কিভাবে মৃত্যু হয়েছিল হুররম সুলতানের?

বেসরকারি টেলিভিশন দীপ্ততে প্রচারিত ‘সুলতান সুলেমান’ সম্ভবত এমুহূর্তে বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম টেলিভিশন সিরিজ। ‘ম্যাগনিফিশিয়েন্ট সেঞ্চুরি’ নামের মূল তুর্কি সিরিজটি বাংলায় ডাবিং এবং পরিমার্জনা করে প্রচার করছে টেলিভিশনটি। দর্শকপ্রিয় এই সিরিজটির অন্যতম প্রধান চরিত্র হুররম সুলতানকে নিয়ে একরকমের ঘোরের মধ্যে আছেন নারী দর্শকেরা। কিন্তু কজন জানেন- সামান্য দাসী থেকে সুলতানের প্রিয়তম স্ত্রী এবং অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী হয়ে ওঠা হুররমের উত্থান যেমন বিচিত্র, মৃত্যুও তেমনি রহস্যাবৃত।

‘হুররম’ নামটি তুর্কিদেরই দেওয়া। তাঁর প্রকৃত নাম আলেজান্দ্রা লিসোভস্কা। জেনে রাখা ভালো, হুররম মোটেও তুরস্কের কেউ ছিলেন না। ‘রোজেলেন’ ছিল তাঁর ডাকনাম, বিভিন্ন সময় লেখকরা এই নামটিকে এতটা ব্যবহার করেছেন যে, এটিই তাঁর প্রকৃত নাম বলে মনে করতে শুরু করে সবাই। হুররমের জন্ম ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের রুথেনিয়ায়, বাবা ছিলেন পাদ্রী।

হুররম ছিলেন ইউক্রেনের মেয়ে

রোজেলেন বা লিসোভস্কা, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তুর্কি রাজ্যে তার প্রবেশ সুখকর ছিল না। ১৫১০ সালের দিকে তাকে ক্রিমিয়ায় অটোমান কোর্টে বিক্রি করা হয় দাসী হিসেবে। সুলেমান তখন যুবরাজ, ছিলেন ক্রিমিয়ার গভর্নর। এর পরে তাদের পরিচয়, প্রেম, পরিণয়—সে তো এক মহাকাব্য!

সুলতান সুলেমানের সঙ্গে হুররমের সংসারের টাইমলাইন ছিল প্রায় ৫০ বছরের। এই সময়ের মধ্যে হুররম ৫ পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম দেন। এর মধ্যে হুররমের জীবদ্দশাতেই মারা যান তিন ছেলে। বাকি দুই ছেলে নিজেদের মধ্যে লড়াই বাঁধিয়ে বসেন সিংহাসন নিয়ে। এই লড়াইয়ে জয়ী পুত্র সুলতান সেলিম সিংহাসনে বসেন দ্বিতীয় সেলিম নাম নিয়ে। তার রাজত্বকাল ছিল ১৫৬৬-৭৪। হুররমের একমাত্র কন্যা মিহরিমা সুলতান ছিলেন অনেকটাই তাঁর মায়ের মতো। মায়ের প্রখর বুদ্ধিমত্তা, ক্ষিপ্র ব্যক্তিত্ব আর কর্তৃত্বের প্রতি আকর্ষণ—সবই বজায় ছিল মিহরিমার মাঝে!

ছদ্মনামে লেখা কবিতায় সুলেমান বারবার স্মরণ করেছেন হুররমকে

হুররমের জন্য সুলেমানের ভালোবাসা যে প্রগাঢ় ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হুররমের মৃত্যুর পর সুলেমানের লেখা কবিতায় (নিজের সময়ের নামকারা কবিও ছিলেন বটে সুলতান!) বারবারই উঠে এসেছে হুররমের অনুপস্থিতির কথা, সুলেমানের একাকীত্বের কথা, নিঃসঙ্গতার কথকতা। মজার বিষয় হচ্ছে, নিজের কবিতাগুলো সুলেমান লিখেছেন ছদ্মনামে। এই নাম ছিল ‘মুহিব্বি’, যার অর্থ হলো প্রেমিক বা প্রিয় বন্ধু। এই নামে লেখা কবিতাগুলো অনেকটা হুররমের জন্য সুলেমানের স্তুতি বা অফুরান প্রেমেরই আখ্যান।

হুররম সুলতানের মৃত্যু হয় ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে অসুস্থতাকে উল্লেখ করা হয় বটে, তবে সেটি কেমন অসুস্থতা ছিল, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এমনটা আঁচ করেই জীবনের শেষ দিনগুলোতে হুররম সেবামূলক কাজের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সেসময় পারিপার্শ্বিকও বিশেষ অনুকূলে থাকেনি তাঁর। অটোমানদের দোর্দন্ডপ্রতাপ এই রাণীর জীবনের শেষ সময়টা বেশ কষ্টেরই ছিল বলা যায়। এটি আসলেই কোনো অসুস্থতা নাকি এর পেছনেও কোনো ষড়যন্ত্র ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। সে হিসেবে হুররমের মৃত্যুর কারণ রহস্যাবৃতই বলা যায়।

সুলেমান কমপ্লেক্সে হুররমের সমাধিস্থল

সুলতান সুলেমানের মৃত্যু হয় ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে, ইস্তাম্বুলে সুলেমান কমপ্লেক্সে সমাহিত করা হয় দোর্দন্ডপ্রতাপ শাসককে। হুররমের সমাধিস্থলটিও ঠিক তাঁর পাশেই। সুলেমান কমপ্লেক্সে তাঁদের সমাধিস্থলটিও দেখবার মতোই।

লেখার ও ছবির সূত্র : দ্য গাইড ইস্তানবুল ও ডেইলি সাবাহ্‌