সাম্য আর বিপ্লবের যে স্বপ্নরাজ্য একদিন ফুটবল খেলতো তা আজ অনেকেই ভুলে গেছে। ঠিক বিপ্লবকে ভুলে যেমন প্রতিক্রিয়াশীলতায় আগ্রহী হয়েছেন অনেকেই। এক সময়ের প্রতাপশালী দল ইউএসএসআর ওরফে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠিক তেমনি এক ভুলে যাওয়া স্বপ্নের নাম।
সোভিয়েত ইউনিয়ন (ইউএসএসআর) (১৯১৭-১৯৯১)
সাফল্যের নিক্তিতে বিশ্বকাপে খেলা বিলুপ্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দল ছিল চেকোস্লোভাকিয়া। অবশ্য ফুটবলের পোকারা বলবে অন্য একটি দেশের নাম। এমনকি এখনো তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় সর্বকালের সেরা গোলরক্ষকের নাম কি, তারা সেই দেশেরই এক গোলরক্ষকের নাম বলবেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের গোলপোস্ট আগলে রাখা লেভ ইয়াসিন। কেন তাকে সর্বকালের সেরা বলা হয়? ছোট্ট একটা তথ্যেই এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে। চার বিশ্বকাপে খেলা এই গোলরক্ষক তার ক্যারিয়ারে কেবল পেনাল্টিই নাকি ঠেকিয়েছিলেন দেড়শরও বেশি!
লেভ ইয়াসিনদের সময়টাই ছিল সোভিয়েত ফুটবলের স্বর্ণযুগ। এর আগে অবশ্য সমাজতান্ত্রিক এই দেশটি ফুটবলটা সিরিয়াসলি খেলেইনি। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের পর, ১৯২২ সালে বলশেভিকদের নেতৃত্বে ইউরোপ-এশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়। পুরো নাম ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস, সংক্ষেপে ইউএসএসআর। সেই থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তারা ফুটবলের বড় কোনো টুর্নামেন্টেই অংশগ্রহণ করেনি। অলিম্পিকের ফুটবলে প্রথম অংশ নেয় ১৯৫২-তে। বিশ্বকাপে তারও এক আসর পরে, ১৯৫৮-তে।
শুরুতেই পরপর চার আসরে তারা সেরা আটে জায়গা করে নেয়। মাঝে ১৯৬৬-তে পৌঁছে গিয়েছিল সেমিফাইনালেও। সেখানে লেভ ইয়াসিনদের অগ্রযাত্রা রুখে দেয় বেকেনবাওয়ারের জার্মানি। বিশ্বকাপে সাফল্য ধরা না দিলেও, সোভিয়েতের সোনালি প্রজন্ম ঠিকই সোনা এনে দিয়েছিল অলিম্পিকে, ১৯৫৬-তেই। আর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয় প্রতিযোগিতাটির প্রথম আসরেই, ১৯৬০-এ। পরের তিন আসরে দুইবার হয় রানার্স আপ, অন্যবার সেমি ফাইনালিস্ট।
পরের দশকের দুটো বিশ্বকাপেরই চূড়ান্ত পর্বে উঠতে ব্যর্থ হয় সোভিয়েতরা। অবশ্য প্রথমটায়, ’৭৪-এর কারণটা রাজনৈতিক। একমাত্র ’৭৮-এর ব্যর্থতাটাই কেবল খেলার মাঠের। এরপর আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বহুজাতিক এই দলটি। হয়ে ওঠে বিশ্বকাপের নিয়মিত মুখ।
কিন্তু ততদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘কোল্ড ওয়ার’-এ কোণঠাসা হয়ে পরতে শুরু করেছে দেশটি। সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভের নতুন পলিসিগুলোও শেষ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের।
আর তাই ১৯৯০ বিশ্বকাপটাই হয়ে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ বিশ্বকাপ। ট্র্যাজিক বিষয় হলো, একমাত্র সেই বিশ্বকাপেই সোভিয়েতরা প্রথম রাউন্ডের বাধা পেরোতে পারেনি। অবশ্য শেষ বিশ্বকাপ হিসাব না করে শেষ ম্যাচ হিসেব করলে, বিদায়টা নিতান্ত মন্দ হয়নি। প্রথম দুই ম্যাচে হেরে শেষ ম্যাচের আগেই তাদের বিদায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। প্রতিপক্ষ ক্যামেরুন উল্টো প্রথম দুই ম্যাচে জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাই নিশ্চিত করে ফেলেছিল। শেষ ম্যাচে সেই ক্যামেরুনকেই বড় ব্যবধানে হারিয়ে নিজেদের বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার শেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
১৯৯১ সালে পতনের পরে, দেশটির সকল রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার পায় রাশিয়া। ফুটবল দলের ক্ষেত্রেও তাই। কেবল গণ্ডগোল বাঁধে ১৯৯২ ইউরো নিয়ে। কারণ এর আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন টুর্নামেন্টের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ পতনের পরে এই এক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে হয়েছে ১৫টি দেশ- রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, মালদোভা, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান ও আর্মেনিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন পতন ঘটছিল, তখনই দেশগুলোর কয়েকটি মিলে কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস বা সিআইএস গঠন করেছিল। আপদকালীন সমাধান হিসেবে দলটির খেলোয়াড়েরা ওই নামেই টুর্নামেন্টটিতে খেলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল রেকর্ডের উত্তরাধিকারও তখন দেওয়া হয় এই দলটিকে। আর তারপর থেকে সোভিয়েত নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের মতোই ফুটবল দলেরও সকল উত্তরাধিকারের ভোগদখল করছে এবারের আয়োজক দেশ, রাশিয়া।
ক্রিমিয়া বাদেও এই ইস্যুতেও অবশ্য ইউক্রেন খানিকটা আপত্তি করতে পারে। কারণ ইউএসএসআরের ফুটবলারদের জোগানের একটা বড় চালানই আসতো সেখান থেকে। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ফুটবলের ক্ষতিটাও হয়েছে মূলত এই রাশিয়া-ইউক্রেন বিভক্তিতেই। সাথে আরো তেরটা ভাগে ভাগ হওয়া মিলিয়ে, ফুটবলের এক সময়ের প্রতাপশালী এই দলটির উত্তরসূরীরা এখন বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলতেই হাপিত্যেশ করে মরে।