পুঁজিবাদের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকারতম সময় সেটা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উত্তাল একটি দশকের একদম শেষে এসেই ফেটে গেলো পুঁজিবাদের ফুলে ফেঁপে উঠা বুদবুদটা। শুরু হলো ইতিহাসের ভয়াবহতম এক মন্দা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা দুনিয়া টের পেলো ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর ভয়াবহতা। ১৯২৯ সালের সেই রামধাক্কার মধ্যে দিয়ে শুরু হলো ঘটনাবহুল এক দশক, ত্রিশের দশক। ইউরোপও উত্তাল। অর্থনৈতিক মন্দার সাথে হাত ধরে বেড়ে যাচ্ছে অসহিষ্ণুতা আর ঘেন্নার চাষ (ঠিক এখনকার দিনের মতোই)। ইতালির ইরিপিনিয়ায় ১৯৩০ সালে এক ভূমিকম্পেই প্রাণ হারালো হাজার দেড়েক মানুষ। সে বছর সোভিয়েত ইউনিয়নে, স্টালিনের রাজত্বে আত্মহত্যা করলেন বিপ্লবের কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির প্রতিটি শহরে, প্রতিটি সড়কে প্রতি মুহূর্তে খণ্ড যুদ্ধ করে চলেছে কম্যুনিস্ট আর ফ্যাসিস্টরা। এদিকে এশিয়ায় জাপান হয়ে উঠছে পরাশক্তি। স্বাধীনতার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠছে ভারত, গান্ধী শুরু করেছেন তাঁর সত্যগ্রহ।
এতো কিছুর পরেও সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারের ল্যাটিন আমেরিকা হয়ে উঠলো সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী। না, নিকারাগুয়ায় অগাস্তো সিজার সানদিনোর নেতৃত্বে কৃষি বিদ্রোহ আর তা দমনে মার্কিন অগ্রাসন না। আর্জেন্টিনার স্বৈরশাসক হিপিলিতো ইরিগুয়েনের পতন আর আরেক সামরিক শাসক হোসে ফেলিক্স উরিবিরুর শাসনামল শুরুর কাহিনিও না। গল্পের শুরুটা হয়েছিল উরুগুয়েতে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে সেদেশের রাজধানী মন্টিভিডিওতে।
সে সময়ের অবিসংবাদিত সেরা ফুটবল দল উরুগুয়ে। তবে, অর্থনৈতিক মন্দা আর রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির কারণেই ইউরোপের দেশ ইতালি, সুইডেন, নেদারল্যান্ড, স্পেন আর হাঙ্গেরি প্রথমে আয়োজক হতে চেয়েও পরে নাম প্রত্যাহার করে নিলে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য খানিকটা বাধ্য হয়েই বেছে নেয় উরুগুয়েকে। দেশটি সম্মান পায় ইতিহাসের প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের।
ইউরোপ থেকে সমুদ্রপথে ল্যাটিন আমেরিকার যাত্রা সময়সাপেক্ষ এবং অতি ব্যয়বহুল, তার উপর ফুটবল রাজনীতি নিয়েও দুই মহাদেশের মধ্যে রয়েছে চাপানউতোর। ফলে শুরুতে কোন ইউরোপীয় দলই আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা যেতে রাজি হয়নি।
শেষমেশ ফিফার প্রেসিডেন্ট, ফরাসি জুলে রিমে বলে কয়ে কয়েকটা দেশকে রাজি করালেন। মসিঁয়ে রিমে নিজের নামে চালু হওয়া ট্রফি আর নিতান্ত অনিচ্ছুক এক ফরাসী দল নিয়ে কন্তে ভের্দে নামে এক জাহাজে চেপে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পৌঁছান মন্টিভিডিও।
কন্টিনেন্টাল ফুটবলের বড় পরাশক্তিগুলো খরচের গোঁ ধরে থাকায় ইউরোপ থেকে আর গেলো কেবল বেলজিয়াম, রোমানিয়া ও যুগোশ্লাভিয়া। অবশ্য, দুষ্টু লোকে বলে সেসময় উরুগুয়ে আর আর্জেন্টিনার ফুটবল এতোটাই চোখ ধাঁধানো ছিলো ইউরোপীয়রা ‘ভয়ে’ খেলতে যায়নি। এর দুই বছর আগেই আমস্টার্ডাম অলিম্পিকে ফাইনাল খেলে গেছে এই দু’দল। প্রথমটায় ১-১ ড্র হলে রিপ্লে ম্যাচে সে যুগের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হেক্টর স্কারোনের গোলে স্বর্ণ পদক জেতে উরুগুয়ে।
তবে ইউরোপের আপত্তিতে দক্ষিন আমেরিকার দেশগুলোর উৎসাহে ভাটা পড়েনি। এই দুদল ছাড়াও ব্রাজিল, বলিভিয়া, চিলি, প্যারাগুয়ে আর পেরুও যোগ দেয় প্রথম বিশ্বকাপে। যেহেতু কোয়ালিফাইং রাউন্ড ছিলোই না, উলটো সেধে সেধে দলগুলোকে আনা হয়েছে তাই কেউ বাদ যায়নি। মজার ব্যাপার আজতক আর কোন বিশ্বকাপে এতোগুলো ল্যাটিন আমেরিকান দল আর খেলেনি। নিজেদের মহাদেশে বিশ্বকাপ বলে কথা! মোট ১৩ দলের সেই টুর্নামেন্টে বাকি দুইটি দল ছিলো যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকো। মূলত স্কটিশ অভিবাসীদের নিয়ে গড়া মার্কিন দলটি টুর্নামেন্ট শেষ করে তৃতীয় অবস্থানে। শুধু তাই না, এ দলের বার্ট পাতেনাওদের করা প্যারাগুয়ের বিপক্ষে হ্যাট্রিকটিও বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম হ্যাট্রিক।
এই স্টাবিলেই ৩০ জুলাই উরুগুয়ের সঙ্গে ফাইনালে আলবিসেলেস্তেদেরকে ২-১ গোলে এগিয়ে নেন। তবে দ্বিতীয় অর্ধে উরুগুয়ে নিজেদের বলে খেলে ৩ গোল দিয়ে ৪-২ এ ম্যাচ জিতে নেয়। রেফারিং আর বল নিয়ে সন্দেহ এই মাত্রায় পৌঁছেছিল যে দুইদল দুই অর্ধে দুই দলের সাথে নিয়ে আসা আলাদা আলাদা বলে খেলেছিল। কানায় কানায় ভরা স্টেডিয়ামে খেলা পরিচালনাকারী বেলজিয়ান রেফারি জন লাংগুনেসও এতোটাই ভয়ে ছিলেন যে তিনি খেলা শুরুর আগে জীবন বীমা দাবি করেছিলেন।
অবশ্য শেষমেশ বুয়েন্স আইরেসে কিছু ‘অসভ্য’ আর্জেন্টাইন দর্শকের উরুগুয়ে দূতাবাসে ঢিল ছোড়া বাদে ‘বড়সড়’ কিছু হয়নি। তবে টুর্নামেন্টে রেফারিং নিয়ে না বললেই না! বলিভিয়ার রেফারি উলিসেস সাওকেডো আর্জেন্টিনা আর মেক্সিকোর খেলায় দিয়েছিলেন তিন-তিনখানা পেনাল্টি! অবশ্য উনার এই আচরণ উনার আরেক কলিগ গিলবার্তো দো আলমেইদা রিগোর তুলনায় কিছুই না! ফ্রান্সের সঙ্গে আর্জেন্টিনার গ্রুপ পর্বের খেলায় ৮৪ মিনিটের মাথাতেই তিনি শেষ বাঁশি বাজিয়ে ঘোষণা দেন, চাড্ডীবাড্ডী গোল! যাও বাবারা, বাড়ি যাও।
ব্রাজিলীয় রেফারির এই ‘কীর্তিতে’ আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে ম্যাচ জিতে যায়। অথচ বাংলাদেশের কোন আর্জেন্টাইন ফ্যান আজ পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রতি সেটা নিয়ে কৃতজ্ঞতা দেখালো না।