এক সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক ঘটককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘চলচ্চিত্র নির্মাণে কী ভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন ?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একটি জিগজ্যাগ পথ ধরে ফিল্মে এসে পড়েছি। বাবার ইচ্ছে পূরণ হলে একজন ইনকাম-ট্যাক্স অফিসার হতাম। কিন্তু সেই চাকরিটি পেয়েও আমি ছেড়ে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিই। চাকরিতে থাকলে আজ কমিশনার বা অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল হতাম, হয়তো। কিন্তু এখন আমি শুধুই একটি রাস্তার কুকুর।’
ঋত্বিক কুমার ঘটক আরও বলতেন, ‘চিত্রনির্মাতা দুই ধরনের, এক দল পরিচালক, আরেক দল স্রষ্টা। আমি স্রষ্টার দলে।’ নিজের চলচ্চিত্র সম্পর্কে, নিজেকে স্রষ্টা ভাবার মতো লোক বিশ্বে খুব কমই আছেন, ঋত্বিক তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
ঋত্বিক ঘটক ছিলেন একজন আগুনের ফুলকি, যে ফুলকি যেখানে পড়বে সেখানেই ছাই হয়ে যাবে। সেই আগুনের ফুলকিকে যিনি প্রতিনিয়ত সহ্য করেছেন তিনি হলেন সুরমা ঘটক। ঋত্বিকের সহধর্মিণী, যাকে ঋত্বিক ‘লক্ষী’ সম্বোধন করতেন। বিয়ের পর ঋত্বিক সম্পর্কে সুরমার মন্তব্য ছিল, ‘এতো আনকম্প্রোমাইজিং শিল্পী, কখনো কাজ থাকবে, কখনো কাজ থাকবে না। কখনো ছবি চলবে, কখনো ছবি চলবে না। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিজেকে রাখা যাবে না।’
সুরমা ঘটক দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিজেকে রাখেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেনও। প্রচণ্ড অর্থাভাবে সংসার চলতো তাদের, কারণ ঋত্বিক কখনোই সংসারিক ছিলেন না। টাকার কথা উঠলেই তিনি বলতেন, ‘লক্ষ্মী, টাকাটা তো থাকবে না, কাজটা থাকবে। তুমি দেখে নিও, আমি মারা যাওয়ার পর সব্বাই আমাকে বুঝবে।’
সুরমা নদীর দেশে শিলং পাহাড়ের মেয়ে সুরমা ঘটক। আর ঋত্বিক ছিলেন কলকাতার। দু’জনই কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। পার্টির সাংস্কৃতিক সংঘ গণনাট্য করতে গিয়ে দুইজনের পরিচয় ঘটে। সেই সময় গণনাট্য সংঘে ঋত্বিক ঘটক সুরমাদের ক্লাস নিতেন। মার্ক্স, লেনিন সম্পর্কে পড়াতেন। সুরমাও মার্ক্সবাদী দীক্ষায় দীক্ষিত। সাধারণ কোনো নারী তিনি নন। কমিউনিস্ট পার্টির জন্য ১৮ মাস জেলও খেটেছেন। শিলং এর সেইসব স্মৃতি, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন ‘শিলং জেলের ডায়েরি’ বইয়ে।
বিয়ের পর ভালোই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু একের পর এক ঋত্বিকের ছবি ফ্লপ করছিল। হতাশার সাথে সাথে ঋত্বিকের মদ্যপ হওয়ার মাত্রা বাড়তে থাকে। ঘর, বাইরে সব জায়গায় ঋত্বিক মদ্যপ হয়ে থাকতেন। অর্থাভাবে তখন সুরমা তিন সন্তান ছেলে ঋতবান, মেয়ে সংহিতা ও শুচিস্মিতাকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান। সেই সময় বাবার কাছ থেকে টাকা এনে ঋত্বিকের হাতে দিতেন তিনি।
ঋত্বিক বোহেমিয়ান ও একরোখা এই কথা পুরো ইন্ডাস্ট্রি জানে। বোম্বেতে দিলীপ কুমার অভিনীত ‘মধুমতি’ ও ‘মুসাফির’-এর কাজ ছেড়ে দেয়া, রাজেশ খান্নার মুখের ওপর স্ক্রিপ্ট ছিঁড়ে উড়িয়ে দেয়া এইসব ঋত্বিকের জন্য কিছুই না। ১৯৬৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী নিজে তাঁকে পুনেতে এফটিআইআইতে ভাইস প্রিন্সিপাল করলেন। ঋত্বিক সেই চাকরিও ছেড়ে দিলেন। ঋত্বিক সুরমাকে বলতেন, ‘দশটা-পাঁচটা গিয়ে বসে থাকতে হবে। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু পয়সার জন্য এইসব করতে হবে। এইসব আমার জন্য না।’
ঋত্বিক জানতেন তিনি আগাগোড়া একজন চলচ্চিত্র শিল্পী। যার নেশা ছিল চলচ্চিত্র বানানো। চলচ্চিত্রের সাথে কোনো রকম আপোষ তিনি করতেন না। ঋত্বিক বলতেন, ‘আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব যে, ইট ইজ নট এন ইমেজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে হাতুড়ি মেরে বোঝাব যে, যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই থিসিসটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি, সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে এলিয়েন্ট করব প্রতি মুহূর্তে। যদি আপনি সচেতন হয়ে উঠেন, ছবি দেখে বাইরের সেই সামাজিক বাধা, দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে উঠেন, আমার প্রচেষ্টাকে যদি আপনার মধ্যে চাপিয়ে দিতে পারি তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।’
এরকম আপোষহীন চলচ্চিত্র পরিচালকের সাথে প্রতিমুহূর্তে টিকে থেকেছেন সুরমা ঘটক। যদি সুরমা ঋত্বিককে না বুঝতেন, প্রতিনিয়ত শরীরী বা অশরীরী ভাবে তাঁর পাশে না থাকতেন তবে তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণ ব্যহত হত। হয়তো আমরা ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বা ‘সুবর্ণরেখা’র মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র কখনোই পেতাম না। এইসব সম্ভব হয়েছে সুরমা ঘটকের কল্যাণে।
ঋত্বিকের সব কাজ সংরক্ষণ, অসমাপ্ত ছবির রিল, অপ্রকাশিত লেখার পাণ্ডুলিপি উদ্ধার ও সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল সুরমা ঘটকের উপর। শুধু ঋত্বিকের প্রতি দায়িত্ব পালনই নয়, সুরমা ঘটক নিজের অভিজ্ঞতাকে ‘শিলং জেলের ডায়েরি’, ‘পদ্মা থেকে তিতাস’, ‘ঋত্বিক’ ও ‘সুরমা নদীর দেশে’ নামে বইতে লিখেছেন।
যে ঋত্বিককে আজকে আমরা পেয়েছি তার মূলে রয়েছেন ঋত্বিকের লক্ষী, ঋত্বিকের জীবনের মূল নায়িকা সুরমা ঘটক। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকার পর সুরমা ঘটক ৯২ বছর বয়সে মারা যান।