স্যার জেইমি ল্যানিস্টার, একটি অসম্পূর্ণ জীবন।

জোফরি বেশ একটি মোটা বই উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখছে। বইটিতে ইতিহাস এর বিখ্যাত নাইট, কিংস গার্ডদের অসমান্য বীরত্ব আর কীর্তির বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। হঠাৎ জোফরির চোখে পড়লো, তার আঙ্কেল কিংস গার্ডের কমান্ডার স্যার জেইমি ল্যানিস্টার (যে কিনা কিং স্লেয়ার বিশেষণেই অত্যাধিক পরিচিত) নিয়ে লেখা আছে মাত্র এক পৃষ্ঠা। তার জন্য বরাদ্ধ বাকি পৃষ্ঠাগুলো খালি। তা দেখে মুহুর্তেই জোফরি নিজের আঙ্কেল এর দিকে ছুঁড়ে দিলো বিদ্রুপ মাখানো কিছু উক্তি। জবাবে স্যার জেইমি আহামরি কিছু বলল না, কোনো প্রতিবাদ করল না। এইমাত্রই যে অপমানটা তার মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে তা যেন হজম করে গেল।

জেইমি ল্যানিস্টার

জেইমি ল্যানিস্টার, এল্ডার সন অফ লর্ড টাইউইন ল্যানিনস্টার! এ ম্যান উইথ আউট অনার। যাকে একবাক্যে পুরো সেভেন কিংডম এর অন্যান্য লর্ড, নাইটরা তাচ্ছিল্য করে। ‘দ্যা কিংস্লেয়ার!’ কেননা স্যার জেইমি ‘রবার্ট’স রেবেলিয়ন’ এর শেষ সময় কিংসগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সকল প্রকার শপথ ভঙ্গ করে নিজের রাজা এয়রিস টারগ্যারিয়ানকে হত্যা করেছে, তাও পেছন দিক থেকে। কিন্তু আসলে কি তাই? হ্যা আসলেই হত্যা করেছে। কিন্তু হত্যা করে যতটুকু দোষ, অপবাদ ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে তাকে, তার কি ঠিক ততটুকুই প্রাপ্য ছিল?

মাত্র পনেরো বছর বয়সে লর্ড সামনার ক্র্যাকহ্যাল, স্যার আর্থার ডাইন, স্যার ব্যারিস্তান সেলমিদের সাথে ‘কিংসউড ব্রাদারহুড’-দের দমন করবার লক্ষ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে জেইমি। যুদ্ধে ব্রাদারহুড পরাজিত হওয়ার পর যুদ্ধের ময়দানেই জেইমিকে, তার আদর্শ ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব স্যার আর্থার ডাইন নিজেই ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ‘ওয়েস্টরস’ এর ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে নাইট খেতাব প্রাপ্ত যোদ্ধা স্যার জেইমি ল্যানিনস্টার।

একদিকে লর্ড টাইউইন চাচ্ছিলেন তার উত্তরাধিকারী বড় ছেলে জেইমিকে, রিভাররেন এর ‘হাউজ টালি’ র বড় মেয়ে লিসার সাথে বিয়ে দিতে। জেইমি ব্যাপারটি জানতে পারলে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কেননা তার সাথে তারই যমজ বোন সার্সেই এর প্রেম শুরু হয়ে গিয়েছিল। সার্সে, জেইমিকে পরামর্শ দিল কিংসগার্ডে যোগ দিতে, তাহলে তাকে আর লিসাকে বিয়ে করতে হবে না।

ঠিক অপরদিকে ম্যাড কিং এর মাথায় তখন তারই ‘হ্যান্ড অফ কিং’ বন্ধু টাইউইনকে শায়েস্তা করবার পরিকল্পনা আটছে। এয়রিস, টাইউইন দ্বন্দ্ব তখন চরম পর্যায়ে। অবশেষে টাইউইনকে সবচেয়ে বড় আঘাতটা করতে সক্ষম হলেন ম্যাড কিং। জেইমিকে নিজের কিংসগার্ড এ অন্তর্ভুক্ত করলেন রাজা, যাতে জেইমি শপথ এর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং টাইউইন তার উত্তরাধিকারীকে হারিয়ে ফেলে। রাজার এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্ধ টাইউইন ‘ হ্যান্ড অফ কিং ‘ পদ ছেড়ে দেয় ।

স্যার জেইমিকে কিংসগার্ড বানিয়েও শান্তি হল না পাগল রাজার, পড়ল বরং মধুর সমস্যায়। টাইউইন এর নির্দেশে জেইমি তাকে হত্যা করবে, সবসময় এমন দুশ্চিন্তায় থাকত সে, তাই জেইমিকে এদিক সেদিক মিশনে পাঠানো শুরু করল। কিন্তু দেখা যেত, জেইমি সব মিশন বীরত্বের সাথে সম্পন্ন করে ঠিকই ফিরে আসতো। তা দেখে রাজা আশাহত হত। এদিকে জেইমি নীরবে নিজের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলল, কিন্তু তার অস্বস্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।

একসময় শুরু হল ‘রবার্ট’স রেবেলিয়ন’। প্রিন্স রেয়গার যখন যুদ্ধে যাচ্ছিল, জেইমি গিয়ে রীতিমতো প্রিন্সকে অনুরোধ করলো যেন তাকে প্রিন্স নিজের সাথে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যায় এবং সুপারিশ করলো অন্য কোনো কিংসগার্ডকে রাজার পাশে থাকার দায়িত্ব দিয়ে যেতে। কিন্তু রেয়গার তার সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করল এবং তাকে রাজার পাশাপাশি নিজের স্ত্রী এরিয়া মার্টেল ও সন্তানদের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে গেল। প্রিন্স এর এমন সিদ্ধান্তে মনে মনে ভীষণ হতাশ ও রাগান্বিত হল জেইমি।

ট্রাইডেন্ট এ রবার্ট এর হাতে রেয়গার এর মৃত্যুর পর যুদ্ধের ফলাফল অনেকটা নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় স্যার জেইমি বারবার এয়রিস কে  আত্মসমর্পণ করবার জন্য অনুরোধ করল। এয়রিস তার কোনো কথা শুনল না, শুনল গ্র্যান্ড মায়েস্ত্রার পাইসেল এর কথা। ‘কিংস ল্যান্ডিং’ এর গেইটের বাইরে তখন বিশাল বহর নিয়ে টাইউইন ল্যানিনস্টার অবস্থান নিয়েছিল। ‘গ্র‍্যান্ড মায়েস্ত্রা’র পাইসেল তখন গেইট খুলে দেয়ার পরামর্শ দিলেন, জানাল রাজার পুরোনো বন্ধু লর্ড ল্যানিস্টার ‘কিংস ল্যান্ডিং’ রক্ষা করতে প্রস্তুত। রাজা এই কথা বিশ্বাস করল। আর গেইট খুলে দেয়ার নির্দেশ দিল। কিন্তু গেইট খোলার পর উল্টো পুরো কিংস ল্যান্ডিং চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলো ল্যানিস্টার সৈন্যরা। এদিকে পুরো ‘রেড কিপ’ প্রাসাদ এর দায়িত্ব তখন স্বাভাবিকভাবে জেইমির হাতে। কিন্তু সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার আর সুযোগ বা সময় কোনটিই নেয়, জেইমি রাজাকে আবারো অনুরোধ করল আত্মসমর্পণ করার জন্য। পাগল রাজা ফিরতি বার্তায় জেইমিকে উল্টো নির্দেশ দিল তার বাবার মাথাটা নিয়ে তার সামনে যাওয়ার জন্য এবং নিজেকে বেঈমান নয় প্রমাণ করার জন্য। এই কথাটা শুনে নিজের রাগ সামলাতে পারল না জেইমি। প্রথমে রাজার হ্যান্ড রোসার্টকে হত্যা করলেন। তারপর সকল শপথ, অঙ্গীকারকে তুচ্ছ করে পেছন দিক থেকে সেই ‘ম্যাড কিং’কে হত্যা করলেন। হত্যা করলেন সেই নিষ্ঠুর, পাগল রাজাকে যে জীবন্ত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারতো। অথচ এরকম একটা পাগল, নিষ্ঠুর লোককে হত্যার জন্য তার জীবনে এতো অপবাদ! সেই লোকটিকে কি বাঁচানোরও কম চেষ্টা করেছিলেন জেইমি!

রবার্ট ব্যারাথিয়ন রাজা হওয়ার পর কিংসগার্ড এর দায়িত্বে বহাল থাকলেও, ‘কিংস্লেয়ার’ এর অপবাদ যেন পিছু ছাড়লো না তার। যদিও জেইমির বীরত্ব নিয়ে কখনো কেউ দ্বিমত পোষণ করার চেষ্টা করেনি। জেইমি অন্তত ভেবেছিল রবার্ট বা অন্যরা না হোক, সেভেন কিংডম এর সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি নেড স্টার্ক থেকে সে প্রাপ্য সম্মানটা পাবে। কিন্তু লর্ড স্টার্ক সম্মান দেয়া তো অনেক পরের ব্যাপার, তার কথা আমলেও নিলেন নাহ।

সোর্স – এইচবিও

‘Tell me, if I’d stabbed the Mad King in the belly instead of the back, would you admire me more?’ – Ser Jaime Lannister to Lord Ned Stark

মাত্র পনেরো বছর বয়সে ‘নাইট’ উপাধি প্রাপ্ত, সতেরো বছর বয়সেই কিংস গার্ড এর সদস্য হওয়া, অসংখ্য যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতায় বীরত্বের সাথে লড়াই করে জিতে আসা ব্যক্তিটির, একটি হত্যার জন্য তার সমস্ত অর্জন কি অস্বীকার করা হবে? কতটুকু অসম্মানইবা তার প্রাপ্য ছিল!

তার জীবন কি সেই বইয়ের খালি পৃষ্ঠার মতোই অপূর্ণ থেকে যাবে!

“So many vows. They make you swear and swear. Defend the king. Obey the king. Obey your father. Protect the innocent. Defend the weak. What if your father despises the king? What If the king massacres the innocent? It’s too much. No matter what you do, you’re forsaking one vow or another.” – Ser Jaime Lannister