স্পয়লার-ফ্রি রিভিউ পড়া বা লেখা কোনোটার মধ্যেই মজা নেই। এটা অনেকটা ওইরকম যে আপনি রেস্টুরেন্টে গিয়ে স্টেক অর্ডার করেছেন, কিন্তু সেটা না ছুঁয়ে স্যতে ভেজিটেবলগুলো খেয়ে চলে আসলেন। এসব রিভিউ হয় সাধারণত এমন— অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পারফরমেন্স ভালো বা খারাপ ছিলো, চিত্রনাট্য আরেকটু ভালো হতে পারতো, আবহ সংগীত মানানসই আর ক্যামেরার কাজ প্রশংসনীয় ধরনের। এ ধরনের রিভিউ লেখা খুব কঠিন। তাই আমি সবসময় স্পয়লারযুক্ত রিভিউয়ের পক্ষে। কিন্তু বছরের সবচে’ প্রতীক্ষিত মুভিটির ব্যাপারে স্পয়লারযুক্ত রিভিউ দেয়াটা কোনো যুক্তিতেই উচিৎ নয়। যে মুভির টিকিট সংগ্রহের জন্য এই বাংলাদেশের মতো দূর দেশেও দুর্দশা ব্যাপক। মানুষ এ মুভির টিকিটের জন্য ভোররাত থেকে লাইন ধরেছে আর না-পাওয়াদের হাহাকার কান পাতলেই শোনা যায় আকাশে-বাতাসে। এরকম মুভির স্পয়লার দেয়া যে সমীচিন নয়, এই জ্ঞানার্জনের জন্য চীনে যাবার দরকার নেই। তাই রিভিউ নয়, ইনফিনিটি ওয়্যার দর্শন পরবর্তী রিঅ্যাকশন বলতে পারেন একে।
ইনফিনিটি ওয়্যার-এর গ্লোবাল হাইপ তৈরির পেছনে এর মার্কেটিং টিমের প্রশংসা যতটুকুই করি কম করা হবে। মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স (এমসিউ)-এর দশ বছর পূর্তির ব্যাপারটি নিয়ে এমনভাবে প্রচারণা চালিয়েছে যে এমনকি যে দর্শকটি ‘সিভিল ওয়্যার’ দিয়ে এমসিউ-এর সাথে প্রথম যুক্ত হয়েছে, তারও মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে “ইনফিনিটি ওয়্যার কেনো দেখবো না? দশ বছর ধরে এর জন্য অপেক্ষা করে আছি!” আবার বরাবরের মতো এবারও ইনফিনিটি ওয়্যার-এর জন্য বাংলাদেশি মানুষের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহের ইস্যু নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। না হলেই বরং আশ্চর্য হতাম। এবারও আমি বরং বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে যেতে চাই। শুধু একটা কথা জানিয়ে। আদতে, মানুষ মুভিতে কী খোঁজে? মুভিতে খোঁজে বিনোদন। এ বিনোদনের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। তবে পুরোবিশ্বের দর্শকদের একটা বড় অংশের জন্য বিনোদনের সংজ্ঞা- ধুমধারাক্কা অ্যাকশন, এক্সেজারেটেড ইমোশন, আর ভরপুর নাচা-গানা। অর্থাৎ যে ধরনের বিনোদন মোটাদাগে উসুল করা যায়। তারা হলে যাবেন সেসবের জন্যই। অন্ধকার থিয়েটারে দুই-আড়াই ঘণ্টা ঝিমাতে তারা চান না। নোলানের ‘ডানকার্ক’-ও তো বেশ হাইপ্ড মুভিই ছিলো। ওই মুভি দেখতে কিন্তু এদেশে দর্শক উপচে পড়েনি। সারাবছর সিনেপ্লেক্স আর ব্লকবাস্টারে কিন্তু এমন অনেক হলিউডি মুভিও চলে যেগুলোর রেগুলার শো-তে দর্শকের কমতির কারণে চালাবে কি চালাবে না সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয়। সেখানে দুর্দান্ত মার্কেটিংয়ের বদৌলতে ‘অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়্যার’ বোঝাতে সক্ষম হয়েছে অ্যাকশন প্যাক্ড এই মুভিটি হচ্ছে এমনই মুভি যার জন্য দশ বছর অপেক্ষা করা যায়। ফলাফল? এই জোম্বি অ্যাপোক্যালিপ্স!
এবার আসি কেমন অবসান হলো দশ বছরের প্রতীক্ষার? কিঞ্চিত কোটা-সুবিধার সুযোগে অ্যাপোক্যালিপ্সের অংশ হতে হয়নি, দেখে ফেলতে পেরেছি ইনফিনিটি ওয়্যারের ঢাকা প্রিমিয়ারে, অফিশিয়াল রিলিজের আগের দিনই। দেখে যা বুঝলাম বিনোদনে ভরপুর মুভির সংজ্ঞানুযায়ী নাচা-গানার ব্যাপারটিই খালি নেই, তারপরও অ্যাকশন আর ইমোশনের দুর্দান্ত কম্বিনেশন ‘ইনফিনিটি ওয়্যার’। ঠিক যেমনটা ‘বেশিরভাগ’ দর্শকের প্রত্যাশা। ১৪৯ মিনিটের রানটাইমে একটা পুরো মিনিটের জন্য হাই তোলার সুযোগ নেই। খুবই ফাস্ট স্টোরিটেলিং। সবসময়ই কিছু না কিছু ঘটছে। চমকগুলোও কমিকবুকের মতোই। বলছি কি, আপনার মনেই হবে কমিকবুকের পাতাগুলোই যেনো ফ্রেম বাই ফ্রেম চোখের সামনে ধরা পড়ছে। আর প্রতিটি চরিত্রের পারফরমেন্স? আলাদা করে বলার কিছু নেই। দুই শার্লককে (রবার্ট ডাউনি জুনিয়র আর বেনেডিক্ট কামবারব্যাচ) পর্দায় একসাথে ও মুখোমুখি দেখতে পারাটা একটা বলার মতো অভিজ্ঞতা ছিলো বৈকি। ওদিকে স্পাইডারম্যানের নতুন স্যুট অসাধারণ। এর বাড়তি ফিচারগুলো বেশি দারুণ। এমনকি আয়রনম্যানের স্যুটেরও নতুন কিছু ফিচার দেখা যাবে। স্কারলেট উইচ আর ভিশনের মধ্যকার কেমিস্ট্রি জমে উঠেছে আরো। এর আগে ভেঙে যাওয়া অ্যাভেঞ্জার্সের সদস্যদের পুনর্মিলনীর সিকোয়েন্সগুলো মার্ভেল-সুলভ হিউমার দৃশ্যেরও অবতারণা ঘটেছে একদম যথার্থ পরিমাণে। ক্রেডিট গো’জ টু স্পাইডারম্যান, আয়রনম্যান ও স্টারলর্ড। ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ব্ল্যাক উইডো-র এন্ট্রি দৃশ্য কিংবা ব্ল্যাক প্যান্থারের ওয়াকান্ডায় ঘটা মহাযুদ্ধ (এ যুদ্ধের ইঙ্গিত ট্রেলারেই আছে, তাই স্পয়লার হবার সুযোগ নেই) প্রতিটিই তাকলাগানো। তবে দু’টো ক্যারেক্টারকে মিস্ করতে হয়েছে। কোন দু’জন? বলতে চাইছি না। আর থানোস? এর আগে একটা মুভিতেও নিজের ভয়ংকর প্রতাপের চিহ্ন না রেখেও কেনো এই সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের সবচেয়ে পরাক্রমশালী ও ভয়ংকর ভিলেন বলা হচ্ছিলো থানোসকে, তার উত্তর মুভিতেই পেয়ে যাবেন। আমার ব্যক্তিগত মত- অ্যাভেঞ্জার্স নয়, এই মুভিটি আসলে থানোসেরই। দেখলেই বুঝবেন। এখন অনেকে বলবেন, এই কথা তো রুশো ব্রাদার্স অনেক আগেই বলে দিয়েছেন। তাদেরকে বলবো, নিজে না দেখে আমি আরেকজনের কথায় বিশ্বাস করি না। তা সে তুমি যে ব্রাদার্স-ই হও না কেনো। তাহলে কথা দাঁড়াচ্ছে এই, সুপারহিরো বা ফ্যান্টাসি মুভির ফ্যান হলে ইনফিনিটি ওয়্যার দেখতেই হবে। ডিসি-র অনুরাগী হয়েও বলছি।
এখন একটা প্রশ্ন। ‘ইনফিনিটি ওয়্যার’ কি শুধু ওই বিশ্বের ‘বেশিরভাগ’ দর্শকের জন্যই? বোদ্ধা বা ছিদ্রান্বেষী দর্শকের জন্য কি কিছু নেই? সেটা জানার জন্য এ সময়টা উপযুক্ত নয়। স্পয়লারযুক্ত রিঅ্যাকশনের জন্য তোলা থাকুক।
আর ক্লাইমেক্সের কথা কী বলবো? দ্য এন্ডিং উইল লিভ ইউ স্পিচলেস! কথা দিচ্ছি, মুভির ঘটনাপ্রবাহের সাথে একাত্ম হয়ে থাকলে শেষ কয় মিনিট ‘হা’ হয়ে থাকতে হবে। সবমিলে, দশ বছর পূর্তির মুভিতে অ্যাকশন-ইমোশনের যেমন রোলার-কোস্টার রাইড প্রত্যাশা করেছিলেন, ইনফিনিটি ওয়্যার দেখতে গিয়ে পাবেন তারচেয়ে বেশিই। যদিও এন্ডিং দেখে আমি নিজে খানিকটা আশাহত। তাতে কি আসে যায়। আর হ্যাঁ, জানেনই তো। এন্ড ক্রেডিট ভেসে উঠলেও সিট ছেড়ে ওঠা বারণ। তা সেটা যতো দীর্ঘই হোক না কেনো। এন্ড ক্রেডিট সিনেও দু’টো বড় চমক উপস্থিত।
তো এই ছিলো ইনফিনিটি ওয়্যার দর্শন পরবর্তী রিঅ্যাকশন। এরপরও বলতে বাধ্য হচ্ছি, যতো হম্বিতম্বিই করি, রিঅ্যাকশন প্রদানে ‘ম্যাক্সিমব্যাডি’র অ্যাক্যুরেসির ধারেকাছেও যেতে পারিনি।