বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে কখন খেলবে এই কথা কেউই বলতে পারে না তবে বাংলাদেশের ফুটবল উন্মাদনা যে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তা সবাই জেনেছে এবং এই বিষয়ে সবার স্পষ্টত ধারণা হয়েছে। কি নেই এই উন্মাদনায়? নিজেদের পছন্দের দলের জার্সি কিনে তা বিনামূল্যে বিলি করা, প্রতিযোগিতা দিয়ে বড় সাইজের পতাকা বানানো, কোথাও আবার জমি বিক্রি করে পতাকা বানানো, সেই পতাকা নিয়ে নির্বাচনী আমেজের মতো মিছিল করা, নিজের পছন্দের দলের পতাকার আদলে মাথার চুল-দাঁড়ি কাটা, বাড়ি রং করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল বানানো, প্রতিপক্ষ দলের পতাকার রঙ বা ডিজাইনের আদলে স্যান্ডেল, বদনা, টেবিল, খাট রঙ করা, প্রতিপক্ষ দুইদলের হয়ে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়া, মারামারি করা, অবশেষে প্রাণ বিসর্জন। যদিও খেলা বা দল নিয়ে উন্মাদনা, প্রতিযোগিতা সহনশীল পর্যায়ে রাখাটা সবার উচিত হলেও তা অনেকেই করছেন না। ক্ষতিকর কিছু কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। এইসবকিছু আমরা কখনো বুঝে বা না বুঝে করলেও গণমাধ্যমগুলো বুঝেশুনেই এই পালে হাওয়া দিয়েছে।
এই বছরই জাতীয় নির্বাচন। এরমধ্যে আমাদের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা নিজের এলাকায় বড় দুই দল ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার মধ্যকার খেলার আয়োজন করে। স্বভাবতই আমাদের দেশে এই দুই দলের সমর্থক সর্বাধিক। গণমাধ্যমে সেইসব সংবাদ দ্রুত চলে আসে। যেখানে ঈদ-উল-ফিতরের মতো জাতীয় উৎসবকে ঘিরে সবার বিভিন্ন পরিকল্পনা থাকে। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো এই সময়টাতে বহু টাকা বিনিয়োগ করেন লাভের আশায়। সেইখানে বিশ্বকাপ ফুটবল জ্বরে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। সবাই খেলা নির্ভর নাটক, অনুষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপন বানানো শুরু করলো। চ্যানেল খুললেই খেলা বিষয়ক অনুষ্ঠানের সমাহার।
বিশ্বকাপ জ্বরে যে আমরা ভয়ানকভাবে আক্রান্ত তার আরো প্রমাণ হল জাতীয় দৈনিক, সংবাদ চ্যানেল এবং রেডিও স্টেশনগুলো। যেখানে জলাবদ্ধতা, ঈদ, ঈদে ঘরমুখো মানুষের আসা-যাওয়া, সৌদিতে নারী স্বাধীনতা, জেলাগুলোতে নির্বাচনী আমেজের খবর বেশি বেশি দেখানো হত, শোনানো হত এবং পত্রিকাতে রিপোর্ট করা হত সেইখানেই বিশ্বকাপ ফুটবল নিজের ছন্দে জায়গা করে নিয়েছে। এমনকি যে বাজেট নিয়ে আগে দফায় দফায় আলোচনা হত, সেই জায়গায় বাজেটকে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবল। ফুটবল জ্বর বা ফুটবল উন্মাদনা আসলেই আমাদের বেশি বেশি।
বিশ্বকাপ ফুটবলের ছন্দ আরো ছন্দময় হয়ে উঠেছে গণমাধ্যগুলোর আয়োজন দেখে। পত্রপত্রিকাগুলো কে কার আগে বিশ্বকাপ নিয়ে আলাদা ট্যাবলয়েড, ম্যাচ ফিক্সচার, খেলোয়াড়দের বড় ছবি দিবে তার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রতিটি পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল এবং রেডিও কে কার আগে সর্বশেষ খবর এবং বিশ্বকাপ আলোচনা ছাপাতে, দেখাতে এবং শোনাতে পারবে তার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আগে দেখতাম বিশ্বকাপ উপলক্ষে শুধু আমাদের দেশ থেকে সাংবাদিকরা সেইসব দেশে যেত যাতে করে সর্বশেষ খবর প্রচার করতে পারে কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্বকাপ উন্মাদনা দেখে বাইরের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও এখন আমাদের দেশে আসছে।
সম্প্রতি ব্রাজিলের গ্লোবো টেলিভিশনের তিন গণমাধ্যমকর্মী বাংলাদেশে এসেছে রিপোর্ট করতে। সাংবাদিক ক্লেটন কনজারভানি, প্রযোজক ইগর তাভারেজ ও চিত্রগ্রাহক মাইকেল বেন্টো বাংলাদেশে এসে শুধু মুগ্ধই হননি রীতিমত বিস্মিত হয়েছেন। বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের মানুষের ফুটবল উন্মাদনা, ফুটবল প্রীতি, ফুটবল পাগলামী ব্রাজিলের চেয়েও বেশি। ব্রাজিল দল বিশ্বকাপ ফুটবল খেলছে কিন্তু বাংলাদেশ খেলছে না তাতে কি? আনন্দে কোনোভাবে যেন কমতি না হয় সেই আয়োজন দেখেও তারা বিস্মিত। তারা ব্রাজিল ফুটবল দলের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের ভালোবাসা দেখে আনন্দিত। ব্রাজিলের ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ব্রাজিলীয়দের চেয়েও বেশি মনে করেন এই তিনজন। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ব্রাজিল দলের প্রতি ভালোবাসার অভিব্যক্তি, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ সংগ্রহ করেন।
শুধু তাই নয় মাগুরাতে ছুটে আসেন জার্মান কুটনৈতিকরা। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে জমি বিক্রি করে প্রিয় দল জার্মানির জন্য সাড়ে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পতাকা বানিয়েছেন মাগুরার কৃষক আমজাদ হোসেন। ওই পতাকা দেখতে এবং আমজাদ হোসেনকে অভিনন্দন জানাতে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মান দূতাবাসের কূটনীতিক কার্নে উইজোরা এবং শিক্ষা সংস্কৃতিক কর্মকর্তা তামারা কবির।
একদিকে মাগুরা অপরদিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ছুটে যান ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত জোয়াও তাবাজারা ডি অলিভেরিয়া জুনিয়র। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার লালপুর এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন। তিনি ব্রাজিল দলের অন্ধ ভক্ত। ব্রাজিলের প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টান্ত হিসেবে জয়নাল নিজের ছয়তলা বাড়িটি ব্রাজিলের পতাকার রঙে রাঙিয়েছেন। বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে ব্রাজিল বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের ছবি টাঙানো আছে। বাড়িটি যেন ব্রাজিল ফুটবল দলের প্রতি ভালোবাসায় রাঙানো এক টুকরো শহর। ব্রাজিলের প্রতি ভালোবাসার কারণে এখন সবাই ওই বাড়িটিকে চিনে ‘ব্রাজিল বাড়ি’ হিসেবে।
ফুটবলের প্রতি আমাদের এই অত্যধিক উন্মাদনা একসময় বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে বিশ্বকাপ ফুটবলে। সেইদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে বিশ্বকাপ ফুটবলে আমাদের তারকা, খেলোয়াড়, পতাকা, জার্সি নিয়ে মেতে উঠবেন গোটা বাংলাদেশ।