলেকট্রিক কর্ডটা আস্তে করে খুলে ব্যাকেস্টেজের দিকে চলে যাওয়া। এদিকে পূরণ হবে না জেনেও জমায়েত জনতার উচ্ছাসের অনুরোধ, ওয়ান মোর, ওয়ান মোর…
শ্রোতাদের তুমুল হাততালি এখনো থামেনি কমেনি এবি, শুনতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই!
ফটোঃ টুটুল নেছার