পৃথিবীর ইতিহাসে দারুণ এক মুক্তির যুদ্ধের ইতিহাস লিখলেও মাত্র দুই বছর পেরোতো না পেরোতেই সেবছর বাংলাদেশিদের মুখোমুখি হতে হয় এক চরম বিপর্যয়ের, দুর্ভিক্ষের। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশটাতে কতশত মানুষ স্রেফ মরে গেল। কেউ বলে, অতো মানুষ মরেনি, মরেছে আরো কম। কেউ বলে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির চক্করে ঘটেছে সব। অবশ্য সত্য নিয়ে লুকোছাপা আর নিজেদের দোষ ঢাকা তো এই জনপদে নতুন না! তেমনি নতুন কিছু না, এই ঘটনায় যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের সামাজিক অবস্থান। গবেষকরা বলেন, যারা দরিদ্র, যাদের জমিজমা ছিলো না তারাই দুর্ভিক্ষের আঘাত পেয়েছে সবচেয়ে বেশি সয়েছে, অথচ লুটেরা আর ধনীরা সেসময়ে দিব্যি ফুর্তি করে গেছে। যাকগে, এই লড়াকু জাতির বারবার লড়াই করেও হেরে যাওয়ার কাহিনি তো নতুন না! যেমনি নতুন নয় পাশের ভ্রাতৃপ্রতীম বন্ধুরাষ্ট্রের দরিদ্র মানুষের লড়াইও। সেবছরই উত্তরখণ্ডের নারীরা গাছ বাঁচানোর জন্য গাছের গা জড়িয়ে কুঠারের আঘাত নেয় নিজেদের শরীরে।
চিপকো আন্দোলনের ঐতিহ্যটা পুরোনো হলেও সে বছর এই আন্দোলনের ঢেউ পুরো বিশ্বকেই নাড়া দেয়। দরিদ্র নারীদের সঙ্গে প্রকৃতি আর বৃক্ষের যে বড্ড মিল! আর তাই তাদেরই যেন সেগুলো বাঁচানোর দায়। অবশ্য দুনিয়ার অন্যপ্রান্তে, মার্কিন মুলুকের প্যট্রিসিয়া ক্যাম্পবেল হের্স্ট কোন অর্থেই দরিদ্র ছিলেন না, তিনি ছিলেন সে দেশের অন্যতম ধনী, উইলিয়াম র্যান্ডল হের্স্টের নাতি।
হলুদ সাংবাদিকতার রমরমা ব্যবসা করে হের্ষ্ট বিপুল অর্থকড়ি আর প্রভাব-প্রতিপত্তি কামাই করেন। তবে সে বছর প্যাট্রিসিয়াকে কিডন্যাপ করে সিম্বায়োনেজ লিবারেশন আর্মি। আজকের দিনে ধনীর দুলালদের যে জঙ্গি হয়ে পড়ার রোগ সেটা সমন্ধে যাদের জানা তারা এই দলের অতিবিপ্লবী কাণ্ডকীর্তি কিছুটা হলেও বুঝবেন। কিডন্যাপড হওয়ার পর প্যাট্রিসিয়া ওদের একজন হয়ে গেল, একত্রে ডাকাতি করে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে লাগলো আর নিজের বাপ-দাদাকে গালি দিলো বুর্জোয়া শুকরছানা বলে (এই কথাটা অবশ্য মিথ্যা না)। যাই হোক, উগ্রবাদের খেলায় এইসব ধনীদের কিছু না হলেও, বেশ কিছু গরিবের মৃত্যু ঘটে। এখানেও তার ব্যত্যয় হলো না। তেমনি ঐ বছরই মার্কিন এক সেনা কর্মকর্তা মাত্র শখানেক নিরাপরাধ ‘ফইন্নি’ ভিয়েতনামি মেরেছেন প্রমাণের পরেও মহামান্য আদালতের কাছে ‘নির্দোষ’ আখ্যা পান। তবে শেষরক্ষা হয় না খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডমুন্ডের কর্তা প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের। ওয়াটারগেট কেলেংকারিতে ফেঁসে গিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হয় রিপাবলিকান নিক্সনের।
অবশ্য তার অবস্থা ইথিওপিয়ার হাইলে সেলেসির চেয়ে ভালো ছিল। নিজেদের সোলেমান নবির বংশধর দাবি করা বংশের ৭০০ বছরের শাসনও শেষ হয় সেদেশে। ওদিকে চিলিতে জনগণের নেতা আয়েন্দেকে উৎখাত করে ক্ষমতা পোক্ত করতে থাকে সামরিক শাসক পিনোশে।
শিকাগো স্কুলের অর্থনীতিবিদেরা সে দেশটিকে বানায় অর্থনীতির পরীক্ষাগার। মিল্টন ফ্রিডম্যানের চেলাদের নিওক্লাসিক্যালের চাপে পিষ্ট হয় গোটা দুনিয়ার দরিদ্র মানুষ।
চিলির নিকটবর্তী আর্জেন্টিনাতেও স্বৈরশাসক জেনারেল পেরন অত্যাচার করতে করতে সেসময় নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন আর সে বছর এই দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী ইসাবেলা।
এইরকম অদ্ভূতুড়ে সময়ে লেখক হিসেবে আবির্ভূত হন স্টিফেন কিং , প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ক্যারি’।
কট্টর ক্যাথলিক ইতালির পার্লামেন্টেও ভোটাভুটির মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদকে বৈধতা দেওয়া হয়। এর আগে আজীবনের বিবাহ বন্ধনের চূড়ান্ত সব সমস্যা মিটমাট হতো ছুরি, বিষ, গলা টিপে দেওয়ার মতো উপায়ে। তবে এইসব উপায়ে না গিয়েও এই বছরই ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার প্রধান হয়ে যান ব্রাজিলের হোয়াও হাভেলাঞ্জ। ফুটবলটাকে বিনোদন, জনতার উচ্ছাসের বিষয়ের বদলে পুরোদস্তুর পণ্য বানানোর ব্রত নেওয়া এই লোক ফিফাকে ধীরে ধীরে এক কর্পোরেট দৈত্যে পরিণত করেন।
ফুটবলের সঙ্গে হাভেলাঞ্জের এই সম্পর্ক নিয়ে গাদা গাদা বই লেখা হয়েছে, এবং সেগুলোর সবটুকু সরল ফুটবলপ্রেমীদের জন্য সুখকর হবেনা। যদিও সেবার বিশ্ব অপেক্ষা করছিলো একপাল ডাচ যাদুকরের জন্য। হাভেলাঞ্জের তুলনায় তাদের বিপ্লব ছিলো অনেক সুখকর, দৃষ্টিনন্দন। রাইনাস মিশেল নামের এক শিক্ষক, ইয়োহান ক্রুইফ নামের এক ফুটবল বিজ্ঞানী আর তাদের অসামান্য দলটির জয় দেখতে বিশ্বের জনসংখ্যাও প্রথমবারের মতো ছাড়ায় ৪০০ কোটির ঘর। মানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা তখন ৪০০ কোটিরও বেশি।
গেল আসরেই ব্রাজিল চিরতরে জুলে রিমে ট্রফিটি জিতে নেয়ায় ইতালীয় ভাস্কর সিলভিও গাজ্জানিগার ডিজাইন করা নতুন ট্রফিটির জন্য বিশ্বকাপের দশম আসর বসে পশ্চিম জার্মানিতে। নতুন এক ফুটবলের আগমনী বাজে ১৯৭৪ সালের সেই মহা আসরে, যা শুরু হয় ১৩ জুন আর শেষ হয় ২৫ জুলাই। পশ্চিম জার্মানি আর স্পেন নিজেদের মধ্যে ১৯৬৬ সালেই একটা চুক্তি করে নেয় যে, ৭৪ আর ৮২ সালের বিশ্বকাপে নিজেদের স্বাগতিক হবার প্রস্তাব তারা পাল্টাপাল্টি সমর্থন দেবে। তবে ফুটবল মাঠে স্পেন পাল্টাপাল্টি সমর্থনের মাধ্যমে যোগানো সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। সেবারে যে বাছাই পর্ব উতরাতে পারেনি দলটি। তার চেয়েও বিস্ময়কর ছিলো ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া আর রোমানিয়ার বাদ পড়া। সোভিয়েত ইউনিয়নও ছিলো বাদ পড়াদের দলেই, তবে পিছনের কাহিনিটা ভিন্ন। সমাজতান্ত্রিক দেশটি সিআইএর পুতুল অত্যাচারী পিনোশের চিলিতে বাছাইপর্ব খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। যে মাঠে খেলাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো সেই ন্যাশনাল স্টেডিয়াম খেলার কিছুদিন আগেও ব্যবহার করা হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ও ফায়ারিং স্কোয়াডের জায়গা হিসেবে। সোভিয়েতরা না যাওয়াতে নির্দিষ্ট দিনে চিলির খেলোয়াড়রা ফাঁকা পোষ্টে গোলের উৎসব করে।
ইউরোপ থেকে সেবার স্বাগতিক হিসেবে পশ্চিম জার্মানি সরাসরি খেলার সুযোগ পায় আর বাকি আটটি দেশের মধ্যে ছিল বার্লিন ওয়াল দিয়ে ভাগ হওয়া ওপারের দেশ, কমিউনিষ্ট শাসিত পূর্ব জার্মানি। এছাড়াও ল্যাটিন আমেরিকার চারটি, হাইতি, জায়ারে এবং অস্ট্রেলিয়া- এই ১৬টি দেশ মিলে চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলে। অবশ্য ফরম্যাটে একটা পরিবর্তন এনে প্রতি গ্রুপ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া দুইটি দলকে আবার দ্বিতীয় রাউন্ডে দুই ভাগ করে দুই গ্রুপে খেলানো হয়। সেই দুই গ্রুপের চ্যাম্পিয়নরা খেলে ফাইনালে আর রানার-আপেরা তৃতীয়-চতুর্থ স্থান নির্ধারণী ম্যাচে।
তবে লটারির মাধ্যেমে গ্রুপ নির্ধারিত হওয়ার পরেই দুই জার্মানিজুড়েই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে কারণ দুই দেশই ছিল একই গ্রুপে। ২২ জুনের সেই খেলায় ইয়ুর্গেন স্পারভাসারের গোলে কমিউনিষ্টরাই অবশ্য জিতে যায়, আর স্বাগতিকরা হারে। অবশ্য অস্ট্রেলিয়া আর ফাঁকতালে সুযোগ পাওয়া চিলির সঙ্গে ভালো ফলাফলের জোরে দুই দলই পরের রাউন্ডে যায়। গ্রুপ বি থেকেও ব্রাজিল আর যুগোশ্লাভিয়া সহজেই পরের রাউন্ডে যায়। যদিও ধারে ভারে অনেক দুর্বল হয়ে যাওয়া ব্রাজিল, স্কটল্যান্ড আর যুগোশ্লাভিয়া দুই দলের সঙ্গেই গোলশূন্য ড্র করে। আর জায়ার যেন ছিলো সবার শ্যুটিং প্র্যাকটিসের দল। স্কটল্যান্ড দেয় দুইটা, ব্রাজিল তিনটা, আর স্লাভিকরা বড়ই নির্মমভাবে গুনে গুনে নয়টা! গ্রুপ সি এর চমক ছিলো সুইডেন। তারা উরুগুয়েকে তিন গোলে হারায় আর নেদারল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করে। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আইডিয়ার জন্মদাতা ডাচরা ‘টোটাল’ ফুটবল নামের এক ভিন্ন ধাঁচের খেলা শুরু করে যাতে শতাব্দী প্রাচীন খেলাটার খোলনলচেই পালটে যায়।
ডি গ্রুপ থেকে দুর্বল হাইতির সঙ্গে বেশি গোল দেওয়ার সুবাদে ইতালিকে টপকে পরের রাউন্ডে যায় আর্জেন্টিনা। তবে এই গ্রুপের অপ্রতিরোধ্য দল ছিলো আরেক কমিউনিষ্ট দেশ পোল্যান্ড।
লাটো, জামারাচদের দলটা তিন খেলাতেই জেতে, হাইতির জালে তো ৭ বার বল পাঠায়। ‘ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ বা ডাচ দলের ভ্যংকর সুন্দর রূপটা প্রথম টের পায় আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় রাউন্ডের গ্রুপের প্রথম খেলায় অসহায় ল্যাটিন দলটি চার গোল খায়। নাম ক্লকওয়ার্ক হলে কি হবে, ওদের খেলা যন্ত্রের মতো নয় বরং ছিলো শিল্পের মতো। পুরো দল ছিল যেন বহতা নদী। সবাই একযোগে আক্রমণে যাচ্ছে আবার সবাই মিলেই রক্ষণ সামলাচ্ছে। এ দেখে ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে যেত প্রতিপক্ষ। ক্রুইফ বলতেন, ‘ফুটবলটা পায়ের খেলা হলেও আসলে খেলাটা হয় মাথায়।’ ক্রুইফের কাছে মাঠের সবুজ যেন ছিলো দাবার ছক। সেখানে তিনি নিখুঁতভাবে চাল দিতেন।
অন্য সহযোগীরাও প্রত্যেকে প্রত্যেককে সঙ্গত করতো অর্কেষ্ট্রার মতো। এই কমলা সৌন্দর্য দেখে এক ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক মন্তব্য করে বসেন, ‘ওরা (ডাচরা) গোছানো উপায়ে অগোছালো।’ ব্রাজিলের সাধ্য ছিলো না ওদের ঠেকায়।
নিসকেন্স আর ক্রুইফের দুই গোলে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নেরা হারে। অবশ্য ল্যাটিন সম্মানের লড়াইয়ে বুড়ো জর্জিনহোর দল আর্জেন্টিনাকে হারায় ২-১ গোলে আর রিভেলিনোর গোলে পূর্ব জার্মানিকে হারিয়ে গ্রুপের রানার্স আপ হয়।
জার্মান ডার্বিতে হারলেও ক্রমাগত উন্নতি করতে থাকে পশ্চিম জার্মানি। দ্বিতীয় রাউন্ডের গ্রুপে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা পোল্যান্ডসহ সুইডেন আর যুগোশ্লাভিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে যায় তারা। পোল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় একমাত্র গোলটি দেন আগের আসরে ১০ গোল দেওয়া জার্ড মুলার। একসময় টেক্সটাইল মিলে দৈনিক ১৪ ঘন্টা কাজ করা মুলার জানতেন ফুটবলই তাকে এনে দেবে মুক্তি, আর তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, গোলের সুযোগ হাতছাড়া মানে নিজের এই মুক্তিকে বিপদে ফেলা, সেই ভুল কখনো না করা এই স্ট্রাইকার তাই আশায় ছিলেন ফাইনাল জয়ের। অবশ্য সেবারের সেরা গোলদাতা ছিলেন পোল্যান্ডের খেলোয়াড় লাটো। তার সপ্তম গোলে ব্রাজিলকে হারিয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশটি তৃতীয় হয়, যা এ যাবতকালে তাদের সেরা পারফরম্যান্স।
মিউনিখে হওয়া ফাইনালে মাত্র দুই মিনিটের মাথায় পেনাল্টি গোলে এগিয়ে যায় ডাচরা। আর কমলা সৌন্দর্য ছড়িয়ে একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে।
তবে সেগুলো অটল দেওয়ালের মতো ঠেকিয়ে দেন গোলকিপার সেপ মেয়ার। উলটো খেলার ২৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে সমতা আনেন ব্রেইটনার আর সুযোগসন্ধানী মুলার দলকে এগিয়ে নেন ৪৩ মিনিটে। এরপর বাকিটা আসলে বেকেনবাওয়ারের সঙ্গে নেদারল্যান্ডের খেলা। তাকে বলা হতো কাইজার, অর্থাৎ জার্মান ভাষায় সম্রাট।
তিনি জন্মেছিলেন মিউনিখের এক শ্রমিক পরিবারে, কিন্তু খেলা ছিল রাজসিক। মাঝমাঠ থেকে আক্রমণে যেতেন আগুনের গোলার মতো। আবার তিনি বিপক্ষের আক্রমণও ঠেকাতেন। তাকে ফাঁকি দিয়ে বলতো দূরের কথা, একটা মাছিও জার্মান ডিফেন্স গলতে পারতো না। ফাইনালে ক্রুইফরাও পারেনি। ফলে ১৯৫৪ সালের ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সদের মতো সেই জার্মান যন্ত্রের কাছেই পরাভূত হয় ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ।
যন্ত্রের সামনে আবারও হেরে যায় শিল্প। তবে কাপ না জিততে পারলেও ক্রুইফের দল গোটা দুনিয়ার ফুটবলের জন্য এক বিপ্লবের সূচনা করে। বিপ্লবীদের সব সময় ট্রফির দরকার পড়ে না।