প্রতি ঈদের মতো এবারেও দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবরাখবর আসা শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে হাইওয়েতে মহাকালের মতো দীর্ঘ জ্যাম, ট্রেনের শিডিউলে ডিলে, লঞ্চের একটা টিকেটের জন্য হাহাকার। এবারে কি বাড়ি যাওয়া হবে? কপালে একটা দুশ্চিন্তার মোটা ভাঁজ পড়ে।
প্রতিদিনের চেনাজানা ক্লান্তিকর ঢাকা শহরটা ঈদের সময়ে বেশ আরামদায়ক একটা জায়গা হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু তাতে তো নাড়ির টানের তাগিদ এড়ানো যায় না। যাই বলুন না কেন, হোম ইজ হোয়্যার দ্য হার্ট ইজ!
বাড়ি ফেরার সংগ্রাম ঈদের মৌসুমে রূপ নেয় কঠিন এক অভিযানের, তবে তাতে সামিল হওয়াও যে বাধ্যতামূলক। একটা সময়, ধরুন আপনার ছোটবেলায়—‘দেশের বাড়ি’ যাওয়ার যে উচ্ছ্বাসটা ছিল, সেখানে আজ এক রকমের ম্যাচুরিটি চলে এসেছে সময়ের প্রয়োজনে। তাও বাড়ি না ফিরলে তো চলে না। ‘ঈদের বাড়ি যাচ্ছি না, ঢাকাতেই আছি’ যারা বলেন বা যাদের বলতে হয়, সবারই প্রকাশ্যে বা গোপনে এক দীর্ঘশ্বাস আসে। বাড়ি কী অদ্ভুত এক মায়ায় আমাদের আজীবন জড়িয়ে রেখেছে, তাই না!
নাড়ির টান অটুট থাকলেও ছোটবেলার বাড়ি আর সেই বাড়ি নেই, বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম আর গ্রাম নেই, চেনাজানা মানুষগুলোও বদলে গেছেন, অনেকে হয়ত চলে গেছেন বদলানোর সীমারই বাইরেই। বাড়ি ফিরলেও এখন দীর্ঘশ্বাস লুকোনোর জায়গা থাকে না। তাও যাদের যতটুকু পাওয়া যায়, সেও তো আনন্দ।
ছোটবেলার সেই চেনা বাস স্টপেজ, রেল স্টেশনের চেহারা বদলে গেছে। ফেরি পারাপারের স্মৃতিগুলো কড়া নাড়বে, মনে পড়বে ফেরিওয়ালাদের বালতির মধ্যে ভরে রাখা কোল্ড ড্রিংকস দেখে মা-বাবার কাছে আবদারের কথাও। কিন্তু সে সময়টাই নেই আর, প্লাস্টিকের বোতল বা ক্যান তো আপনার ট্রাভেল ব্যাগেই চালান হয়ে গেছে বেশ আগে। বাড়ি থেকে ফোন বা চিঠি আসেনি, যাওয়ার পথে মুঠোফোনে জানাচ্ছেন কতদূর এলেন, একটু টেকি হলে জিপিএস ট্র্যাকিং; ফেসবুকে এরই মধ্যে পোস্ট দেওয়া হয়ে গেছে ‘ট্র্যাভেলিং টু হোম’ ট্যাগ দিয়ে। তাতে লাইক, কমেন্টও কিছু আসছে; এই তো এখন বাড়ি যাওয়া।
বাড়ি ফেরা নিয়ে সেরা গানটা বোধ করি ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নিবেদন করেছে আমাদের। অস্থির আর এক সংবিগ্ন শহরে থেকে বোনা সেই গানে সুরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া এক বিষাদময় প্রশ্ন—‘ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি?’ নাড়ির টানে ফেরা যায় হয়ত, তবে তাতে এখন আনন্দের আরেক পিঠে দীর্ঘশ্বাস আর গাঢ় একটা বেদনাও জুড়ে বসে। বছরে বছরে এই দীর্ঘশ্বাস বাড়ে, আরও বাড়বে।
ঢাকা আসলেই জাদুর এক শহর। প্রতিদিনের অভ্যস্ততায় কখন যে এখানে জীবনের অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছি, তাও আজব মোহে আটকে পড়েছি এখানে—আমরা সবাই। এখন তো বাড়ি ফিরেও শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। সবখানেই তো নেটওয়ার্ক রয়েছে, তাই না! কিন্তু নদীর পাড়ে বসে আপনার শৈশবের সেই সময়টা, অথবা হঠাৎ করে লাগাম ছোটানো অন্তর্জাল বিপ্লবের আগের সেই সময়টার সঙ্গে নিজেকে কানেক্ট করার চেষ্টা করুন—কেন যেন সেখানে ‘সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না’, শুধু নাড়ির টানের সেই স্মৃতিটাই রয়ে গেছে। এই নাড়ির টান অবশ্য ছোটার নয়, স্মৃতিগুলো দিন দিন রঙ্গিলা দালানের মাটি খসে পড়লেও হয়ে উঠবে আরও দামী।
এবারের ঈদে বাড়ি যাচ্ছেন তো?