২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে একটি ধারাবাহিক নাটকের তিনটি পর্ব প্রচারের পর একজন পরিচালক ঠিক করলেন নিজের লেখা উপন্যাসের ধারাবাহিক নাট্যরূপ তিনি আর দেখাবেন না। বড় করে দৈনিক পত্রিকায় লিখলেন,
‘দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে আমার দম বন্ধ লাগছে। কীভাবে প্রতিবাদ করব তাও বুঝতে পারছি না। একজন লেখকের দৌড় তার লেখা পর্যন্ত। বিটিভিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের গাথা জোছনা ও জননীর গল্প প্রচার হচ্ছে। প্রতিবাদ হিসেবে এই গাথার প্রচার আমি বন্ধ করলাম। দেশ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার জন্য এখনো তৈরি না।’
লেখক-পরিচালকের নাম হুমায়ূন আহমেদ। দেশটার নাম বাংলাদেশ এবং ঘটনাটি ঘটেছিল বিমানবন্দরের লালন ভাস্কর্য অপসারণকে কেন্দ্র করে।
তারও বছর কুড়ি আগের এক ঘটনায় ফিরে যাওয়া যাক।
১৯৮৮-৮৯ সালের গল্প। রাষ্ট্র তখন জলপাই-জলপাই জপে মশগুল। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘পাকিস্তানি হানাদার’ নয়, শুধু হানাদার শব্দটা চালু। সেসময় শুরু হল ‘বহুব্রীহি’ নামের একটা ধারাবাহিক। প্রচার হত পনেরো দিন পরপর প্রতি মঙ্গলবার রাত ন’টায়। পুরা একঘণ্টার সে ধারাবাহিকের নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ। বহুব্রীহির মাধ্যমেই ‘তুই রাজাকার’ শব্দটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম প্রচার হয়।
নাটকটির শেষ দুই পর্বের পুরো অংশই জুড়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধের কথা। সোবহান সাহেবের বাসায় গ্রাম থেকে আসা আশ্রিত দুষ্টু লোক ইমদাদ খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে কুটুক্তি করার পর তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পুরো পরিবার। মামা তখন বুদ্ধি বের করেন। টেপ রেকর্ডারে ‘তুই রাজাকার’ রেকর্ড করে শোনানো হবে তিনটি টিয়া পাখিকে এবং তারা সেই গালি শিখে ফেলবে। দু’টো পাখি মারা গেলেও, তৃতীয় টিয়াটি এক সময় বলে উঠে ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’।
একটা টিয়া পাখিকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টাকে হুমায়ূন এক ধাক্কায় মানুষের ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসলেন। বহুব্রীহির শেষটাও হয়েছিল দারুণভাবে। খারাপ লোক ইমদাদ খন্দকার ভালো হয়ে গেলেন। ১৯৮৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের দিনে তাঁকে নিয়ে বৃদ্ধ সোবহান সাহেব বেরিয়ে পড়েন গ্রামের দিকে। ৬৮ হাজার গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ৭ পর্বের বহুব্রীহি।
এবারে তৃতীয় গল্প। কোন এক নদীর তীরের মফস্বল শহরের। সেখানে রেলওয়ের লাইনের শেষ সীমানা। প্রমত্তা নদীতে ভাসে বার্জ, তখনো সে শহরে পাটকল বন্ধের হাহাকার শুরু হয়নি। জিলা স্কুলের ক্লাস সেভেনের অসম্ভব আদ্র একটি কিশোর শুরু করল গল্প লেখা। কি ছিল তার লেখায়? সার্কিট হাউসের মাঠের পিছনে লুকিয়ে সিগারেটের সুখটান তাকে কোন কালো অক্ষরের স্পর্ধা দিত?
আচমকা জীবনানন্দ দাশকে হঠাৎ জী. দাশ বলে ডাকা শুরু করেছিল যে কিশোর- তার প্রেরণা ছিল কে?
উত্তর: হুমায়ূন আহমেদ।
মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ের এলোমেলো (ও অধিক সম্পাদিত) ইতিহাস নিয়ে নিজের পরিবারের বাইরে মাথা ঘামাতে সেই কিশোরকে প্রথম উৎসাহ দিয়েছিল কে?
উত্তর: হুমায়ূন আহমেদ।
এরপরে পাঠক হিসেবে সেই কিশোরটি বড় হয়েছে, তার সামনে খুলে গেছে ছাপার অক্ষরের মণি-মাণিক্যের গুপ্তঘর। সে আর হয়ত হুমায়ূনের কাছে কোন কারণেই ফিরে যায় না, ঠিক যেমন সে আর কখনো ফিরে যাবে না সেই আদ্র শহরে কিন্তু তার অন্তরেও নীপ বৃক্ষ বসত গড়ে। বাদল দিনে সেও ভাবে তার কোন একসময়ের অবশ্যপাঠ্য লেখকের মতো, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব, রাত বলেছে যাই।’