গেল আসরে নাকি সাড়ে তিন বিলিয়নের মতো দর্শক টিভিতে খেলা দেখেছিলো। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। ভাবতে ভালোই লাগে, আমিও তাদের একজন। যদিও যে পরিমাণ খেলা দেখেছি তার সবমিলেও একটা পুরো খেলার ৯০ মিনিট তো দূর, হাফটাইমও হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ। তাহলে বুঝতেই পারছেন, মাঝেমধ্যে মাথা ব্যবহার করে খেলা দু’পেয়ে এই নৈপুণ্য প্রদর্শন বিষয়ে বলতে আমি কতোটা অযোগ্য! তাই মাঠের খেলা নিয়ে বলতে যাওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছি না। বলবো মাঠের বাইরের খেলা নিয়ে। যে খেলা খেলেন মার্কেটিংয়ের খেলারামেরা। নানা ব্র্যান্ডের আড়ালে খেলারামেরা গণেশ আর মা-লক্ষ্মীর আশীর্বাদধণ্য হওয়ার অন্য এক লড়াইয়ে নামেন। গ্রাহক, ভোক্তাদের মন জয়ের লড়াই। ঠিক ধরেছেন, বলছিলাম বিশ্বকাপ ঘিরে হওয়া ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যের লড়াইয়ের কথা। আর তারপর ওই খেলার হারজিতের উপর ভিত্তি করে নিজ নিজ ব্র্যান্ডাবতারের (ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর) সৌজন্যে নির্দিষ্ট দেবালয়ে (পড়ুন ব্র্যান্ডালয়ে) হতে থাকে অর্থবৃষ্টি। চলুন দেখি এই রাশিয়া বিশ্বকাপের ভরা মৌসুমে ব্র্যান্ডগুলো কেমন খেলায় মেতেছে।
অ্যাডিডাস (ক্রিয়েট দ্য আন্সার)
মেসি, সুয়ারেজ, ওজিল, পগবা, সালাহ আর আরো অনেক জানা অজানা ফুটবল তারকা; জিদান, বেকহাম, মরিনহোর মতো কোচ; আর পপ তারকা অ্যাসআপ ফার্জ, কেহলানি, ফ্যারেল উইলিয়ামস, স্টর্মজির মতো ক্রিয়েটরদের সন্নিবেশ ঘটেছে অ্যাডিডাস-এর এই কমার্শিয়ালে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ফার্জ বলে যাচ্ছেন ফুটবল-সহ জীবনের নানা ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভিটি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। আর ফুটবলাররা দেখাচ্ছেন তাদের অতিমানবীয় ফুটবল স্কিল।
নাইকি: গোয়িং টু ব্রাজিল
অ্যাডিডাস বাজারে বিজ্ঞাপন ছেড়ে দিলে আরেক স্পোর্টস জায়ান্ট ‘নাইকি’ কি ছেড়ে কথা বলবে নাকি? বলেনি। ফুটবল নিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের গর্বগাঁথা উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে এই বিজ্ঞাপনটি। বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই ব্রাজিল। অথচ ২০০২-এর পর ফাইনালে উঠতে পারেনি। গতবার সেমিতে ঘরের মাঠেই হজম করতে হয়েছে সেভেন-আপ। এখনও কি তাদের মাঝে আছে শিরোপা পুনরুদ্ধারের সে আগুন? এর উত্তর দিচ্ছেন ব্রাজিলিয়রা। যাদের ফুটবলের জন্ম হয় রাস্তায়, বাড়ির উঠানে। সেখান থেকেই তাদের পায়ের কারিশমা, তাদের জগু বনিতো মুগ্ধ করে, অনুপ্রাণিত করে পুরো বিশ্বকে।
কুইলমেস: কন্ট্রাক্ট বিটউইন ফ্যানস অ্যান্ড প্লেয়ারস
সেভেন আপ নিয়ে ব্রাজিলকে যেমন ট্রল হজম করতে হয়, তেমনি গত বত্রিশ বছর ধরে বিশ্বকাপ না জেতা এবং সাম্প্রতিক তিনটি বড় বড় প্রতিযোগিতার ফাইনালে (দু’টি কোপা আমেরিকা ফাইনাল, একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল) উঠেও কাপ জিততে না পারার বঞ্চনা কম সইতে হয়না ব্রাজিল দল আর তাদের ভক্তদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনাকে। ব্রাজিল ভক্তদের থেকে তো খোঁটা শুনতে হয়ই, আর্জেন্টিনার ভক্তরাও এ নিয়ে দু’কথা শোনাতে ছাড়ে না খেলোয়াড়, কোচ আর স্টাফদের। ভক্তদের আবারো এক করার জন্য আর্জেন্টাইন পানীয় ‘কুইলমেস’-এর এই বিজ্ঞাপনে এগিয়ে এসেছেন আর্জেন্টিনার সাবেক ফুটবলার অস্কার রাগেরি। অস্কারের কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন আর্জেন্টাইন ফ্যানরা। আপনাদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবেই।
বিউইন: কে চুরি করলো কাপ?
ম্যারাডোনা, কাফু, এফেনবার্গ নাকি দেল বস্ক, কে চুরি করেছেন বিশ্বকাপ? অনলাইন বেটিং প্রতিষ্ঠান ‘বিউইন’-এর টানটান উত্তেজনাপূর্ণ এক কমার্শিয়ালে হাজির চার তারকা। এঁদের মধ্যে কাদের দেশে যাবে বিশ্বকাপ এই নিয়ে বাজি ধরার সুযোগ আছে ভক্তদেরও। সন্দেহ নেই ফিফা বিশ্বকাপ বাজিকরদের জন্য ঈদের মতোই মুনাফা করার এক লোভনীয় মৌসুম।
গ্যাটোরেড: হার্ট অফ আ লিও
তিনি তো এমনিই এ জগতের নন। তাকে বলা হয় অন্য গ্রহের খেলোয়াড়। পাশের দেশ ইন্ডিয়ায় জন্ম নিলে তিনি হয়তো হতেন ‘বল-দেব’। যাহোক, স্পোর্টস বেভারেজ গ্যাটোরেড-এর এই চার মিনিট লম্বা স্বল্পদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রটিতে লিওনেল মেসি সেই পর্যায়েরই একজন। নিয়তি যাকে তাঁর স্বপ্ন ছুঁতে দিতে চায়নি কিন্তু নিজের চেষ্টায় ছুটে পেছনে ফেলেছেন দৈবকে। দু’হাত ভরে জিতেছেন অনেক, তবুও কিছু প্রাপ্তির কাছ থেকে ফিরে এসেছেন হাতে ছোঁয়া যায় এমন দূরত্ব থেকে। এগুলো নিয়েই চমৎকার একটি শর্ট ফিল্ম কমার্শিয়াল।
ভিসা: ফিরে আসছেন ইব্রাহিমোভিচ?
সুইডিশ ফরোয়ার্ড জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের অবসর নিয়ে কানাঘুষা চলছে এখনও। তবে তিনি বিশ্বকাপের স্কোয়াডে নেই সেটি নিশ্চিত। এদিকে এই কমার্শিয়ালে রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে জানাচ্ছেন তাকে ছাড়া বিশ্বকাপ অসম্ভব। যেকোনো মূল্যে তিনি বিশ্বকাপে থাকছেন। কীভাবে? জানতে হলে বিজ্ঞাপনটি দেখতে হবে।
বিবিসি স্পোর্ট: তৈরি হবে ইতিহাস
দুয়ারে বিশ্বকাপ। আর তার জন্য বিবিসি’র এই ক্যাম্পেইনটি হচ্ছে ছোট্ট রিমাইন্ডার। বিজ্ঞাপনটিকে বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসের ছোট্ট একটি যাত্রাও বলা যায়। এই যাত্রায় চোখে পড়ে কিংবদন্তী ফুটবলার ম্যারাডোনা, জিদান, গ্যাসকোয়েনকে। তেমনি এবারে যাদের দিকে চোখ রাখতে হবে সেই মেসি, রোনালডো আর হালের ক্রেজ হ্যারি কেন-কেও দেখা যায় এক ঝলক।
ক্রিস্টাল: দ্য হ্যাকিং জার্সি
ঘটনাটা আগের। তবে বিশ্বকাপের সাথে সম্পর্কিত বলে এখানে উল্লেখ করলাম। ১৯৮২ সালের পর পেরু আর বিশ্বকাপে উঠতে পারেনি। এবার সুযোগ এসেছিলো। তার জন্য বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে হারাতে হতো নিউজিল্যান্ডকে। কিন্তু খেলাটা ছিলো ওয়েলিংটন, নিউজিল্যান্ডে। যেখানে মাত্র ৬৪ জন পেরুভিয়ানের বাস। খেলায় সমর্থকদের সমর্থন কতোটা জরুরি তা সবার জানা। কিন্তু পেরু ফুটবলাররা তো কিউই সাপোর্টারদের ভিড়ে চুপসে যাবে। এমতাবস্থায় কীভাবে ফুটবলারদের মনোবল বাড়ানো যায় তারই একটা অভিনব সমাধান নিয়ে এলো পেরুর পানীয় ব্র্যান্ড ‘ক্রিস্টাল’। দু’দলের জার্সির রংই সাদা। এর মধ্যে পেরুর জার্সিতে আড়াআড়িভাবে আছে লাল স্ট্রাইপ। আবার নিউজিল্যান্ডের ম্যাপটাও অনেকটা দেখতে ওরকম একটা স্ট্রাইপের মতোই। সাদা শার্টে কিউই পতাকার লাল রংয়ে ওই ম্যাপটা ছাপিয়ে তৈরি করা হলো নতুন এক জার্সি। যেটা উপহার দেয়া হলো কিউই সাপোর্টারদের। গ্যালারিতে হাজার হাজার কিউই ফ্যান যখন ওই জার্সি পরে বসা, দূর থেকে সেটিকে পেরুর অফিশিয়াল জার্সি বলে ইল্যুশন তৈরি হয়। ব্যস্, পেরুর ফুটবলাররাও সে শক্তিতে উৎরে যায় বাধা। ৩৬ বছর পর আবার তারা বিশ্বকাপের মঞ্চে।
ব্র্যান্ডের এমন ছুপা স্ট্রাটেজিক লড়াই দেখতে চাই বিশ্বকাপেও। তার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো। তারা নিশ্চয়ই এই লেখা পড়বেন।