ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের উত্তেজনা কেটে গিয়ে তখন পূর্ববঙ্গের চাষাভুষাদের উপলব্ধির সময়। ভাষা আন্দোলনের পর তখন এদেশে ঘটে গেছে রাজনৈতিক উন্মেষ। পোড় খাওয়া দুই নেতা মাওলানা ভাসানী আর শেরে বাংলা ফজলুল হক মিলে গঠন করলেন যুক্তফ্রন্ট। সাথে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পাকিস্তানের কায়েদে আজমের দল মুসলিম লীগকে গাছে উঠিয়ে দিয়ে পেয়ারা পাকিস্তানকে কাঁচকলা দেখালো বাঙ্গালির সম্মিলিত শক্তি। নির্বাচনে এল বাঙ্গালির বিপুল এক বিজয়। সে এক গৌরবোজ্জ্বল বছর। বেশিদিন ক্ষমতায় না থাকতে পারলেও যুক্তফ্রন্ট সরকার যূথবদ্ধতার শক্তি প্রথমবারের মতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিল পাঞ্জাবি ক্ষমতাসীনেদের।
দুনিয়ার অন্যান্য প্রান্তেও তখন স্বাধীনতা আর স্বপ্ন বাস্তবায়নের সময়। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে কিন্তু এই এক দশক পরেও দুনিয়া জুড়ে তার ক্ষত চিহ্নমান। দারুণ দারুণ সব আবিস্কার হচ্ছে, দারুণ সব ঘটনা ঘটছে। কেউ কেউ জিতছে, কেউ আবার সবটুকু দিয়ে হারছে। কেউ ভাগ্যবান, কেউবা অল্পের জন্য হতাশায় পুড়ছে। কোথাও অন্যায়, কোথাও জনতার জয় হচ্ছে। যুক্তফ্রন্ট বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে না পারলেও চীনে চিয়েং কাইশেক এ বছরে আবারও ক্ষমতা পোক্ত করলেন। ক্ষমতা পাকাপোক্ত হলো প্যারাগুয়ের স্বৈরশাসক জেনারেল স্ট্রোয়েসনারেরও। অবশ্য ব্রাজিলের গেতুলিও ভার্গাস দুর্নীতি আর অপশাসনের প্রতিবাদে জনতার গড়ে ওঠা বিক্ষোভের চাপ সইতে না পেরে দুম করে নিজের বুকে নিজেই গুলি চালিয়ে দিলো।
ওদিকে বাঙ্গালিদের মতোই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ফুটতে থাকা ভিয়েতনামীরা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় দখলদার ফরাসিদের। দিয়েন বিয়েন ফিউর লড়াইয়ে জেনারেল গিয়াপের বাহিনী ফরাসিদের পর্যদুস্ত করে। নেপোলিয়নের খোকাদের পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য করার জন্য আলজেরীয়রাও কোমর বেঁধে লড়াই শুরু করে এই বছরেই। এশিয়ার দেশ লাওসও ফরাসি লুটেরাদের থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়। তবে গুয়াতেমালাতে সাফল্য ধরে রাখে দখলদার মার্কিন কর্পোরেটরা। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির বেনিয়ারা সেদেশের সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট আরবেঞ্জকে উৎখাত করে গোটা দেশটাকেই নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। অবশ্য এইসব রাজনীতি আর যুদ্ধের বাইরে বছরটাতে সৃষ্টি, বিনোদন আর সম্ভাবনাগুলোও ফুটছিল কুড়ি হয়ে। প্রথমবারের মতো চার মিনিটের নিচে এক মাইলের দৌড় শেষ করেন রজার ব্যানিষ্টার, এর ঠিক ২৩ দিন বাদে প্রথম নারী হিসেবে ডায়ানে লেদার ৫ মিনিটের নিচে শেষ করেন এক মাইল দৌড়।
ফিল্ম গেঁড়েরা সেভেন সামুরাই আর লা স্ট্রাডার মধ্যে কোনটা সেরা তা বাছতে বললে মুশকিলে পড়বেন, আর এই বছরেই এই দুই ক্লাসিকের জন্ম। যেমনটা সাহিত্যে উইলিয়াম গোল্ডিঙ-এর লর্ড অফ দ্য ফ্লাইস।
মেরিলিন মনরো দ্বিতীয় বিয়ে করে কতশত পুরুষের স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলেন, আবার মার্কিন কায়দায় সুন্দরী প্রতিযোগিতা টিভিতে দেখানো শুরু হলো এই বছরেই। অবশ্য মার্কিনিদের এসব ছ্যাবলামি আর অন্য দেশ লুটপাট করে খাইখাইয়ের বিবরণ দিলেও ব্যাপারটা একপেশে হয়ে যায়, ওই মুল্লুকের বিজ্ঞানে অবদানটাও স্বীকার করতে হয়। সেই বছর পূর্ব ইউরোপের তাড়া খাওয়া এক আশকেনাজী ইহুদি পরিবারের সন্তান ইয়োনাস সাল্ক পোলিও রোগের টিকা আবিস্কার করেন। এক প্রাণঘাতী অভিশাপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র যোগান মানবজাতিকে। অবশ্য মানুষ, ইতর প্রাণি বিশেষ। সে একদিকে যেমন বানায় আরেকদিকে ধ্বংসও করে। বিজ্ঞানীরা এই বছরেই উদযাপন করেন মারণাস্ত্র হাইড্রোজেন বোমার আবিস্কারও। আরেকজন অসম্ভব প্রতিভাবান বিজ্ঞানী এলান টুরিং এই বছর আত্মহত্যা করেন। আজকে আমরা যে কম্পিউটার দিয়ে এতো বড়াই করছি, সেটির উন্নয়নে প্রধান ভূমিকাটাই ছিলো এই বৃটিশ গণিতবিদের। যদিও সমপ্রেমী হবার দায়ে সামাজিক চাপে মাত্র ৪২ বছর বয়সে আত্মাহুতি দেন এনিগমা ডিকোড করে বৃটেনকে ২য় বিশ্বযুদ্ধ জেতানো এই বিজ্ঞানী।
খেলাধুলার জন্যও বছরটা স্মরনীয়। এই বছর মার্কিন মুলুকে প্রথম স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড ছাপানো শুরু হয়। তবে নতুন দিনের গড়ার ইঙ্গিত দিয়ে এই বছরই গড়ে উঠে দুইটি মহাদেশীয় ফুটবল সংস্থা, এশিয়ান ফুটবল ফেডারেনশন তথা এএফসি এবং ইউরোপীয়ান ফুটবল ফেডারেশন তথা উয়েফার। অবাক ব্যাপার হচ্ছে এএফসি স্থাপিত হয় ম্যানিলাতে ৮ই মে আর এর পরের মাসে, জুনের ১৫ তারিখ জুরিখে স্থাপিত হয় উয়েফা। সংগঠন করার ব্যাপারে এশিয়া এগিয়ে গেলেও ফুটবলে ইউরোপ কেবল উন্নতিই করতে থাকে আর এশিয়া নামের মহাদেশটা পড়েই থাকে তলানিতে। আর সেটির প্রমাণ পাওয়া যায়, এই বছরের আমাদের আলোচ্য আসর, বিশ্বকাপ ১৯৫৪ সালে। জার্মানিতে হওয়া সেই আসর, দুনিয়ার ঘটনাগুলোর মতোই সৃষ্টি, ব্যক্তিগত কৃতিত্ব, আশার কুৎসিত প্রদর্শনী থেকে কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ হয়ে আসে। তবে এক কথায় এই বিশ্বকাপকে বলা যায়, গোলের বিশ্বকাপ।
দুই বিশ্বযুদ্ধেই নিরপেক্ষ ফুলবাবুটি সেজে থাকা সুইজারল্যান্ডের সেই আসর এমন এক রেকর্ড করে যা আর কোনদিন হয়তো ভাঙ্গবে না। সেবার ১৬ই জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত হওয়া এ টুর্নামেন্টে ২৬ খেলায় হয় ১৪০ গোল! অর্থাৎ খেলাপ্রতি ৫ দশমিক ৩৮ গোল! নেপোলিয়ন যদিও বলেছিলেন Impossible n’est pas francaise, অর্থাৎ অসম্ভব শব্দটি ফরাসি ভাষায় নেই, তবে এই রেকর্ড ভাঙ্গা অসম্ভব বলেই রায় দিয়ে দেওয়া যায়। আর এই রেকর্ডের পেছনে একটা বড় অবদান সে সময়ের অবিসংবাদিত সেরা দল হাঙ্গেরির। ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স নামেই পরিচিত অপ্রতিরোধ্য এ দলটি ৫ খেলায় বিপক্ষকে দিয়েছিল ২৭ গোল। অবশ্য পুসকাস, ককসিচ আর হিদেকুটির এই দুর্দান্ত দলটির জন্য দারুণ এই টুর্নামেন্ট আজীবনের আক্ষেপ হয়ে থাকে, অনেকটাই আগের আসরের ব্রাজিল দলটির মতোই।
সেবার টুর্নামেন্টে ১৬টি দল খেলে। স্বাগতিক সুইজারল্যান্ড আর চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের সঙ্গে ১১টি ইউরোপীয় দল, দুটি আমেরিকান আর একটি এশীয় দল। বলে নেওয়া ভালো, মিশর আর তুরস্ক সেবার ইউরোপীয় দল হিসেবে বাছাইপর্বে খেলে। তুরস্ক, আগের বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করলেও এবার বাছাইপর্বে নাটকীয়ভাবে স্পেনকে বিদায় করে মূলপর্বে জায়গা করে নেয়। নাটকীয় শব্দটা ক্লিশে হলেও অন্তত এইস্থলে সেটা যথার্থ। দুই লেগের খেলায় উভয় পক্ষ একটি করে ম্যাচ জেতার পর প্লেঅফের আয়োজন করা হয়। প্লেঅফটা ড্র হলে হয় কয়েন টস! আর সেই নাটকীয় কয়েন টসটা করেন ইতালীয় এক অন্ধ বালক। ওর ছোড়া কয়েন তুরস্কের ভাগ্য খুলে দেয়। মূল টুর্নামেন্টের ফরম্যাটটাও ছিলো অদ্ভুত ধরনের। মোট ১৬ দল চার গ্রুপে খেলবে সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু এই চার দল সবাই সবার সঙ্গে খেলবে না, এদের অর্ধেক বামুন আর অর্ধেক নিচু জাত। মানে, ফিফা টুর্নামেন্টের আগে ভাগ করেছিলো আটটা সিডেড বা বাছাই দল আর বাকি আটটা অবাছাই দল হিসেবে। প্রতি গ্রুপে দল চারটি, দুইটা বাছাই আর দুইটা অবাছাই। প্রত্যেক বাছাই কেবল দুই অবাছাইয়ের সঙ্গে খেলবে আর অবাছাইরা কেবল বাছাইদের সঙ্গে। এর ফলে মোট চারটি করে খেলা হয়েছিলো প্রতি গ্রুপে। শুধু তাই না, খেলা ৯০ মিনিটের মধ্যে ড্র হলে বাড়তি ৩০ মিনিট করে খেলা হয়। তাতেও ফলাফল না হলেই কেবল দুই দলের মধ্যে ১ পয়েন্ট করে ভাগ করে দেওয়া হবে। এখানেই শেষ না, যদি গ্রুপের শীর্ষ দুই দলের পয়েন্ট সমান হয়, তবে টস করে এক আর দুই অবস্থান নির্নয় করার সিদ্ধান্ত হয়, তবে দুই আর তিনের বেলায় টস হবে না, বরং প্লে-অফ খেলার বিধান রাখা হয়েছিলো। এইসব অভূতপূর্ব নিয়মের শেষ এখানেই না, চার গ্রুপ থেকে আটটা কোয়ালিফাই করা দল দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ড খেলে আর সেই দুই গ্রুপ থেকে একটা করে দল ফাইনালে যায়। ব্যাপারটা অভূতপূর্ব না হলেও গল্পের মজাটা কিন্তু অন্য জায়গায়। দ্বিতীয় পর্বের গ্রুপ করা হলো অদ্ভুত এক নিয়মে। প্রথম পর্বের চার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন এক গ্রুপে আর চার রানার-আপ অন্য গ্রুপে। ফিফার বাছাই করা আট দল ছিলো অস্ট্রিয়া, ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইতালি, স্পেন আর উরুগুয়ে। কিন্তু স্পেন তো কোয়ালিফাই-ই করতে পারেনি! তাহলে! ফিফা ঠিক করলো স্পেনের বদলে বিশ্বকাপে আসা তুরস্কই পাবে বাছাই দলের মর্যাদা।
এতোসব কিছুর পরেও লোকে আসলে ভাবছিলো, এই কাপ তো হাঙ্গেরি ভিন্ন অন্য কারো জেতার সুযোগ নেই! ভাববে নাইবা কেন! দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড় বলে বিবেচিত পুসকাস আর সঙ্গে থাকা ককসিচ, হিদেকুটি, চিবরদের নিয়ে দলটাকে ডাকা হতো ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স। আগের অলিম্পিকটা জেতা সারা, বিশ্বকাপের আগে টানা ৩২ ম্যাচে অপরাজিত দলটি আগের বছর ওয়েম্বলিতে ‘ম্যাচ অফ দ্যা সেঞ্চুরিতে’ ইংল্যান্ডকে ৬-৩ গোলে হারিয়ে এসেছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, সমাজতন্ত্রের অধীনে থাকা হাঙ্গেরির এই অদম্য দলটি ১৯৫০ থেকে শুরু করে ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরির গণআন্দোলন শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ৫০টি ম্যাচ খেলে ৪২টিতে জেতে, ৭টিতে ড্র করে আর কেবল একটি খেলাতে হারে। সেই হারটাকে ধরা হয় ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আপসেট হিসেবে। কারণ এই এক হারই ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সদের বিশ্বজয়ীর খেতাব থেকে বঞ্চিত করেছিল। অবশ্য, একটা কথা না বললেই না। ফুটবল র্যাঙ্কিঙ ব্যবস্থা এলে রেটিং সিস্টেমানুসারে দুনিয়াতে এ যাবত যত জাতীয় দল খেলেছে তাদের মধ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চূড়ায় উঠেছিলো ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সরাই, ২২৩০ পয়েন্ট নিয়ে। যার খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছে একটি দলই, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন, অর্থাৎ ১৩ই জুলাই জার্মানি। পয়েন্ট ছিল ২২২৩।
তবে প্রথমবারের মতো সরাসরি টিভিতে প্রচারিত হওয়া বিশ্বকাপে ম্যাগিয়ার্সদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হচ্ছিলো আগেরবারে হতাশায় ডোবা ব্রাজিল দলকে। গতবারের সাদা পোষাক বদলে প্রথমবারের মতো হলুদ গেঞ্জি পড়ে খেলতে আসা দিদি আর জুলিনহোর দল মেক্সিকোকে ৫-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করে। তবে পরেরদিন ফেবারিট হাঙ্গেরি একেবারে ছিবড়ে ফেলে কোরিয়াকে। ককসিচের হ্যাটট্রিকে এশিয়ার সবেধন নীলমণি দলটিকে গুনে গুনে নয় গোল দেয় ম্যাগিয়ার্সরা। অবশ্য গুড়িয়ে দেওয়ার এই খেলায় পুসকাসের দলটি তখন যেন আশরাফ-আতরাফ না মানার প্রতিজ্ঞা করেছিল। যার প্রমাণ মিললো তিনদিন পর। বাসেলের জ্যাকব স্টেডিয়ামে পশ্চিম জার্মানিকে ওরা হারালো ৮-৩ গোলে। যার মধ্যে ৪টা ককসিচের, দুইটা হিদেকুটির।
হাঙ্গেরির প্রভাবেই কিনা ঐ গ্রুপে গোলের যে মচ্ছবটা দেখা গেল সেটা এই ছয় দশক পরেও যে কারো চোখ কপালে তুলে দেবে! তুরস্ক কোরিয়াকে হারায় ৭-০ গোলে আর জার্মানির সঙ্গে প্লে অফে হারে ২-৭ গোলে। অবশ্য সর্বোচ্চ গোলের ম্যাচ ঐগুলোর একটাও ছিলো না, সেটা ছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রিয়া ৭-৫ গোলে হারায় সুইজারল্যান্ডকে। প্রথমার্ধে ফল ছিলো ৫-৪! বিশ্বকাপে এর আগে বা পরে আর কোনদিন এক খেলায় আর এতো গোল হয়নি। এতো গোলের পরেও ঐবার যে খেলাটা সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে রোমাঞ্চকর হওয়ার কথা ছিল সেটাই হয়ে উঠলো বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্ক। খেলা বাদ দিয়ে খেলোয়াড়দের মারামারি এতোটাই জরুরি হয়ে দাঁড়ালো যে বার্ণের ভাঙ্কডর্ফ স্টেডিয়ামের খেলাটিকে আখ্যা দেয়া হয় ‘ব্যাটল অফ বার্ণ’ বলে।
হাঙ্গেরি আর ব্রাজিলের ২৭ জুনের সেই খেলাটিতে ব্রিটিশ রেফারি আর্থার এলিস ৪২টি ফ্রি কিক, দুটি পেনাল্টি, চারটি হলুদ কার্ড আর তিনজনকে লাল কার্ড দেখিয়েও মাঠের মারামারি থামাতে পারেননি। খেলা শেষেও ড্রেসিং রুমে গিয়েও দুই দল উদ্দাম মারপিট করে। রেফারি এলিস খেলা শেষে বলেছিলেন, ‘খেলা শুরুর আগে আমি কি উত্তেজিতই না ছিলাম! ভাবছিলাম এটি হবে আমার দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ খেলা। অথচ এটা ছিল একটা অভিশাপ। অন্য সময় হলে আমাকে হয়তো এতোগুলো লাল কার্ড দিতে হতো যে খেলাটাই বাতিল হয়ে যেতো। আমি শুধু চাইছিলাম খেলাটা যাতে কোনরকমে শেষ হয়।’
হাঙ্গেরির ম্যানেজার গুস্তাগ সেবেস বলেন, ‘এইটা ছিলো স্রেফ একটা বুনো যুদ্ধ। মাঠের খেলায় আমরা ৪-২ গোলে জিতলাম ঠিকই, কিন্ত মাঠের বাইরে থেকেও মারামারি করে আমার গালে চারটা সেলাই লেগেছে!’।
গ্রুপ পর্যায়ে চোট পাওয়াতে এই ম্যাচটা খেলেননি পুসকাস। ককসিচ অবশ্য দুই গোল দিয়েছিলেন। তবে এই যাদুকরের সেমিফাইনালের দুই গোল আসে ৯০ মিনিটের পর। উরুগুয়ের সঙ্গে সেই ম্যাচে জান দিয়ে লড়ে দুই দল ২-২ গোলে ৯০ মিনিট শেষ করে। ককসিচ ১১১ আর ১১৬ মিনিটে দুই গোল দিয়ে দলকে ফাইনালে নিয়ে যান। কিন্তু এসব হ্যাপা সামলাতে গিয়েই কি তবে ম্যগিয়ার্সদের দম শেষ হয়ে গিয়েছিল? সেই আশাতেই হয়তো ছিলো আরেক সেমিফাইনালে অস্ট্রিয়াকে ৬-১ গোলে হারানো পশ্চিম জার্মানি। গ্রুপ পর্যায়ে হাঙ্গেরির কাছে নিদারুণ হেনস্থার পরে জার্মানরা কিন্তু নিজেদের উদ্যম জমিয়ে রেখেছিল। বিশ্ব এই বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো দেখে জার্মানদের নিখুঁত যান্ত্রিক ফুটবল। Die Mannschaft-এর সেই দারুণ লড়াইও উঠে আসে সেলুলয়েডে, অর্ধশতক পরে, দি মিরাকল অব বার্ণ চলচিত্রে।
ম্যাগিয়ার্সদের থামাতে জুলাইয়ের ৪ তারিখে জার্মানদের মিরাকল ছাড়া গতি ছিলো না। আহত, প্রায় এক পায়ে খেলা পুসকাস এদিন মাঠে নেমে, ছয় মিনিটেই দলকে এগিয়ে নেন। এর দুই মিনিট পর চিবর ব্যবধান বাড়িয়ে ২-০ করেন। তবে এরপরেই খেলায় জার্মানরা ফিরে আসা শুরু করলো। ম্যাক্সিমিলিয়ান মরলোক ১০ মিনিটের মাথায় করলেন ২-১ আর ১৮ মিনিটে জার্মান স্ট্রাইকারদের বস বা ‘দি বস’ নামে পরিচিত হেলমুট রাহন আনলেন সমতা। পরের একঘণ্টা কোন গোলের দেখা নেই। খেলা শেষ হওয়ার ঠিক ছয় মিনিট আগে হেলমুট দ্য বস হাঙ্গেরির ডিফেন্স থেকে আসা একটি বল রিসিভ করেন, লান্টোসকে কাটিয়ে গোলার মতো শটে গোলকিপার গ্রোসিকসকে পরাস্ত করে বল জালে জড়িয়ে দিলেন। এর চার মিনিট পর পুসকাসের গোল অফসাইডের অজুহাতে বাতিল হয়। হাঙ্গেরির আর খেলায় ফেরা হয়না। ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সদের সেটাই সারাজীবনের একমাত্র পরাজয়। যে পরাজয়, তাদের বিশ্বকাপ নিতে দিলো না। রাহনের গোলের পর ধারাভাষ্যকার হ্যারিবার্ট জিমারম্যান চিৎকার করে ওঠেন, গোওওওওওওওওওওওল । যুদ্ধে বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত জার্মানির সেটাই যুদ্ধের পর প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। ঐ গোলটা আর ঐ চিৎকারটা গোটা জার্মান জাতিকে আবারও উজ্জীবিত করে তোলে। এরপর থেকে জার্মানরা যখনই পতনের সম্ভাবনা দেখতো, তারা জিমারম্যানের মতোই ফুসফুসের পুরো বাতাস বের করে চিৎকার দিয়ে বলে, গোওওওওওওওওল, গোওওওওওওল! তাই এই দেশের ফুটবল দলটা পরের দশকগুলোতে হয়ে উঠে হার না মানার প্রতিশব্দ। বিশ্বখ্যাত জার্মান পরিচালক রাইনার ভেরনার ফাসিব্যন্দার ২০০৩ সালে নির্মিত দি ম্যারেজ অফ মারিয়া ব্রুইনের সাউন্ডট্র্যাক হিসবে ব্যবহার করেন এই গোলের চিৎকারটিকে। সেখানে বিধ্বস্ত এক রমনী জীবন যুদ্ধে আর টিকে থাকার উপায় না দেখেও বাঁচার স্বপ্ন দেখা ছাড়েনা।
ম্যাগিয়ার্সদের হার তাই দুঃখ দিলেও, দিনশেষে গোলের এই বিশ্বকাপ আশার গল্পই বলে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়। আমাদের এই শিক্ষাই দেয়, অসম্ভব সময়েও, বুক ভরে শ্বাস নিয়ে গোওওওওওওওওল বলে এগিয়ে যাওয়াটাই জীবন।