প্রকৃত প্রস্তাবে চলচ্চিত্রের জন্য পোস্টার অপরিহার্য কোনো উপাদান নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পোস্টার ছাড়া চলচ্চিত্র এক রকম অসম্পূর্ণই থেকে যায়। পোস্টার কেবল চলচ্চিত্রের প্রচারণার উপকরণ হিসেবেই কাজ করে না, চলচ্চিত্রটির অস্তিত্বের প্রতিনিধিও হয়ে ওঠে সেটি। একটি ভালো পোস্টার যেমন একটি সুন্দর চলচ্চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে, সেই নিয়ম মেনেই খারাপ চলচ্চিত্রের পোস্টারও কুৎসিত-ই হয়।
ঢাকার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও এই বাস্তবতা সত্য। মুখ ও মুখোশ থেকে শুরু করে প্রতিটি বাংলা চলচ্চিত্রের পোস্টারই সেই সব চলচ্চিত্রের সার্থক প্রতিনিধি। এমনকি ঢাকার চলচ্চিত্রে যখন অশ্লীলতার জোয়ার চলছিল, সেই খবর জানার জন্য সেই সময়ের কদর্য চলচ্চিত্রগুলো দেখার আদৌ প্রয়োজন নেই। সেই সময়ের চলচ্চিত্রগুলোর পোস্টারের দিকে তাকালেই তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
বিভিন্ন সময়ে ঢাকায় যেমন অসাধারণ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তেমনি সেগুলোর প্রচারণার জন্যও আঁকা হয়েছে ভীষণ সুন্দর সব পোস্টার। তবে সংরক্ষণের অভাবে যেখানে আমাদের পুরনো অনেক চলচ্চিত্রই হারিয়ে গেছে, সেখানে অধিকাংশ পুরনো পোস্টারই যে নতুন প্রজন্মের দেখার সৌভাগ্য হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তারপরও যে পোস্টারগুলো পাওয়া যায়, তার মধ্যে এমন কিছু পোস্টারও আছে, যেগুলোর দুর্দান্ত ডিজাইন ও অনন্য ভাবনা বিশেষভাবেই মনোযোগ আকর্ষণ করে। আর দশটা পোস্টারের মধ্যে থেকে নিজের অস্তিত্বের কথা আলাদা করে জানান দেয়।
সালাহউদ্দীনের যে নদী মরুপথে (১৯৬১) : এই চলচ্চিত্রটির পরিচালক সালাহউদ্দীনই পরে নির্মাণ করেন যাত্রাপালা ভিত্তিক রূপবান (১৯৬৫)।
যে নদী মরুপথে (১৯৬১)
সুভাষ দত্তের সুতরাং (১৯৬৪) : নিজের প্রথম পরিচালিত এই চলচ্চিত্র দিয়েই পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন সুভাষ দত্ত। এই সিনেমাতেই নবাগত মুখ কবরী আসেন লাইমলাইটের ফোকাসে।
আমজাদ হোসেনের গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮) : কালজয়ী এই চলচ্চিত্রটিকে ঢাকার প্রথম বাস্তবধর্মী বা রিয়েলিস্টিক চলচ্চিত্রের মর্যাদা দেয়া হয়।
আমজাদ হোসেনের জন্ম থেকে জ্বলছি (১৯৮২) : চলচ্চিত্রটিতে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সমাজের অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
শহীদুল ইসলাম খোকনের যোদ্ধা (২০০০) : ঢাকার চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার জোয়ারের মধ্যেও, সেই জোয়ারে গা না ভাসিয়েই তুমুল ব্যবসা করেছিল শহীদুল ইসলাম খোকনের এই চলচ্চিত্রটি।
আগে ঢাকার সিনেমার প্রচারের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল প্রচার-পুস্তিকা বা বুকলেট। প্রতিটি সিনেমার একটি করে বুকলেট প্রকাশ করা হতো। সেগুলোতে চলচ্চিত্রের কলাকুশলীদের তালিকা, গানের লিরিক বা কথা, কাহিনিসংক্ষেপ ইত্যাদি থাকত। হারিয়ে যাওয়ার দৌড়ে পুরনো সিনেমা-পোস্টারের চেয়েও এগিয়ে আছে এই বুকলেটগুলো। অথচ আগের দিনের সুন্দর চলচ্চিত্রগুলোর বুকলেটগুলোও হতো সুন্দর। পোস্টারের মতো এই বুকলেটগুলোও ছিল সিনেমার প্রতিনিধি। আর কিছু বুকলেটের প্রচ্ছদও ছিল ভীষণ সুন্দর। তেমন কিছু বুকলেটের হদিস-
ফতেহ লোহানীর আসিয়া (১৯৬০) : এফডিসির প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মাণকাজ শুরু হলেও, আসিয়া মুক্তি পায় এফডিসিতে নির্মিত পঞ্চম চলচ্চিত্র হিসেবে।
মহীউদ্দিনের মাটির পাহাড় (১৯৬০) : এফডিসিতে প্রথম যে চারটি চলচ্চিত্রের নির্মাণকাজ শুরু হয়, তার মধ্যে ছিল মাটির পাহাড়ও।
জহির রায়হানের আনোয়ারা (১৯৬৭) : নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের বেস্টসেলার উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন করেছিলেন জহির রায়হান।
জহির রায়হানের লেট দেয়ার বি লাইট (অসমাপ্ত- ১৯৭০) : চারটি ভাষায় মুক্তির পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করা এই চলচ্চিত্রটির কাজ জহির রায়হান নিজে শেষ করে যেতে পারেননি।
আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩) : মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হানের সহকারী হিসেবে কাজ করার সময়ই তার সাথে এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন আলমগীর কবির।
ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩)-এর বুকলেটের প্রচ্ছদ
কেবল পোস্টার ও বুকলেটই নয়, আগে সিনেমার বিজ্ঞাপন ছাপা হতো পত্রিকাতেও। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের চলটা ছিল এই কিছু দিন আগেও। অশ্লীলতার যুগে আস্তে আস্তে চলটা হারিয়ে যায়। মাঝে আবার কিছু বিগ বাজেট ছবির বিজ্ঞাপন পত্রিকায় দেখা গিয়েছিল। পত্রিকায় ছাপা এই বিজ্ঞাপনগুলোর কয়েকটিও ভীষণই ব্যতিক্রমী, চোখ আটকে রাখার মতো।
জহিরুল হকের রংবাজ (১৯৭৩) : রংবাজেই ঢাকার চলচ্চিত্রে প্রথম বারের মতো বলার মতো অ্যাকশন দৃশ্য দেখা যায়।