ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব : অন্তত বাড়ছে তো…

৯ দিন। ৬ ভেন্যু। ৬৪ দেশের ২১৬টি সিনেমা। একাধিক ভারতীয় ও ইরানি নির্মাতার উপস্থিতি। যে তালিকায় আছেন এমনকি অপর্ণা সেনও। সাথে সাথে দেশে চতুর্থবারের মতো নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা সম্মেলন এবং প্রথমবারের মতো এশিয়ান ফিল্ম ক্রিটিকস অ্যাসেম্বলি। সব মিলিয়ে ষোড়শ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন হিসেবে নিতান্ত মন্দ হয়নি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হয় অজস্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। সেগুলোতে দেশ-বিদেশের নানা ধরনের নানা ঘরানার চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। মানুষ পরিচিত হয় চলচ্চিত্রের বৈচিত্র্যের সাথে। ফলে তাদের চলচ্চিত্র রুচির উন্নয়ন-উত্তরণ ঘটে, চলচ্চিত্র জ্ঞানের পরিধিরও বিস্তৃতি ঘটে।

এটি নাহয় চলচ্চিত্র উৎসবের একটি পিঠ। মুদ্রার অন্য পিঠও তো আছে। গুরুত্বও সম্ভবত সে পিঠেরই বেশি। একটি অর্থবহ চলচ্চিত্র উৎসব সেসব দেশের চলচ্চিত্র প্রেমী-দর্শক-বোদ্ধা-কর্মী-সমালোচক-পরিচালক-প্রযোজক-শিল্পী- সবার মিলনের অম্লমধুর ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এই মিলনমেলা যেমন তাদের অপরিচয়ের দেয়াল ঘোঁচাতে সাহায্য করে, তেমনি তাদের পেশাদার পরিমণ্ডল বিস্তৃত করতেও গুরুতর ভূমিকা রাখে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর এই দায় আরো বেশি। কারণ আমাদের দেশে এই অপরিচয়ের দেয়াল আরো কঠোর। পেশাদার পরিমণ্ডলে ব্যাপারটা আরো গুরুতর। অথচ সেই দায় পালনের জন্য আমাদের হাতে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আছেই মাত্র অল্প ক’টি, হাতে গোনা। মেরেকেটে পাঁচটিও না। তারই অন্যতম রেইনবোর এ উৎসবটি।

ফলে ফাঁকা মাঠে হাতে গোনা এই কয়েকটি উৎসবের সম্ভাবনা যেমন অমিত, তার বিপরীতে প্রত্যাশার বেলুন সেভাবে ফোলানোটা বেশ মুশকিলও বটে। কারণ উৎসবগুলোর বাস্তবতা। অল্প কয়টি উৎসবের সবগুলোই নিয়মিত হচ্ছে বটে, কিন্তু সুষম বৃদ্ধিটা ঠিক ঘটে উঠছে না। এমনই উৎসবগুলোর অন্যতম রেইনবোর এই উৎসব। প্রচার-প্রচারণা কিংবা সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার হিসেবে অন্যতম অগ্রগণ্য। সময়ের সাথে উৎসবটির কলেবর তো বৃদ্ধি পাচ্ছেই, সেই সাথে সম্প্রতি বেড়েছে পৃষ্ঠপোষণা পাওয়াও। ফলে দ্বিবার্ষিক উৎসবটি বেশ কয়েক বছর ধরেই হয়ে উঠেছে বার্ষিক আয়োজন। মূল আয়োজনের সাথে ইতোমধ্যেই যুক্ত হয়েছে দুটি অতিরিক্ত আয়োজনও।

কিন্তু তারপরও কোথায় যেন উৎসবটিতে অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে, কোথায় গিয়ে যেন সুরটা ঠিক তারে বাঁধা যাচ্ছে না, প্রাণের স্পন্দনটা ঠিক বেজে উঠছে না। আর তাই এমন বিশাল আয়োজনেও উৎসব প্রাঙ্গণ নিয়মিতই খাঁ খাঁ করছে। অল্প কিছু চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীতে শ খানেক মানুষের জমায়েত হচ্ছে বটে, কিন্তু সামগ্রিক উপস্থিতিতে ভাটার টান ফুরোচ্ছে না। একটা উৎসব প্রাঙ্গণে আয়োজকদের অনর্থক কলকাকলিতে কর্মচাঞ্চল্যের আবহ সৃষ্টি হওয়ার কথা, ঢুকলে একটা উৎসবমুখর পরিবেশের আনন্দ আগতদের ছুঁয়ে যাওয়ার কথা, চারপাশের চলচ্চিত্রগন্ধী একটা আবহে ডুবে যাবার কথা, সেটা পূর্ণতর আহ্বানে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ডাকতে পারছে না।

সংক্ষেপে বললে, বর্ষীয়সী এই উৎসবটি তার বয়সের তুলনায় এখনো চলচ্চিত্র দেখানোর মাধ্যমে দর্শকদের উত্তরণের সম্ভাবনাকেও সেভাবে বাস্তবায়িত করতে পারছে না, আবার চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের সার্থক মিলনমেলাও হয়ে উঠতে পারছে না।

তবুও এমন একটি আয়োজন নিয়ে কেবলই হাহাকার করা অনুচিত। না হওয়ার চেয়ে এই যে আরো বেশি করে নিয়মিত হচ্ছে, অন্তত কলেবরে-আয়োজনে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাও তো কম নয়। সকলের না হোক, একটা অংশের চলচ্চিত্র কর্মী, প্রেমী, পরিচালক, সমালোচক, বোদ্ধাদের তো অন্তত মিলনমেলার ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে। তরুণদের জন্য কিছু আয়োজন তো থাকছে। সেখানে তারা কিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য তো পাচ্ছে। কিছু দর্শক তো কম টাকায় বড় পর্দায় দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পাচ্ছে। অভাবের বাজারে এসবও তো নিতান্ত কম পাওয়া নয়।