পত পত করে উড়ছে পতাকা

ফুটবল খেলা নিয়ে আমাদের আবেগ, অনুভূতি, উন্মাদনা, উচ্ছ্বাস, পাগলামী একটু বেশি। ক্রিকেটে আমাদের অগ্রগতি হলেও প্রেম কিন্তু আমাদের ফুটবলের সাথেই। ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান সেই অর্থে ভালো না তবে ফুটবল আসক্তি আমাদের সবচেয়ে বেশি।

ছোট বা বড় যেকোনো বয়সে ফুটবলে লাথি দেয়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছেলে কিংবা মেয়ে সবারই ফুটবলের প্রতি গোপন ভালোবাসা আছেই। সেই প্রেমকে আরো গতিশীল করে তোলে আমাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডগুলো। কখনো জার্সি কিনে, কখনো নিজেদের পছন্দের পতাকা কিনে, কখনো পুরানো টেলিভিশন বিক্রি করে নতুন টেলিভিশন কিনে আমরা আমাদের উৎসাহ মিটায়।

আশি বা নব্বইয়ের দশকে এলাকাগুলোতে পতাকা তুলে নিজেদের অবস্থান জানানোটা ছিল গর্বের বিষয়, অহংকারের বিষয়। সেই সময় নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং-এ পতাকা টাঙানো হত। তখন এখনকার মতো এতো বিশাল বিশাল পতাকা পাওয়া যেত না। মাঝারি সাইজের পতাকা পাওয়া যেত। সময়ের সাথে সাথে মানুষের উন্মাদনা বাড়তে থাকে, সাথে পতাকার সাইজও। তবে শূন্য দশকে এসে পতাকা বিশালাকার সাইজের হওয়া শুরু করে। পতাকা টাঙিয়ে নিজেদের এলাকা দখল বা আধিপত্য বিস্তার শুরু হয়। তখন শুধু পতাকা টাঙানোই নয়, পতাকা নিয়ে মিছিল করাটাও ছিল নিয়মের মতো। সেইসব স্লোগানও ছিল মজার।

‘কোন সে দল,

ব্রাজিল।’

‘জিতবে কারা,

ব্রাজিল।

‘সবাই বলো,

ব্রাজিল।’

অপরদিকে প্রতিপক্ষ সমর্থকরা তাদের পতাকা নিয়ে মিছিল করে বলতো,

‘কোন সে দল,

আর্জেন্টিনা।’

‘জিতবে কারা,

আর্জেন্টিনা।’

‘সবাই বলো,

আর্জেন্টিনা।’

এইসব পতাকা বিক্রি নিয়েও থাকতো প্রতিযোগিতা। কোনো কোনো এলাকাতে প্রতিপক্ষ দলের পতাকা বিক্রি করতে পারতো না। রাশিয়া বিশ্বকাপকে সামনে রেখে রাস্তায় বিভিন্ন পতাকা বিক্রি হলেও এইসব পতাকার মূল কারখানা হল পুরান ঢাকার কদমতলী, পোস্তগোলা, ইসলামপুর, রূপগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে।

বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমান বিক্রেতারা পতাকা বিক্রি করলেও রাজধানীর মিরপুর, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, শ্যামপুর, সদরঘাট, মহাখালী, পল্টন, মৌচাক, মতিঝিল, গাবতলী, ও গুলিস্তান এলাকায় রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি হচ্ছে ফুটবল দলের পতাকা।

রাশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলে ৩২টি দল অংশ নিলেও বাংলাদেশে এইসব দলের সমর্থক নেই। বিক্রেতাদের হিসাবে, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পতাকা। তবে জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের পতাকাও কমবেশি বিক্রি হচ্ছে।

বিশ্বকাপ উপলক্ষে কিছু মৌসুমী পতাকা বিক্রেতাও তৈরি হয়েছে। সারাবছর ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও এই একমাসে শুধু পতাকাই বিক্রি করছেন অনেকে। ছোট, মাঝারি, বড় থেকে শুরু করে বিশাল সাইজের পতাকা বিক্রি হচ্ছে। ছোট পতাকা ২০ টাকা থেকে শুরু, মাঝারি পতাকাগুলো ১০০ থেকে শুরু আর বড় পতাকাগুলো ৩০০ থেকে শুরু। বিশালকার সাইজের পতাকাগুলোর নির্ধারিত কোনো মূল্য নেই। সাইজ বুঝে পতাকার মূল্য নির্ধারিত হয়।

পতাকা নিয়ে আমাদের উন্মাদনায় বিপত্তিও ঘটে মাঝে মাঝে। টাঙ্গাইলের সখীপুরে ব্রাজিলের পতাকা টাঙাতে গিয়ে রাশেদ হাসান নামের কিশোরের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু কাম্য নয়। ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে কিন্তু ক্ষতিকর কিছু থাকবে না এইটা আশা করা যায়।

তবে অগণিত ফুটবল সমর্থকদের মধ্যে বিশেষ একজন সমর্থকের কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন, মাগুরার ফুটবলপ্রেমী আমজাদ হোসেন। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে মাগুরা সদর উপজেলার ঘোড়ামারা গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন তার প্রিয় দল জার্মানির সাড়ে তিন কিলোমিটার পতাকা বানিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন। পরবর্তীতে জার্মান ফুটবল দল চ্যাম্পিয়ন হলে বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত নিজে ঘোড়ামারা গ্রামে আমজাদের বাড়িতে ছুটে গিয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। সেই সময় তাকে জার্মান জাতীয় দলের অফিসিয়াল ফ্যান ক্লাবের আজীবন সদস্যপদ, একটি জার্সি, একটি ফুটবল ও একটি সার্টিফিকেট দেয়া হয়। এ বছর আমজাদ হোসেন নিজের প্রিয় দল, জার্মানীর পতাকার দৈর্ঘ্য আরও দুই কিলোমিটার বাড়িয়ে সাড়ে ৫ কিলোমিটার করলেও তার ইচ্ছা ২০২২ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত জীবিত থাকলে মাগুরা-যশোর সড়কের মাগুরা থেকে সীমাখালী পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার জার্মানির পতাকা টানাবেন তিনি।

ফুটবলপ্রেমী সমর্থক হিসেবে এই পাগমালীটা আমরা বেশ উপভোগ করি। এই পাগলামী হয়তো আমাদের সমর্থক দলগুলোকে এইবার ফুটবল বিশ্বকাপ ২০১৮ জিতিয়ে দিবে।