শুধু যুগোশ্লাভিয়া না, রাজনীতির করাল গ্রাসে কিংবা বলা উচিত দ্বন্দ্বমুখর বাস্তবতায় ইতিহাসের হিসাব মিথ্যে করে দিয়েছে কত রাষ্ট্রকেই। এমনই এক দেশের গল্প হবে আজ, যারা বিশ্বকাপে ছিল প্রথম এশীয় দেশ। যে দেশটি আজ আর নেই, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ (জাতীয় দল– ১৯৩৪–১৯৪৫)
ভাস্কো দ্য গামা যখন সফলভাবে আফ্রিকার উপকূল ঘুরে ইউরোপ থেকে সরাসরি এশিয়ায় চলে এলেন, পুরো দুনিয়ার রাজনীতি আর অর্থনীতির চেহারাই বদলে গেলো। এতদিন যে বাণিজ্যরুটগুলো ছিল আরবদের কুক্ষিগত, এবারে সেগুলোতে ভাগ বসালো ইউরোপীয়রাও। আর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ব্যবসা করতে এসে ইউরোপীয়রা এক-এক করে রাজ্যগুলোতে নিজেদের কলোনি তৈরি করতে শুরু করলো। এই নিয়ে এশিয়ার ভারত সাগরে রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা পাকিয়ে উঠেছে কতবার!
সাম্রাজ্যবাদী দখলদারিত্বের এই রমরমায় তথাকথিত সভ্য কোন ইউরোপীয় রাষ্ট্রই পিছিয়ে থাকেনি। ডাচদের বাংলায় বলা হয় ওলন্দাজ, যাদের দেশের বর্তমান নাম নেদারল্যান্ডস। ডাচরা মসলার ব্যবসা করতে এসেছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে, বাকিদের সক্কলের আগে। সেই ব্যবসা করতে এসেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তারা। ১৮০০ সালে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিজেদের নতুন এই উপনিবেশের নামকরণ করে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ এখন যে নামে পরিচিত, সেই ইন্দোনেশিয়া নামটা চালু হয় ওই শতকের একদম শেষের দিকে। এলাকাটার ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে। স্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের পরাধীন দেশের নামকরণ করেন ইন্দোনেশিয়া। যাতে এই এক নামের ভিত্তিতে একত্রিত হয়ে ওঠে ওখানকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, তুলতে পারে স্বাধীনতার দাবি।
নতুন শতকে এই ডাচ ইস্ট ইন্ডিজই নেদারল্যান্ডসের অধীনে থেকে ফুটবল খেলতে শুরু করে। আর ১৯৩৮ বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে বনে যায় এশিয়ার প্রথম বিশ্বকাপ খেলা দল হিসেবে। সেই জন্য অবশ্য তাদের খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। সেবার এশিয়া থেকে একটি জায়গার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই ছিল মাত্র দুটি দল। জাপান আর ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ। তাও আবার শেষ মুহূর্তে জাপান নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে এক রকম অনায়াসেই বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলা প্রথম এশীয় দল বনে যায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ।
কোনো রকম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছাড়াই ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়েরা বিশ্বকাপ খেলতে ফ্রান্সে রওনা দিয়েছিল। সাথে সম্বল ছিল কেবল ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। সেই যৎকিঞ্চিত সম্বল নিয়ে তারা তেমন কিছু করতেও পারেনি। ১৬ দলের ১৯৩৮ বিশ্বকাপের পুরোটাই ছিল যে নকআউট ভিত্তিক। প্রথম ম্যাচেই তাদের মুখোমুখি হতে হয় সে সময়ের শক্তিশালী দল হাঙ্গেরির। হেরে যায় ৬ গোলের বড় ব্যবধানে। এই হাঙ্গেরি পরে সে বার রানার্স আপ হয়েছিল।
সেই শেষ। এরপরে আর কখনোই বিশ্বকাপের মূল পর্বের চেহারা দেখেনি ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা প্যান-এশিয়ানিজমের বুলি কপচিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে জাপানি সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটালে, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজও চলে আসে তাদের দখলে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাপান আত্মসমর্পণ করলে, ইন্দোনেশীয়রা নিজেদের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। শুরু হয় ডাচ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াই। চার বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে, ১৯৪৯ সালে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার সাথে সাথে নিশ্চিত হয়ে যায়, বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে একটি মাত্র ম্যাচ খেলেই ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার বিষয়টি।
প্রথম এশীয় দল হিসেবে বিশ্বকাপে খেলার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের উত্তরাধিকারী হয় নতুন স্বাধীন-সার্বভৌম দেশটির ফুটবল দল। যদিও চূড়ান্ত পর্বের ওই এক ম্যাচের গেরো থেকে এখনো বের হতে পারেনি ইন্দোনেশিয়া। তারা পরে আর কখনোই বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্ব অবধিই যে যেতে পারেনি। শীঘ্রই যে পারবে, তেমন আশাও এখনো দেখা যাচ্ছে না। এমনকি ফেডারেশনে অযাচিত সরকারি হস্তক্ষেপের জন্য বছর কয়েক আগে ফিফা তাদের উপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছিল।