“Shall we begin?”
অবশেষে গেম অফ থ্রোনসের সপ্তম সিজন শুরু হয়ে গেল। এক ঘণ্টার সিজন প্রিমিয়ারটি গত কয়েক সিজন প্রিমিয়ারের চেয়ে ছিল অনেক বেশি ঘটনাবহুল। অন্যান্য সিজন প্রিমিয়ারে বেশ কিছু নতুন চরিত্র আনা হতো, তাতে কিছুটা সময় যেতো। এবারে বলার মতো মাত্র একটিই নতুন চরিত্র এসেছে, অন্যদিকে আগের সিজন ফিনালেতে সার্সেইয়ের পাগলামিতে এক ধাক্কায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মরে গেছে বা গুরুত্ব হারিয়েছে। আর মনে হলো গল্পের গতিও কিছুটা বেড়েছে, যেহেতু এবার দশের জায়গায় এপিসোড মোটে সাতটি।
[দ্যা টুইনস]
এপিসোডের শুরু টুইনসে লর্ড ওয়াল্ডার ফ্রে’র ডাইনিং হলে। সেই কুখ্যাত ডাইনিং হল, দেখলেই মনে পড়ে রেড ওয়েডিংয়ের কথা। গত সিজনের ফিনালেতে আরিয়া ওয়াল্ডার ফ্রে’কে নিজেরই ছেলের মৃত মাংসে বানানো পাই খাইয়ে গলা কেটে মেরে ফেলেছিল, ঠিক যেভাবে ফ্রে’রা কেইটলিন স্টার্ককে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল। তাই শুরুতেই দেখা গেল আরিয়া ওয়াল্ডার ফ্রে সেজে মুখে একটা শয়তানি হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। হলভর্তি ফ্রে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। নব্বুই বছরের বুড়োর বংশ তো একেবারে ছোট না, আট বউয়ের ঘরে ২২টা ছেলে, তাদের প্রত্যেকের ঘরে গড়ে চার-পাঁচটা করে ছেলে, তাদেরও কেউ কেউ বিয়ে করে নাতির ঘরে পুতি পয়দা করে ফেলেছে। এত বড় বংশকে একবারে নিশ্চিহ্ন করতে আরিয়া তাই ভোজের আয়োজন করেছে। সবাইকে বিশেষ (বিষ মেশানো) মদ পেয়ালায় ঢেলে দিতে বলে ফ্রে-রূপী আরিয়া ফ্রে-সুলভ কথা দিয়েই শুরু করলো। যদিও একটু পরেই সে মনে করিয়ে দিল এই হলে কয়েক বছর আগে কী হয়েছিল। এক গর্ভবতী রাণীকে পেটে ছুরি মেরে খুন করা হয়েছিল, অনুগত থাকার শপথ করেও রাজাকে চারদিক থেকে তীর মেরে হত্যা করা হয়েছিল, মায়ের সামনে পুত্র ও পুত্রবধূকে মেরে শেষে মাকেও মেরে ফেলা হয়েছে। ওয়েস্টেরোসের সবচেয়ে পবিত্রতম নিয়মের একটি ছিল অতিথির সুরক্ষা, কোন অতিথি যদি তোমার ঘরের নুন আর রুটি খায়, তাহলে তাকে নিজের জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করতে হবে। ওয়াল্ডার ফ্রে ও তার ছেলেদের প্রায় সবাই এই নিয়মকে সেদিন ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল। আরিয়া নিজেই যার সাক্ষী, নিজের মৃত ভাইয়ের গলাকাটা লাশের মাথায় গ্রে উইন্ডের মাথা বসিয়ে ফ্রে’দেরকে উল্লাস করতে দেখেছিল সে। এতদিন পরে সেটারই প্রতিশোধ নিল অবলীলায়, নিজের গায়ে একটি আঁচড়ও না লাগিয়ে।
“Leave one wolf alive and the sheep are never safe.”
নেকড়েশাবকেরা সবাই বড় হয়ে গেছে। আর তাদের মাঝে সবচেয়ে ঠাণ্ডা মাথার খুনী আরিয়া। সবাইকে মেরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভয়ার্ত মেয়েটিকে আরিয়া শান্ত গলায় বলল,
“When people ask you what happened here, tell them The North remembers. Tell them, Winter came to House Frey.”
এই দৃশ্যের সময় আরিয়ার মুখের অর্ধেকেরও বেশি যেভাবে আঁধারে ঢেকে ছিল তা দেখে একটু খারাপও লাগলো। কী মেয়ে, কী হয়েছে! তোমার শত্রুকে পরাজিত করতে গিয়ে তোমাকেও তার মতোই হয়ে যেতে হবে, এই আপ্তবাক্যটা সম্ভবত আরিয়ার বেলায় আসলেই সত্যি।
[দ্যা ওয়াল]
নেকড়েশাবকদের বড় হয়ে ওঠার কথা বলছিলাম। ব্র্যান যে এখন নাইট কিংকে দেখে আগের মতো বিচলিত হয় না সেটাও তার প্রমাণ। মিরা রিড আর ব্র্যান ওয়ালে এসে পৌঁছেছে। পরনে ওয়াল্ডলিংদের পোশাক। দুজন ওয়াইল্ডলিংকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে স্বয়ং লর্ড কমান্ডার ডোলোরাস এড নেমে এসেছে ব্যাপারটা হজম করা একটু মুশকিল। স্বাভাবিক হতো যদি অজ্ঞাত কোন রক্ষী এসে জিজ্ঞাসা করতো, তারপর এড-এর কাছে ধরে বেঁধে নিয়ে গেলে সে নিশ্চিত হতো যে এরা ওয়াইল্ডলিং নাকি স্টার্ক ও রিড বংশের কেউ। এড যখন ব্র্যানের স্টার্ক হবার প্রমাণ চাইলো তখন ব্র্যান শান্তভাবে এড কোন কোন জায়গায় হোয়াইট ওয়াকারদের সাথে যুদ্ধ করেছে (পড়ুন পালিয়ে বেঁচেছে) সেটা উল্লেখ করলো। ভাবখানা এমন যে পেছনে নাইট কিং আসছে তার হাজার হাজার মৃতের বাহিনী নিয়ে আর আপনি কিনা আমি কোন বংশের সেইটা মিলানো নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছেন! যা হোক, মূল আশঙ্কা আসলে ব্র্যানের ওয়াল পার করার মাধ্যমে অশুভ কিছুর শুরু হল বোধহয়। গত সিজনে ওয়ার্গ করার সময় নাইট কিং ব্র্যানের হাত ধরেছিল। সেই কারণেই ব্লাডরেইভেন/থ্রি-আইড-ক্রোয়ের গুহায় তারা ঢুকতে পারে। ব্র্যানকে ব্যবহার করে সেই গুহাকে প্রতিরক্ষা দেয়া জাদু ভেঙে যায়। ধারণা করা যেতে পারে, এই একই ধরণের জাদু দিয়েই ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল। একারণেই লং নাইটের সময় নাইট কিং ও তার বাহিনী ওয়াল পার হতে পারে নি। এবার ব্র্যান নিজের অজান্তেই সেই জাদু বিচ্ছিন্ন করে দিল হয়তো। বিশেষত, এই এক এপিসোডেই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দুইবার (একবার জন, আরেকবার আর্চমেয়স্টার মারউইন) বলা হয়েছে যে ওয়াল সবাইকে রক্ষা করবে।
[উইন্টারফেল]
এই এপিসোডে পছন্দের দিক থেকে দুই নম্বর দৃশ্যগুলো উইন্টারফেলের। জন ও নর্থের সবাই মূলত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানে বেশ কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা হলো। ওয়ালে নাইটস ওয়াচে লোক লাগবে। বিশেষ করে পরপর দুই-তিনটা বড় যুদ্ধে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি অনেকেই মারা গেছে। এমনিতেই নাইট ওয়াচে লোকবল কম, ক্যাসল ব্ল্যাক ছাড়া ওয়ালজুড়ে ডানে-বামে রক্ষাপ্রাসাদগুলো জনশূন্য পড়ে আছে। শুধু সর্ব ডানে ‘ইস্টওয়াচ-বাই-দ্যা-সি’ আর সর্ব বামে ‘শ্যাডো টাওয়ার’-এ নামেমাত্র কয়েকজন প্রহরী আছে। টরমুন্ড ও ওয়াইল্ডলিংদেরকে জন ইস্টওয়াচ রক্ষাপ্রাসাদের দায়িত্ব দিল। টরমুন্ড উঠে দাঁড়িয়ে ঠাট্টাচ্ছলে লর্ড গ্লোভারকে বলল, এখন তাহলে তোমাদেরকে আমরা পাহারা দেব। হাজার হাজার বছর ধরে ওয়ালের উত্তর আর দক্ষিণের শত্রুতার ইতিহাস এখন মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। জনের পরবর্তী সিদ্ধান্তটি আরো যুগান্তকারী। সৈন্য বাড়াতে শুধু পুরুষই না, নারীদেরকেও সে অস্ত্রশিক্ষা দিতে বলল। ওয়েস্টেরোসের হিসাবে এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। এমন সামন্ততান্ত্রিক ও প্রবলভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের ভূমিকা অন্তরালেই থাকে, তা সে বংশ বড় হোক বা ছোট সাধারণ কৃষক। জন একবারে সেই জগদ্দল ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছে। এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনের জন্য নাইট কিংকে সমগ্র ওয়েস্টেরোসের নারীগণ ধন্যবাদ জানাতেই পারে! এই সিদ্ধান্তে সবার আগে একমত হল লিয়ানা মরমন্ট, এক কিশোরী। আর থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন বৃদ্ধ লর্ড গ্লোভার। রূপকার্থেও পরিবর্তন কারা আনে, আর কারা সেটার সাথে খাপ খাইয়ে নেয় তাও আমরা দেখে ফেললাম।
উত্তরে ওয়ালের পরেই যে দুইটি বড় প্রাসাদ সে দুটি হলো লাস্ট হার্থ আর কারহোল্ড। লাস্ট হার্থের লর্ড হাউজ উম্বার এবং কারহোল্ডের লর্ড হাউজ কারস্টার্ক। এরা উভয়েই উইন্টারফেলের যুদ্ধে বোল্টনদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল, স্টার্কদের বিরুদ্ধে। হাউজ-কারস্টার্কের সাথে রেষারেষির সূত্রপাত রব স্টার্কের সময় থেকে। আজকের পর্বে যে অ্যালিস কারস্টার্ককে দেখাল, তার বাগদত্ত রব স্টার্কের সাথে প্রথম যুদ্ধে গিয়েছিল। সে যুদ্ধে জেইমি ল্যানিস্টারের সাথে সংঘর্ষে সে মারা যায়। স্বভাবতই লর্ড কারস্টার্কের প্রতিশোধস্পৃহার কমতি ছিল না। জেইমি যখন বন্দি ছিল, তখন সে কয়েকবার বলেছিল তাকে মেরে ফেলতে। কিন্তু রব ও কেইটলিন সে পরামর্শে পাত্তা দেয়নি। জেইমিকে যখন কেইটলিন ছেড়ে দিল, তখন লর্ড কারস্টার্ক রাগের বশে ল্যানিস্টার ও ফ্রে হাউজের দুই বন্দি কিশোরকে মেরে ফেলে। এই অপরাধে রব তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং সে নিজেই সেটা কার্যকর করে। মূলত এরপরই কারস্টার্কের বাহিনী নর্থের ব্যাটালিয়ন ছেড়ে উত্তরে ফিরে আসে। টিভি শো-তে উম্বারদের লর্ড গ্রেটজন উম্বার রবের সাথে রেড ওয়েডিংয়ে মারা যায়, আর তার ছেলে স্মলজন উম্বার বোল্টনকে সমর্থন দেয়। উইন্টারফেলের যুদ্ধে সেও মারা গেছে। নেড উম্বার হল তার ছেলে।
জনের যুক্তি ছিল এক বা দুই প্রজন্মের অপরাধে হাজার হাজার বছর ধরে আনুগত্য ও বন্ধুত্ব বজায় রাখা কোন হাউজকে উচ্ছেদ করা অনুচিত। সানসা এখানে প্রকাশ্যেই জনের বিরোধিতা করে। তার মতে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের শাস্তি ও আনুগত্যের পুরস্কার দুটোই আরো বেশি হওয়া উচিত। যারা স্টার্কদের হয়ে লড়াই করেছে, তাদের কাউকে উম্বার ও কারস্টার্কদের প্রাসাদ পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হোক। একদিক দিয়ে দেখলে জন চিন্তা করছে ঐতিহ্যগতভাবে নর্থ তথা স্টার্কদের আদর্শ অনুযায়ী। জনের জায়গায় নেড বা রব একই সিদ্ধান্ত নিতো। অন্যদিক সানসা এতবছরে কিংস ল্যান্ডিং আর লিটলফিঙ্গারের শিক্ষা থেকে শিখেছে যে অন্তরে ক্ষুব্ধ মানুষকে একমাত্র ভয় দিয়েই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নর্থের একরোখা আনুগত্যের শক্তির ওপর ভর করে নেড বা রবের পেছনে হাজার হাজার সৈন্য দাঁড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার জন্য একজন সৈন্য বা একজন লর্ডই যথেষ্ট। এখানে মূলত জন ও সানসার বেড়ে ওঠার পরিবেশ কীভাবে তাদেরকে প্রভাবিত করেছে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নেতৃত্বের কৌশলগত কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই যা সবসময় সবখানেই সফল হবে। একজন নেতাকে তাই অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ ও উদ্বুদ্ধ করার ফলপ্রসূ পন্থা বেছে নিতে হয়। এই পরিস্থিতিতে সবাই হয়ত বহিঃশত্রুর হুমকিতে এমনিতেই ভয়ে আছে, তাই জনের সিদ্ধান্তটাই কাজে আসতে পারে। তবে হোয়াইট ওয়াকারদের হুমকি না থাকলে সানসার কৌশল অধিক ফলপ্রসূ হওয়ার কথা।
সানসা আর লিটলফিঙ্গারের দৃশ্যটা তুলনামূলকভাবে কিছুটা গতানুগতিক। লিটলফিঙ্গার কি চায় সেটা সানসা জানে, আর সানসা যে সেটা জানে এটাও লিটলফিঙ্গার জানে। আমরা সবাই জানি। সে এটাও জানে যে, এতে সানসা রাজি হবে না। আসলে এই দৃশ্যটা শুধু ভুলোমনা দর্শককে একটু মনে করিয়ে দেয়ার জন্যই রাখা হয়েছে হয়ত। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে এই পর্বে দর্শকের মুখে চামচ দিয়ে তুলে খাইয়ে দেয়া সংলাপের সংখ্যা একটু বেশিই। স্ক্রিনে দুইজন কথা বলছে যারা একই পরিস্থিতির মাঝ দিয়ে গিয়েছে, তারা কখনই এমন বিষয়ে কথা বলবে না যা তারা দুজনেই জানে। ব্রিয়েন আর সানসার সংলাপের শুরুটাই ধরা যাক। ব্রিয়েন বলছে, “লিটলফিঙ্গার এখানে এখনো আছে কেন?” সানসা উত্তর দিল, “কারণ আমাদের তাকে দরকার। সে ভেইলের সৈন্য এনে আমাদের সাহায্য করেছে।” এই কথাগুলো তো ব্রিয়েন জানেই, তাহলে সে প্রশ্নটাই বা করলো কেন, আর সানসাও সেটার উত্তরই বা দিচ্ছে কেন? মনে হয় দর্শকদের বুদ্ধি আর মনোযোগের ওপর নির্মাতারা আরেকটু ভরসা রাখতে পারতেন।
[কিংস ল্যান্ডিং]
জেইমি আর সার্সেইয়ের সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ছে। লম্বা একটা দৃশ্য শুধু তাদের সংলাপের মধ্য দিয়েই দুজনের মানসিক দূরত্ব প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। জেইমি যতবারই কিংস ল্যান্ডিং ছেড়ে গিয়েছে, ফিরে এসে দেখেছে সার্সেইয়ের সাথে তার মন-মানসিকতার দূরত্ব বেড়ে গেছে। কিংস ল্যান্ডিংয়ে সবাই তাকে তার পরিবার ও ক্ষমতার কারণে সমীহ করে। কিন্তু বাইরে জেইমির নাম এখনো কিংস্লেয়ার – অপমানজনক, ব্যক্তিত্বহীন, কাপুরুষ। বাইরে বেরিয়ে তাকে নিজ বুদ্ধি আর কৌশল দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যে তারা তাকে যা ভাবে, সে তেমন নয়। এর মাঝে সার্সেই ক্রমশই তার ক্ষমতা অর্জনের নেশায় কিছুটা কাণ্ডজ্ঞানহীনশূন্যের মতো আচরণ করেছে। এখানেও তাই ঘটলো। টমেনের ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছিল জেইমি, কিন্তু সার্সেই পুরোপুরি নাকচ করে দিল। জেইমির প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এত সংগ্রাম, এত রাজ্য জয় করে কী লাভ? কার জন্য? তাদের সব সন্তানরা মৃত। সার্সেইয়ের উত্তরটাও একগুঁয়ে এবং অহঙ্কারপূর্ণ। জেইমি তার সাথে একমত হয়েছে বলেও দর্শকদের মনে হবেনা।
এ পর্বের সবচেয়ে দুর্বল অংশ ছিল ইউরন গ্রেজয়। নির্মাতারা কী ভেবে তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন, বা কী সংলাপ লিখছেন, নাকি নিজেরাই ইউরনের নামে একটি চরিত্র বানিয়ে নিচ্ছেন-সেটা বোঝা দায়। তার ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা দেখে তাকে পাইরেটস অফ দ্যা ক্যারিবিয়ানের ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর চাচাতো ভাই বলে ভুল হচ্ছে। এখানেও সেসব দর্শক-ভুলানো সংলাপ পাওয়া গেলো। সাথে দু’চিমটি সস্তা কৌতুক।
[ওল্ডটাউন]
বেচারা স্যাম! এই অংশের দুটো দৃশ্য দেখেই ওর জন্যে মায়া হয়। এসেছিল পড়াশোনা করে বিরাট জ্ঞানী মেয়স্টার হতে। ভাগ্যের ফেরে মানুষের পায়খানা পরিষ্কার করতে হচ্ছে। তার দৈনন্দিন রুটিনের montage ভাল পরিচালনা/পাণ্ডুলিপির উদাহরণ। “Show, not tell”- আফসোস যে এই একই নিয়ম অন্যান্য জায়গায় কাজে লাগালে দর্শক-ভুলানো সংলাপ আরেকটু কমতো।
এখানেই এই পর্বের নতুন চরিত্রটির সাথে পরিচয় হলো, শক্তিমান অভিনেতা জিম ব্রডব্যান্ট অভিনীত আর্চমেয়স্টার মারউইন। যদিও বইয়ের রহস্যময় এই চরিত্রটির সাথে তার খুব বেশি মিল বোধহয় পাওয়া যাবে না। ওল্ডটাউন থেকে প্রশিক্ষিত মেয়স্টাররা প্রতিটি রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা মূলত দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক অর্থাৎ জ্ঞান ও বিজ্ঞানের মূল ধারাগুলোতে প্রশিক্ষণ নেয়। মারউইনের বেশ কিছু কথা উল্লেখযোগ্য। নাইটস ওয়াচের মতোই মেয়স্টাররা কোন নির্দিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা সকলেই ওল্ডটাউনের প্রতিনিধি। এর আগের জীবনে তারা কে কী ছিল সেটা জরুরি না। তাদের কাজ জ্ঞান আহরণ আর সে জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এই বিশ্বের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ। তাদের কারণেই সভ্যতা টিকে থাকে, কারণ প্রতিটি প্রজন্মের জ্ঞান তাদের মাধ্যমেই পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হচ্ছে।
“We are this world’s memory, Samwell Tarly. Without us, men would be little better than dogs. Don’t remember any meal but the last, can’t see forward to any but the next. And every time you leave the house and shut the door, they howl like you’re gone forever.”
এরকমই কোন এক মেয়স্টারের লেখা বই সংরক্ষিত এলাকা থেকে স্যাম লুকিয়ে নিয়ে পড়ে জানতে পারে ড্রাগনস্টোনের নিচে সমুদ্রতলে আছে অবসিডিয়ান আকরিক তথা ড্রাগনস্টোন। ড্রাগনস্টোন নিয়ে এর আগের পোস্টে বিস্তারিত লিখেছিলাম। লেখাটি এখানে-
[রিভারল্যান্ডস]
আরিয়ার সাথে ল্যানিস্টার সৈন্যদের এই দৃশ্যটা চতুর্থ বই ‘এ ফিস্ট ফর ক্রো’স’ পড়ার সময়ের অনুভূতি ফিরিয়ে আনবে। আরিয়া আর হাউন্ড রিভারল্যান্ডসের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর সময়েও এরকম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সাধারণ মানুষের কিছু কিছু চরিত্র উঠে এসেছিল। তাদেরকে দেখলে রাজা-রাণীদের যুদ্ধ আর লড়াইয়ের অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। রাজায় রাজায় যুদ্ধে সাধারণ মানুষ আসলে উলুখাগড়ারই সমতুল্য। যদিও এই দৃশ্যে ক্যামিও হিসেবে গায়ক এড শিরানকে নেয়া একেবারেই ঠিক হয়নি। কেউ অভিনয় না পারলে তাকে শুধুমাত্র সেলেব্রিটি স্ট্যাটাসের কারণে নিলে কিছুটা হলেও খাপছাড়া লাগে।
রিভারল্যান্ডসের পরের দৃশ্যটাই এই পর্বে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য! হাউন্ড স্যান্ডর ক্লেগেইন, লর্ড বেরিক ডনডারিয়ন, আর থোরোস অফ মিরসহ ব্রাদারহুড উইদাউট ব্যানার্স। বিশেষ করে হাউন্ডের চরিত্রের এত গভীর পরিবর্তনের এই দৃশ্য দেখে দর্শক মাত্রেই অভিভূত হবেন। ব্রাদারহুডের সবাই এসে যে বাড়িতে উপস্থিত হলো, সেটার মালিককে আগেও দর্শকরা দেখেছেন। ৪র্থ সিজনের ৩য় এপিসোডে এক কৃষক আর তার ছোট্ট মেয়ে স্যালি আরিয়া ও হাউন্ডকে আশ্রয় দিয়েছিল। হাউন্ড আর আরিয়া স্যালির বানানো স্যুপ গপগপ করে খেয়েছিল। পরদিন সকালেই সেই কৃষককে মেরে তার পয়সাপাতি কেড়ে নিয়েছিল হাউন্ড। তখন আরিয়া প্রতিবাদ করলে হাউন্ড বলেছিল, সামনে শীত এলে এরা দুজনেই না খেয়ে মারা যাবে। তখন এই পয়সা তাদের কোন কাজে লাগবে না। দৃশ্যটি এখানে আবার দেখতে পারবেন।
বাড়িটা দেখামাত্রই হাউন্ড চিনতে পেরেছে। শুধু তাই না, সে সময়ের সব কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। এই বাসায় যে একফোঁটা মদ নেই সেটা সেই কৃষকই বলেছিল। অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরার আগেই নিজেরাই আত্মহত্যা করেছে সে এবং তার মেয়ে। হাউন্ডের প্রতিটি মুখের ভঙ্গিতেই গ্লানি আর অপরাধবোধ ফুটে উঠছিল। তিন সিজন আগের হাউন্ড আর এখনের এই হাউন্ডের মাঝে কত ফারাক! অস্তিত্বের চূড়ান্ত কারণ কী- এই আদিম প্রশ্নটি আবারও ঘুরে এলো, আগেও বহুবার এসেছে। কেন কোন নিরাপরাধ নির্বিচারে মারা যায়, আর কেন জঘন্যতম মানুষও বেঁচে থাকে, যে মানুষ নামেরও অযোগ্য। কেন বেরিক ডনডারিয়ন বারবার মৃত্যু থেকে বেঁচে উঠেছে, আর কেনই বা নেড স্টার্ক বা সেপটন রে ওভাবে মারা যায়! একদিক দিয়ে দেখলে হাউন্ডের মতো করেই আরিয়া প্রশ্ন করেছিল। থোরোস অফ মিরকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে ধড় থেকে মাথা কেটে ফেলা কাউকে একবারের জন্য ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না। ঘটনাচক্রে হাউন্ড হয়ে উঠেছে মানবিক, অপরাধবোধে ক্লিষ্ট, নিজের স্বার্থ ছেড়ে অন্যের ভাল করার ইচ্ছাশক্তি যার মাঝে আছে-এমন এক চরিত্র। আর আরিয়া ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে ঠাণ্ডামাথার খুনি, যার খুনের পর খুন করতে চোখের পাতাটাও কাঁপে না।
“There’s no divine justice, you dumb c**t. If there was, you’d be dead, and that girl would be alive.”
– কথাটা কত কঠিন সত্য!
আগুনের ভেতরে অগ্নিদেবতার দেখানো ইশারা সামনে খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। যা ধারণা করা যায়, তা সত্যি হলে জনপ্রিয় একটি হাসিখুশি চরিত্রের করুণ পরিণতি হতে যাচ্ছে। আশঙ্কাটি মিথ্যা হলেই খুশি হবেন দর্শকরা। গভীর রাতে হাউন্ডের কবর খোঁড়া দেখে বইপড়ুয়া মন খুশিই হয়েছে। বই থেকে গল্প অনেক বদলে গেলেও নির্মাতা-লেখকরা বইয়ের হাউন্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।
[ড্রাগনস্টোন]
শেষ ৫ মিনিটে ড্রাগনস্টোনে ডেনেরিসের অবতরণের সম্পূর্ণ নির্বাক দৃশ্যটিও ভাল লাগবার মতো। ড্রাগনস্টোনকে এতদিন শুধু “পেইন্টেড টেবিলের” ঘরের ভেতর থেকে দেখিয়েছে। এখন বাইরে থেকে পুরো দ্বীপ আর সমুদ্রতট থেকে ধীরে ধীরে উঠে যাওয়া পাহাড়ি পথের শেষে প্রকাণ্ড প্রাসাদ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। শুধু একটা বিষয় মনে খচখচ করে। ড্রাগনস্টোন কৌশলগত দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দ্বীপ। কিংস ল্যান্ডিংয়ের বেশ কাছে, ব্ল্যাকওয়াটার বে-এর মুখে। এরকম একটা জায়গা এমন বিরান-অরক্ষিত কেন? ব্যারাথিওন সৈন্যবাহিনীতো থাকার কথা। স্ট্যানিস যাওয়ার সময়ে কাউকে না কাউকে এই প্রাসাদ পাহারার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, স্ট্যানিসের পরাজয় ও মৃত্যুর পর তারা আর এখানে নেই। অন্তত কিংস ল্যান্ডিংয়ের সৈন্যদের একটা ছোট দল এখানে থাকতে পারতো।
সব মিলিয়ে সূচনা হিসেবে জমজমাট পর্ব। প্রতিটি মূল চরিত্রের মাঝে নিজের শেকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রবণতাই মূল থিম বলে মনে হচ্ছে। ডেনেরিস আক্ষরিক অর্থেই নিজের মূলে ফিরে এসেছে। আরিয়াও তার পারিবারিক খুনের প্রতিশোধ নিচ্ছে। জন আর সানসা ক্রমেই নিজেদের পরিবারের নেতা হিসেবে গড়ে উঠছে। সার্সেই তার বাবার মতই হিংস্র শাসকের রূপ নিচ্ছে, যদিও টাইউইনের মত বিচক্ষণতা তার ভেতরে আশা করা ঠিক না। এমনকি স্যামও পয়ঃনিষ্কাশন ছেড়ে অবশেষে একটা কাজের কাজ করছে।