বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে কিন্তু এখন তাদের হদিস মেলে কেবল ইতিহাসের বইতেই। এমন ছয়টি বিলুপ্ত জাতীয় দলের একটি দুই বারের ফাইনালিস্ট চেকোস্লোভাকিয়া। আজ তারা কেবল চেক প্রজাতন্ত্র আর শ্লোভাকিয়া।
চেকোস্লোভাকিয়া (১৯২০-১৯৯৩)
ফুটবল বিশ্বকাপে খেলা বিলুপ্ত জাতীয় দলগুলোর মধ্যে ফলের হিসেবে সবচেয়ে শক্তিশালী বলা যেতে পারে চেকোস্লোভাকিয়াকে। কারণ- দলটা ফাইনালই যে খেলেছে দুই-দুইবার। দুইবারেই শুরুতে লিডও নিয়েছিল তারাই। শেষ পর্যন্ত লিড ধরে না রাখতে পারার খেসারত দিয়ে কাপ ছাড়াই ক্যারিয়ার শেষ করতে হয়েছে দেশটিকে।
এর মধ্যে নিজেদের প্রথম ফাইনালটাই বোধহয় সাবেক এই দেশটির ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে ট্র্যাজিক ঘটনা। ১৯৩৮ সালে নিজেদের প্রথম এবং বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরেই ফাইনালে ওঠে চেকোস্লোভাকরা। ৭১ মিনিটে লিড নিয়েও শেষ পর্যন্ত হেরে যায় তারা স্বাগতিক ইতালির কাছে। পরে আবার তারা ফাইনালে পৌঁছেছিল ১৯৬২ সালে। সেবার ব্রাজিলের বিপক্ষে এগিয়ে গিয়েছিল ১৫ মিনিটের মাথাতেই। কিন্তু এবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। খোয়া গেল লিড। তবে বিশ্বকাপের সোনায় মোড়ানো ট্রফিটা জিততে না পারলেও, একবার করে তারা জিতেছিল ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও অলিম্পিকের স্বর্ণপদক।
দুইবারের ফাইনালিস্ট হলেও, চেকোস্লোভাকরা পরে ফুটবলে তাদের সেই দাপট ঠিক ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৬২-র পর থেকেই তারা বিশ্বকাপে অনিয়মিত হতে শুরু করে। মাঝে পরপর দুইবার ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ছড়ি ঘোরালেও, ’৭৬-এ চ্যাম্পিয়ন ও ’৮০-তে তৃতীয় হওয়ার পর আর কখনোই টুর্নামেন্টটির মূল পর্বেই পৌঁছাতে পারেনি তারা। অলিম্পিকের সোনাটাও এসেছিল ওই ’৮০-তেই।
এরই মধ্যে চেকোস্লোভাকিয়ায় ভাঙনের সুর বাজতে শুরু করে দিয়েছিল। সম্ভবত ভাঙনের সুরটা ছিল দেশটির জন্মেই। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসে ১৯১৮ সালে যখন দেশটি গঠিত হয়, তখন থেকেই। দেশটির অর্ধেক মানুষ জাতিতে ছিল চেক। বাকিদের একটা বড় অংশ আবার স্লোভাক। দ্বন্দ্বটা মূলত এদের মধ্যেই। আশেপাশের দেশগুলো আবার নিয়মিত তাদের প্রয়োজন মাফিক সেই দ্বন্দ্বের আগুনে ঘিয়ের যোগান দিয়ে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দেশটি সোভিয়েত ব্লকে যোগ দেয়। সেটিও মূলত চেকদের আগ্রহেই। অন্যদিকে স্লোভাকদের আগ্রহ ছিল পুঁজিবাদের প্রতি।
শেষ পর্যন্ত চেকোস্লোভাকিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে ১৯৮৯ সালে। বদলে পত্তন ঘটে গণতন্ত্রের। সেই রূপান্তরের ঐতিহাসিক নাম ভেলভেট বিপ্লব। রক্তপাতহীন এই বিপ্লব যখন ঘটছে, তখন আসলে ইউরোপ জুড়ে গোটা ইস্টার্ন ব্লকেরই পতন ঘটছিল। প্রায় একই সময়ে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডেও। সমাজতন্ত্রের বদলে গণতন্ত্র আসলেও, জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান হয়নি। উত্তেজনা বরং উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।
অবশ্য সেই দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধতে অনূদিত হয়নি। তার আগেই, ১৯৯২ সালে সংসদে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চেক আর স্লোভাকদের জন্য সৃষ্টি হয় দুটি আলাদা রাষ্ট্রের- চেক রিপাবলিক আর স্লোভাকিয়া। ফিফা দুইবারের ফাইনালিস্ট চেকোস্লোভাকিয়ার সকল অর্জনের উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি দেয় চেক রিপাবলিককে। এককভাবে তারা ২০০৬-এ বিশ্বকাপেও খেলেছে। আর স্লোভাকিয়ারও বিশ্বকাপ অভিষেক হয়ে গেছে ২০১০-এই। তবে কোনো দলই এরপরে এখনো পর্যন্ত আর বিশ্বকাপে খেলেনি।
তবে শেষবার জ্বলে ওঠার যে একটা ব্যাপার আছে, চেকোস্লোভাকিয়া সেটা ঠিকই দেখিয়ে গেছে। দলটির শেষ বড় টুর্নামেন্ট ছিল ১৯৯০ বিশ্বকাপ। ততদিনে দেশটির যা রাজনৈতিক অবস্থা, তাতে দলের সবাই একরকম টের পেয়ে গিয়েছিল, এটাই সম্ভবত তাদের শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে। শেষবারের মতো বিশ্বকাপে চেকোস্লোভাকিয়ার জার্সি গায়ে তোলাটা স্মরণীয় করে রাখার মন্ত্রে দলের সবাইকে তাতিয়ে তুলেছিলেন কোচ। তাতে কাজও হয়েছিল। তারা পৌঁছে গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি। সেখানে মুখোমুখি হয়েছিল শক্তিশালী জার্মানির। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে তাদের হারানো জার্মানিই শেষ পর্যন্ত সেবারে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।