ম্যাচের বয়স তখন ৮৫ মিনিট। কোনো দলই গোল পায়নি। তবে সুযোগ বেশি মিলেছিল সবুজ জার্সি পরা দলটিরই। সেই দলটিই তখন প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের কাছে একটা থ্রো-ইন পেয়েছে। আপাত নিরীহ মনে হওয়া থ্রো-ইনটাই হয়ে উঠল ভয়ংকর। লম্বা থ্রো-ইন থেকে গোলমুখে সৃষ্টি হলো জটলা। বল চলে গেল সেকেন্ড পোস্টের খুব কাছে। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল সবুজ দলটার একজন ডিফেন্ডার। কৈশোরের সারল্য মাখা ছেলেটার নাম তপু বর্মন। ছুটে এসে মাথা ছুঁইয়ে বল জড়িয়ে দিল জালে।
গোল…
পাঁচ বছর ধরে বুকে পুষে রাখা পরাজয়ের জ্বালা মেটাবার রসদ পেল বাংলাদেশ ফুটবল দল। ২০১৩ সাফে পাকিস্তানের বিপক্ষের সেই ম্যাচের আগেই অবশ্য গ্রুপ পর্ব থেকে বাংলাদেশের বিদায় মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে জিততে হতো বড় ব্যবধানে। ৩০ মিনিটে এগিয়েও গিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তান খেলায় ফিরে আসে মিনিট ছয়েকের মধ্যেই। আর অতিরিক্ত সময়ে গোল করে হারিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছিল হতাশার বেলুন।
মাঝে ২০১৫ সাফে সে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া যায়নি। কারণ সেবার পাকিস্তান অংশগ্রহণই করেনি। পাকিস্তানের ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচন নিয়ে কী যেন সমস্যা হয়েছিল। তার জেরে আদালতের নিষেধাজ্ঞার কবলে পরেছিল ওদের ফেডারেশন। অংশগ্রহণ করলে প্রতিশোধ নেয়া যেতই, তেমনটাও অবশ্য জোর করে বলা যায় না। কারণ তখন যে বাংলাদেশের ফুটবলে চলছে গ্রহের ফের।
পরের বছরের অক্টোবরে পুঁচকে ভুটানের কাছে তিন গোল খেয়ে হেরে ব্যর্থতার ষোল কলা পূর্ণ হয়। ছেলেদের ফুটবল এক রকম নির্বাসনেই চলে যায়। বিপরীতে মেয়েরা ফুটবলে উপহার দিতে থাকে একের পর এক সাফল্য। আমাদের যে ছেলেদেরও একটা ফুটবল দল আছে, তারা একবার দক্ষিণ এশিয়ার সেরাও হয়েছিল, সে সব তো আমরা ভুলেই বসেছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই সে দলের নতুন কোচ আসার খবর আমরা রাখিই-নি।
হঠাৎ সে দলের খবর জানা গেল, যেদিন তারা এশিয়ান গেমস ফুটবলে আগামী বিশ্বকাপের আয়োজক কাতারকে হারিয়ে দিল। এর আগের ম্যাচেই তারা থাইল্যান্ডের সাথে জিততে বসেছিল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর গোলে জয়ের সুবাস মাখতে মাখতে ৮০ মিনিটে গোল খেয়ে ড্র করে বসে। তারপরও অবশ্য এশিয়ান গেমসে ইতিহাসের সেরা সাফল্য আসে। প্রথম বারের মতো টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ।
সব মিলিয়ে দেড় দশক পরে যখন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফিরেছে বাংলাদেশে, তখন বাংলাদেশ ফুটবল দল ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। তবে সমস্যা একটাই। স্ট্রাইকাররা গোল করতে পারছে না। স্ট্রাইকারদের এই ব্যর্থতা ঘোচানোর দায়িত্ব যেন নিয়েছে ওই ডিফেন্ডার তপু বর্মন। প্রথম ম্যাচে ভুটানকে দেয়া দুই গোলের একটি ছিল পেনাল্টি থেকে। সেই পেনাল্টিটাও নিয়েছিল এই তপুই।
পাকিস্তানের বিপক্ষে জ্বালা জুড়ানোর ম্যাচে দল যখন একটা গোলের জন্য হাপিত্যেশ করে মরছে, তখনো উদ্ধার হলো তপুর মাথার ছোঁয়ানো ওই গোল দিয়েই। গোল মুখে লাফাতে থাকা বলে মাথা ছুঁইয়েই ভোঁ দৌড় দিল তপু। এক ঝটকায় খুলে নিল গায়ের জার্সি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ভরা দর্শক তখন উন্মাতাল। ‘জাতশত্রু’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়ের সুবাস যে সবাই মাখতে শুরু করেছে। সাথে প্রতিশোধের মধুর তৃপ্তির আশ্বাস।
জার্সি খোলা বুনো উল্লাসেও যেন মন ভরল ফুটবলারদের। ওয়ালি ফয়সাল হাত-মুখ নেড়ে নেড়ে তপুকে কী যেন বললেন। তারপর তপুর সামনে কয়েকজন ফুটবলার সারি বেঁধে দাঁড়ালেন। খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পরা কিশোর তপু দুহাতে রাইফেল চালানোর ভঙ্গি করল। কাটা কলাগাছের মতো করে পরে গেলেন সামনে দাঁড়ানো ফুটবলার কজন।
হ্যাঁ। এবার সবার মন ভরল। মুখে হাসি ঝুলিয়ে তালি দিতে দিতে নিজেদের অর্ধে রওনা দিলেন ফুটবলাররা। বাকি পাঁচ মিনিটে কোনো অঘটনও ঘটল না। প্রতিশোধের সাথে সাথে সাফের সেমিফাইনালেও এক পা দিয়ে রাখল বাংলাদেশ। শেষ ম্যাচে নেপালের সাথে জিতলে তো বটেই, ড্র করলেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনাল খেলা নিশ্চিত। হারলেও গোল গড়ে সম্ভাবনা কম নয়, বরং বেশি-ই।
তবে এসব হিসেব-নিকেশ গৌণ। এ জয়ের মুখ্য মাহাত্ম্য ওই উদযাপনে। সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নে এক গাল হেসে তপু কেবল বলেছে, ওই উদযাপনের বুদ্ধি তাকে ওয়ালি ভাই দিয়েছে। মানে-টানে তেমন কিছু জানায়নি। তবে সব মানে কী আর ব্যাখ্যা করে বলতে হয়! পাকিস্তানের বিপক্ষে গোল দিয়ে অমন গুলি করার মানে বুঝতে কী আইনস্টাইন হওয়া লাগে! মুক্তিযুদ্ধ তো মাত্রই সাতচল্লিশ বছর আগের ঘটনা…