শাড়িতে তাবৎ বাঙালি মেয়েকেই অপরূপ লাগে। ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রয়োজনে এবং যে কোন উৎসবেই নিয়ম করে শাড়ি পরার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল আমার। উৎসব-উদযাপনে জামদানি সম্ভবত সকলেরই প্রথম পছন্দ। যদিও ছোটবেলায় মা খুব একটা পরতে দিতেন না এই বিশেষ শাড়িগুলো।
শাড়ির গল্পের বদলে বরং মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। একদিন খুব সকালে চা হাতে পত্রিকা পড়ছিলাম। তখনই আসলে জানতে পারি, ভারতের জামদানি ছাড়াও ফজলি আম, নকশিকাঁথাসহ আরও বেশ কিছু পণ্যের স্বত্ব দাবির বিষয়টি। যারপরনাই বিস্মিত হয়ে বসে পড়লাম অনলাইনে। খুঁজতে লাগলাম বিষয়টির বিস্তারিত। খুঁজতে গিয়েতো আরো অবাক! যতদূর বুঝতে পারি তা হল, ভৌগোলিক নির্দেশক আইন (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেটর বা জিআই অ্যাক্ট) এর আওতায় কিছুদিন আগে ভারত ‘কালনা’ জামদানি এবং ‘উপাধা’ জামদানি নামে দুটি শাড়ির নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করেছে। সেই তালিকায় বাংলাদেশের আরো কিছু প্রসিদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী পন্য, ফজলি আম, নকশীকাঁথা, শীতলপাটিও আছে। অথচ এর প্রতিটিই আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব পণ্য। এদের সংরক্ষণে দীর্ঘদিন কোন আইন না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের স্বত্ব চলে গেছে ভারতের হাতে।
আইন নিয়ে কোন কালেই আগ্রহী ছিলাম না এবং তা নিয়ে কাজ করার প্রশ্নও আসে আরো পরে। কিন্তু যে দুটো বিষয় আমাকে নাড়া দিয়েছিলো তা হল, প্রথমত, খসড়া হয়ে পড়ে থাকা আইন কেন এতো সময় নেবে পাস করতে? দ্বিতীয়ত, জামদানির প্রতি আমার ব্যক্তিগত ভালোবাসা।
বাংলাদেশের জামদানির একেবারেই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা অননুকরনীয়। সেখানে ভারতের জামদানির মেধাস্বত্ব দাবি করাইতো পুরোপুরি অযৌক্তিক। এবং প্রতিটি বিষয়েই সরকারকে দোষারোপ করার সময়ে কিন্তু আমাদের মানে নাগরিকদের উদাসীনতাকেও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। আমরা কেন বারেবারে ভুলে যাই, আমরাই তো এই দেশের সরকার? আমরা সবাই মিলেই তো এই দেশ, বাংলাদেশ।
সুতরাং সিদ্ধান্ত নিলাম, শুধু সমালোচনা না। যার দায়িত্ব তার সাথে দেখা করতে হবে। তাকে জানাতে হবে বিষয়টি। যেই ভাবা সেই কাজ। বন্ধুদের সাথে নিয়ে কোন ধরনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই হাজির হয়ে গেলাম শিল্প মন্ত্রণালয়ে। সাহস করে সরাসরি সাক্ষাতই করে ফেললাম তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার সাথে। তাকে জানালাম জামদানি নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার কারণগুলো। মাননীয় মন্ত্রী অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। আশ্বাস দিলেন সংসদে আইন পাসের উদ্যোগ নেওয়ার।
হাসিমুখে ফিরলাম, বুক ভরা আশা নিয়ে। যদিও অন্যরা বলতে লাগল, “এতো সহজ? বললেন, আর তোমরা তা বিশ্বাস করে চলে আসলে?” “সাত বছর তো হল কেবল, আরও সাত বছর হয়তো অপেক্ষা করতে হবে!” “এদেশ দিয়ে না, কিচ্ছু হবেনা!” আরও এমন কত কথা!
কিছুটা নিরাশা, কিছুটা শঙ্কা নিয়ে আইন প্রনয়ণ সংক্রান্ত অগ্রগতির প্রতিদিনের আপডেট নেওয়া তখন আমাদের রুটিন হয়ে গেল। এরই মাঝে সারা দেশ ঘুরে অন্যসব ঐতিহ্যবাহী পণ্যের তালিকা প্রনয়ণের কাজও শুরু হয়ে গেল। পরিকল্পনা হল, তালিকা দেওয়া হবে মন্ত্রনালয়ে, যাতে আইন পাস হওয়ার পর আর এক মুহূর্তও দেরি না করেই শুরু হয় অন্য সকল ঐতিহ্যবাহী পণ্যের নিবন্ধনের কাজও। সেটাও খুব একটা সহজ বিষয় ছিলো না। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে তালিকা তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল কিছু টাকার, বেশ খানিকটা সময়ের এবং অনেক অনেক সাহসের। কি আর করা? অগত্যা, সাহসকে সঙ্গী করেই লেগে পড়লাম ঐতিহ্যবাহী পণ্যের তথ্য ভান্ডার তৈরির কাজে। এরই মাঝে ২০১৩ সালের ৬ নভেম্বরে জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে উপস্থিতির ডাক পড়লো। সকালবেলায় শিল্প মন্ত্রনালয় থেকে ফোন। আজই নাকি বহুল প্রতীক্ষিত আইনটি পাস হবে সংসদে। শিল্প মন্ত্রীর বিশেষ আমন্ত্রণ আমাকে আবেগে আপ্লুত করে তোলে। চূড়ান্ত উত্তেজনা নিয়ে জীবনে প্রথম বারের মতো গেলাম জাতীয় সংসদ ভবনে। নিজ চোখে দেখলাম সেই আইনটির পাস হওয়া, যার জন্য এতো কিছু! কিছুটা স্বস্তি, কিছুটা ভালো লাগা আর অনেক অনেক প্রত্যয় ফিরলাম বাসায়। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, আরো আগে জানতে পারলে হয়তো আরো আগেই এই দিনটি আসতে পারতো। সেদিন আরো একটি বিষয়ে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম, আর তা হল, নিজের মাঝের বিশ্বাসটুকু সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে পিছিয়ে পড়ে থাকতে হয়না।
মার্কেটিং-এর শিক্ষক হিসেবে একটা কথা খুব সহজেই বলতে পারি যে, জামদানি আভিজাত্যের প্রতীক। এই শাড়িটির কিন্তু বিশেষ একটি সেগমেন্ট বা বাজার আছে। সোজা বাংলায় জামদানি একটি প্রিমিয়াম বা অভিজাত পণ্য। কিন্তু বর্তমানে, জামদানির বাজার বৃদ্ধি ও অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য নাইলনের সুতায় মেশিনে তৈরি শাড়ি জামদানির নামে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। যেগুলো দামে আবার অনেক সস্তা।
সুতরাং মনে প্রশ্ন জাগে। জামদানি রক্ষা করতে গিয়ে আমরা নিজেদের জামদানি হারিয়ে ফেলছি নাতো? সবার জন্য জামদানি- এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জামদানির বিশেষ সেই সেগমেন্ট (প্রিমিয়াম) থেকে সরে আসছি নাতো? নকশার পরিবর্তন বা ভিন্নতা আনতে গিয়ে জামদানির বিশেষ জ্যামিতিক নকশা বা মোটিফ হারিয়ে যাচ্ছে না তো? দাম কমিয়ে সবার ব্যবহারের উপযোগী করতে গিয়ে জামদানির কোয়ালিটির সাথে আপোষ করছি নাতো?
দাম ও মান কমিয়ে দিলে মসলিনের মত জামদানিও কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। মসলিনের মতো জামদানিও তখন শুধু জাদুঘরেই দেখতে পাওয়া যাবে। এই ক্ষেত্রে, ভৌগোলিক নির্দেশক আইন (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেটর বা জিআই অ্যাক্ট) জামদানিকে দিতে পারে এই সুরক্ষা।
কিছু পরিকল্পনা করা যেতে পারে এখন থেকেই, যেমন,
- ১। মেশিনে জামদানি তৈরি করা বন্ধ করা।
- ২। শুধু দাম কমানোর জন্য জামদানির সুতোয় অন্য সুতোর মিশ্রণ বন্ধ করা। জামদানির সুতার গুণগত মানে আমরা যেন আপোষ না করি।
- ৩। জামদানিকে সহজলভ্য করতে গিয়ে জামদানির নিজস্বতাটুকু নষ্ট না করে বরং শিল্পটিকে একই রকম রেখে এক্সক্লুসিভভাবেই ক্রেতার সামনে আনা।
- ৪। উৎসব ও বিশেষ দিনগুলোতে জামদানি পরতে উৎসাহ দেওয়া। সেক্ষেত্রে দেশের জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউজ এবং ফ্যাশন ডিজাইনারদেরকে জামদানি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। জামদানি মানে তো কেবল ছয় গজের শাড়িই নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
- ৫। জামদানির নিজস্ব মোটিফ ও প্যাটার্নের নিজস্বতা শুধু শাড়িতে সীমাবদ্ধ না রেখে, শার্ট, ফতুয়া, স্কার্ফ, ব্যাগ, ওয়ালম্যাটেও ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
জামদানি, বাংলাদেশের। এই সত্যটি অস্বীকারের কোন উপায় আর কারো নেই। বাঙালির উৎসবের উদযাপনে জামদানিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সমস্ত ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকলভাবে অভিজাত এই জামদানির ব্যবহার জামদানিকে বাংলাদেশের একটি ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে বিশ্বে যেন প্রতিষ্ঠা করে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।