পায়ের উপর ফুলটস বল। লেগে আলতো করে ঘুরিয়ে দিয়ে কেবল দৌড়ই নয়, রীতিমতো উল্লাস শুরু করলেন মুশফিকুর রহিম। করবেন নাই-বা কেন! বাংলাদেশ যে কেবল তাদের নিজেদের ইতিহাসেরই সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জিতলো না, আন্তর্জাতিক কুড়ি ওভারি খেলার ইতিহাসেরই চতুর্থ সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জিতলো। এই রান তাড়ার মাহাত্ম্য আরো বেড়ে যায়, যখন জানা যায় এটা শ্রীলঙ্কার মাটিতে সর্বোচ্চ রান তাড়া তো বটেই, এমনকি কোনো উপমহাদেশীয় দলেরও সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের ঘটনা।
তবে মুশফিকুর রহিম যখন চোখ কুঁচকে ভুরু উঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলেন, ধারাভাষ্যকার ছাড়া আর কেউ-ই হয়তো পরিসংখ্যানের এই সব খটোমটো তথ্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন না। বাংলাদেশের দর্শকরা তো নয়ই। তাদের কাছে এ জয়ের মাহাত্ম্য যে অনেক। দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজে দাপুটে শুরুর পর হঠাৎই যে বাংলাদেশ জিততে ভুলে গিয়েছিল, এই জয় দিয়েই সেই পরাজয়ের বৃত্তের অবসান ঘটেছে। যদিও তারচেয়েও বড় হয়ে উঠেছে হাথুরে-ফ্যাক্টর। সে আলাপ নতুন করে আবার করার কিছু নেই। মোদ্দা কথা, আচমকাই নাটক করে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া হাথুরুর বর্তমান দলকে তাদেরই মাটিতে অমন দুর্দান্তভাবে হারানোর আবেগটা যে কেবল দর্শকদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, মুশফিকের প্রতিক্রিয়ায় যেন তারই প্রচ্ছন্ন আভাস মেলে।
আর সেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়েই প্রেমাদাসার মাঠে মুশফিক ফিরিয়ে আনলেন মিরপুরের স্মৃতি। সেখানে এই ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি অভিষেক হয়েছিল নাজমুল ইসলাম অপুর। এর আগে শেষ বিপিএলে অপু কেবল তার বোলিং দিয়েই নয়, দর্শকদের মাতিয়েছিলেন নিজের কোবরা-উদযাপন দিয়েও। সেই একই উদযাপন দেখা গিয়েছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টুয়েন্টি সিরিজেও। দ্বিতীয় ম্যাচে সিরিজ জেতার সাথে সাথে কোবরা-উদযাপনটাও যেন কেড়ে নিতে চেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। কিংবা বলা যায় ভেংচে দিয়েছিল। এক অনবদ্য ইনিংস খেলে সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কেবল ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়টাই বাংলাদেশকে এনে দেননি মুশফিকুর রহিম, ফিরিয়ে নিয়েছেন সেই কোবরা-উদযাপনও। মাথার সামনে দুহাত তুলে ধরে কোবরার মতো ছোবল মারা এই উদযাপন যে সামনে বেশ কিছুদিন বাংলাদেশের দর্শকদের আলোচনার বিষয়বস্তু, বা বলা উচিত উল্লাসের বিষয়বস্তু হয়ে থাকবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অগ্রযাত্রার ইতিহাস বেশ অনেক দিন পাড়ি দিয়ে দিয়েছে। ক্রিকেটের কুলীন কুলের সদস্যই তো সে প্রায় দুই দশক ধরে। কাজেই বাংলাদেশ দলের এমনি আলোচিত উদযাপন আছে আরও। আবেগের বিচারে এদের কোনোটিকে পিছিয়ে রাখাটাও বেশ মুশকিল। সেই তুল্যমূল্য বিচারের জটিলতায় না গিয়ে, এই ঐতিহাসিক জয় উপভোগের সাথে সাথে সেই সব আলোচিত উদযাপনের স্মৃতিতর্পণ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলাটাই বরং আনন্দদায়ক।
২০০০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কুলীন কুলের সদস্য হিসেবে মাঠে নামলেও, প্রথম কয়েক বছর বাংলাদেশ ঠিক কুলীন কুলের বাকি সভ্যদের সাথে তাল মেলাতে পারছিল না। ব্যর্থতাই ছিল তখনকার টাইগারদের নিয়তি। কিছুদিন পর মাঝে মাঝে বড় দলগুলোকে হারাতে শুরু করলে বাংলাদেশের নাম হয় জায়ান্ট-কিলার। বাংলাদেশ এই জায়ান্ট-কিলারের সবচেয়ে বড় পরিচয় দিয়েছিল ২০০৭ বিশ্বকাপে। হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন সেই বাংলাদেশ গ্রুপ রাউন্ডে বলে-কয়ে ভারতকে হারানোর পর সুপার এইটে হারিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকেও। পরে অবশ্য আয়ারল্যান্ডের জায়ান্ট কিলিংয়ের শিকারও হতে হয় বাংলাদেশকে। সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দলীয় নৃত্যে উইকেট পতন উদযাপন বেশ আলোচিত হয়েছিল।
এর আগে মোহাম্মদ রফিকের একটি উদযাপনও বেশ আলোচিত হয়েছিল। কেনিয়ার এক খেলোয়াড়কে আউট করে এক হাত কপালে ঠেকিয়ে, আরেক হাত কোমরের পিছে নিয়ে অনেকটা মুরগি-নাচের মতো একটা মুদ্রা করেছিলেন তিনি। পরে অবশ্য হাসতে হাসতে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ঢাকার লিগে কেনিয়ান ওই খেলোয়াড় এবং তিনি একই দলে খেলার সময় উইকেট পতনের পর তারা প্রায়ই এই মুদ্রা করতেন।
২০০৭ বিশ্বকাপের সাফল্যের পাশে বাংলাদেশের ২০১১ বিশ্বকাপের যাত্রাটা বেশ মলিনই ছিল। নিজ দেশে বিশ্বকাপ, অথচ বাংলাদেশ প্রথম রাউন্ডের বাধাই পেরোতে পারেনি। তবে দৈত্যবধ করেছিল ঠিকই। আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে আগের বিশ্বকাপের শোধ নেয়ার পর নেদারল্যান্ডের পাশাপাশি হারিয়েছিল কুলীন দল ইংল্যান্ডকেও। তবে আলোচিত উদযাপনটি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নয়, দেখা গিয়েছিল আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। তখনো কুলীন কুল থেকে ঢের দূরে থাকা আয়ারল্যান্ড সেই ম্যাচেও বাংলাদেশকে রক্তচক্ষু দেখাচ্ছিল। বাংলাদেশের বেঁধে দেয়া ছোট লক্ষ্য তো এক সময় তারা অনেকটা অনায়াসেই টপকে যাওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়েছিল। সেই সময়ে বাংলাদেশকে খেলায় ফেরান পুরো বিশ্বকাপেই ব্যাট হাতে অনুজ্জ্বল আশরাফুল। বল হাতে দ্রুত তুলে নেন দুটো উইকেট। উইকেট দুটোর প্রতিক্রিয়ায় তিনি মাঠে যে নাচ নেচেছিলেন, তা কেবল আলোচিতই হয়নি, মমতাজের গান জুড়ে দিয়ে করা একটা ভিডিও ভাইরাল হয়ে তাকে রীতিমতো ‘পোলা তো নয় যেন আগুনেরই গোলা’ তকমা দিয়ে দিয়েছিল।
মমতাজের গানের সঙ্গে ‘আগুনের গোলা’ আশরাফুলের নাচ
২০১৫ বিশ্বকাপ বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসই যেন বদলে দিয়েছে। এর আগে প্রায় বছর খানেক সাফল্যের জন্য বুভুক্ষু ছিল বাংলাদেশ। তারপর নেতৃত্বে ম্যাশের আগমন যেন আচমকাই সব বদলে দিল। মাশরাফির হাতে যেন পরশপাথর ছিল, বাংলাদেশ দলকে সেই পাথর ছুঁইয়ে বদলে দিলেন। রাতারাতি বাংলাদেশ হয়ে উঠল পরাক্রমশালী। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মতো প্রতিকূল কন্ডিশনে বাংলাদেশ পৌঁছে গেল কোয়ার্টার ফাইনালে। সেই ম্যাচে বাংলাদেশের পরাজয়ে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে এমনকি আইসিসির প্রেসিডেন্টের পদ থেকে আ হ ম মুস্তাফা কামাল ইস্তফাও দিয়ে দেন। সেই বিশ্বকাপে ম্যাশের কাপ্তানির পাশাপাশি সবার নজর কেড়েছিল তাসকিনের সাথে তার বুক ঠোকাঠুকি করে উদযাপনও। তাদের দুজনের নাম মিলিয়ে তার একটা দুর্দান্ত নামও দেয়া হয়েছিল- ম্যাশকিন।
এই বিশ্বকাপের পর থেকেই মাশরাফির কাপ্তানিতে যেন এক অন্য বাংলাদেশকে দেখা যেতে লাগল। দেশের মাটিতে সেই বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য। একের পর এক বাঘা বাঘা দলকে তারা দেশের মাটিতে এক-দিবসি ক্রিকেটে কুপোকাত করতে লাগল। পরে সেই উজ্জীবনী টনিক আর সাথে হাথুরুর প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে মুশফিকের নেতৃত্বে টেস্ট দলও অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো দলকে হারাতে লাগল। আর ইংল্যান্ডকে হারানো টেস্টটাতেই এসেছিল সর্বশেষ ভীষণ আলোচিত উদযাপন।
সেই সিরিজে টেস্টের আগে হয়েছিল ওয়ানডে দ্বৈরথ। তাতে এক ম্যাচে মাঠের বাকবিতণ্ডা গড়িয়েছিল খেলার শেষেও। তাতে বেন স্টোকস তামিমের সাথে খানিকটা ‘বেয়াদবি’ই করে বসেছিল। তাই নিয়ে স্টোকসের উপর তেতে ছিল পুরো বাংলাদেশ। তবে আচরণ যেমনই হোক, সিরিজে তার পারফর্মেন্স ছিল দুর্দান্ত। আর তাই শেষ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের জয়ের পথে বড় বাধা ছিল সে। সেই স্টোকসকে দুর্দান্ত এক ঘূর্ণি বলে রীতিমতো বোকা বানিয়ে বোল্ড করেন সাকিব আল হাসান। কেবল ম্যাচ জয়ের হাতছানিই নয়, ‘বেয়াদব’ স্টোকসের উইকেট বলে বুনো উল্লাসে মেতে ওঠে দেশের সকল দর্শক। কিন্তু এর আগেই তার সাথে ঠোকাঠুকি ম্যাচ রেফারি পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কাজেই মাঠে খেলোয়াড়দের উল্লাসে বেড়ি পরানো ছিল। সেই বেড়ির মধ্যে থেকেই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার করলেন দুর্দান্ত এক ব্যতিক্রমী উদযাপন। সামরিক কায়দায় এক লম্বা স্যালুট ঠুকে দিলেন।
সাকিবের সেই স্যালুট কেবল ভাইরালই নয়, অনেকের ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার-কাভার ফটোতেও ঝুলে ছিল বহুদিন। মুশফিক অবশ্য সাকিবের মতো অতো জনপ্রিয় (!!) নন। কাজেই তার এই কোবরা-উদযাপন হয়তো তেমন ঝোড়ো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না। তবে শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়দের মনে এই উদযাপন হয়তো ইতিমধ্যেই ঝড় তুলে ফেলেছে। আর সেই ঝড় যে শ্রীলঙ্কার সাথে বাংলাদেশের ফিরতি ম্যাচটাকে গনগনে করে তুলবে, হাথুরু-ফ্যাক্টরে আরো ঘি ঢালবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সেই ফিরতি সাক্ষাতেও কোবরা-উদযাপন টাইগারদেরই থাকুক, আপাতত প্রত্যাশা সেটাই।