জন্ম-মৃত্যুতে মিলে গেলেন গুরু-শিষ্য…

২০১৭ সালের আগস্ট কেড়ে নিয়েছে দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনের সবচেয়ে বড় তারকাকে, আমাদের নায়করাজকে। তাও আবার ২১ আগস্টের সন্ধ্যায়! আচমকা পুরো জাতিকে স্তব্ধ করে দিল নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যু। সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে, ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অব্স্থায় মৃত্যুবরণ করেন রাজ্জাক।

তাঁর সাথে সমাপ্ত হয়ে গেল ঢাকার চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের। যে ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে, উজালা-তে (১৯৬৬) পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারী হিসেবে। অবশ্য তিনি একদম শুরুতেই ঠিক করে রেখেছিলেন, নায়কই হবেন। সে জন্য কোলকাতায় জন্মানো রাজ্জাক ১৯৬১-তে এমনকি পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে ফিল্মালয়ে কিছুদিন সিনেমা নিয়ে পড়াশুনাও করেন। ফিরে এসে চেষ্টা করেছিলেন কোলকাতাতেও।

এরই মধ্যে ঢাকায় যাত্রা শুরু করে চলচ্চিত্র শিল্প। ওপারের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বও তখন চরমে। এসব মিলিয়ে ১৯৬৪ সালে রাজ্জাক চলে আসেন ঢাকায়। উজালা-র পরে সুরুর বারা বাংকভির আখেরি স্টেশন (১৯৬৬), বশীর হোসেনের ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন (১৯৬৬) ও মুস্তাফিজের ডাকবাবু-তে (১৯৬৬) ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয়ও করেন। কিন্তু ওই নায়ক হওয়াটা আর হয়ে উঠছিল না।

বেহুলা দিয়েই নায়কের চরিত্রে অভিষেক নায়করাজের

আমরা কথায় কথায় কুরোসাওয়া-মিফুন, সত্যজিৎ-সৌমিত্র, ফেলিনি-মাসত্রোইয়ানির কথা বলে বলে আকুল হই। যদিও আমাদের এই এফডিসিতেও হয়েছে এমন জুটি। সে জুটি গড়েছিলেন নায়করাজের ওস্তাদ জহির রায়হান এক অসামান্য অভিনয় শিল্পীকে সাথে নিয়ে। যার নাম আব্দুর রাজ্জাক। আমরা যাকে চিনি শুধু রাজ্জাক নামেই।

জহির রায়হানের বেহুলার বুকলেটের কভার

রাজ্জাককে প্রথম নায়ক চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন জহির রায়হান। এভাবে মিলে গেলেন ঢাকার চলচ্চিত্রের দুই কিংবদন্তি; কিংবদন্তি পরিচালক ও কিংবদন্তি নায়ক। জহির রায়হানের বেহুলা (১৯৬৬) দিয়েই শুরু নায়ক রাজ্জাকের পথচলা। ষাটের দশকে অভিষিক্ত রাজ্জাক দশক ঘুরতে না ঘুরতেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-দর্শকদের হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নেন। আর কয়েক দশকের মধ্যে তিনি তার জায়গা এতটাই পোক্ত করে ফেলেন, তিনি আর নায়ক থাকেন না, হয়ে ওঠেন নায়করাজ।

বেহুলার পরে রাজ্জাক-সুচন্দা জহির রায়হানের আনোয়ারা-তেও অভিনয় করেন

বেহুলার পরে জহির রায়হান রাজ্জাক-সুচন্দা জুটিকে নিয়ে বানান আনোয়ারা (১৯৬৭)। আর ১৯৭০ সালে তিনি নির্মাণ করেন ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র- জীবন থেকে নেয়া। চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রে অবশ্য ছিল রওশন জামিল অভিনীত খলচরিত্রটি। আর চলচ্চিত্রটিতে নায়ক-নায়িকা বা খলচরিত্র সবাইকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল বাঙালির স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষা। তবে জহির রায়হানের এই অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্রেরও নায়ক ছিলেন রাজ্জাক, তার বিপরীতে সুচন্দা। চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করার সময় এমনকি রাজ্জাককে পরিচালক জহির রায়হানের সাথে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা ধরেও নিয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক।

ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া-র নায়ক চরিত্রেও অভিনয় করেন রাজ্জাক

রংবাজ থেকে শুরু করে প্রবল প্রেমিক, সৎ পুলিশ অফিসার কিংবা স্কুলের দপ্তরি, সব ধরনের চরিত্রেই রূপালি পর্দা রীতিমতো দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু জীবন থেকে নেয়া-র মতো তার কোনোটিই নয়। এক সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক নিজেই বলে দেন, ছবিটাতে অভিনয় করতে না পারলে সারা জীবন এই আফসোস বয়ে বেড়াতে হতো তাকে।

ওস্তাদের জীবন থেকে নেয়া সিনেমায় শিষ্য রাজ্জাক

অবশ্য মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ‘ওস্তাদ’ জহির রায়হানের সাথে একটা জায়গায় ভীষণ বৈপরীত্য সৃষ্টি করে ফেললেন রাজ্জাক। কিংবা এটা হয়তো বৈপরীত্য নয়, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ওস্তাদের সাথে মিলতে চাইলেন তিনি। ভাগ্যদেবতা বোধহয় আগে থেকেই জানতেন, জহির রায়হানই হবেন বাংলাদেশের শেষ শহীদ বুদ্ধিজীবী। মানে তিনি বাঙালির অনন্ত শোকের মাসে মৃত্যুবরণ করতে পারবেন না। তাই তাঁর জন্মই হয় এই শোকের মাসে, ১৯ আগস্ট। তাঁর সঙ্গে মিলিয়েই বোধহয় নায়করাজ মারা গেলেন ২১ আগস্ট। এভাবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কেবল বাঙালির অনন্ত শোকের মাসের শোকের পাল্লা আরেকটু ভারিই করলেন না নায়করাজ, মিলে গেলেন ওস্তাদ জহির রায়হানের সাথেও। জন্ম-মৃত্যুতে মিলে গেলেন ঢাকার চলচ্চিত্রের দুই কিংবদন্তি।