প্রচুর ঢাকঢোলও পেটানোর পর গত ৫ মে মুক্তি পেয়েছে স্বপন আহমেদ পরিচালিত পরবাসিনী। কিন্তু বিগ বাজেটের এই সাই-ফাই মুভিটি নিয়ে দর্শকদের মধ্যে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায়নি।
কেন হল এমন?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এই আগ্রহ না দেখানোর কারণ দুটো।
প্রথম কারণ ঐ একই শুক্রবারে প্রায় আচমকা একটি ‘যৌথ’ চলচ্চিত্র ওয়ান – এর মুক্তি পাওয়া। বিশেষ করে অধিকাংশ সিনেমা হলই (৮০টি) ওয়ানের দখলে চলে যাওয়ায়, প্রথম সপ্তাহে পরবাসিনী পেয়েছে মাত্র ১৪টি হল।
সুতরাং পরবাসিনী দেখতে হলে আপনাকে হল খুঁজে দেখতে হবে আর বিগ বাজেটের সিনেমার মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য শুধু সিনেপ্লেক্সের দর্শকরাই যথেষ্ট নন। তারপরেও গল্পে যথেষ্ট জোর থাকলে কিংবা সংগীত জনপ্রিয়তা পেলে সিনেমাটি হয়ত দর্শক টানতে পারত। দুর্ভাগ্য পরবাসিনীর ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি।
অপর কারণটি, মূলত প্রচারণায় তেমন সুবিধা করতে না পারা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিগ বাজেটের এই চলচ্চিত্রটি বানাতে পরিচালক বহু কাঠখড় পুড়িয়েছেন, প্রযোজকও যথেষ্ট টাকা ঢেলেছেন। সময়ও নিয়েছেন অনেক। কিন্তু প্রচারণায় তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেননি।
পারমাণবিক যুদ্ধের ফলে তেজস্ক্রিয়তায় ধ্বংস হয়েছে পৃথিবী। মানুষের বসবাসের জন্য তাই বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করে নতুন এক গ্রহ ‘এরিস-৩২’। সেখানে বসতি গড়ে তুলতে গেলে, বাধা দিতে আসে এলিয়েনরা। এরই মধ্যে এক এলিয়েনের সাথে প্রেম হয়ে যায় এক মানবীর। এমনই এক ছকে বাঁধা হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম সাই-ফাই ঘরানার চলচ্চিত্র।
সাই-ফাই চলচ্চিত্র, কাজেই থ্রিডি অ্যানিমেশন ছিল অবশ্যম্ভাবী। তা করাও হয়েছে। পরিচালকের দাবি, বাংলাদেশের বাস্তবতায় সর্বোচ্চ চেষ্টাই তিনি করেছেন। জানিয়েছেন, চলচ্চিত্রটিতে মোট আড়াইশ থ্রিডি ক্যারেক্টার আছে। সমস্যা হল, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ভারতীয় বাংলা ছবি ঢুকছে দেদার আর সেখানে চলনসই থ্রিডির কাজও শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন। ফলে, দর্শককে ঠিক আসলে শুধু থ্রি-ডির দোহাই দিয়ে ভোলানোর সুযোগ থাকছে না। বিশেষত, এ ছবিতে সে সুযোগ নেইও।
লালটিপ-এর পরিচালক স্বপন আহমেদের দ্বিতীয় এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ শুরুর পর থেকে মুক্তির আগে পর্যন্ত ৫ বছরে জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের, যার কিছু কিছুতো বেশ চমকপ্রদও। সেটা অবশ্য থ্রিডি ক্যারেক্টারগুলো নিয়ে নয় বরং সত্যিকারের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কাজ করেছেন, তাদের নিয়েই। শুরুতে নায়ক-নায়িকা হিসেবে ছিলেন নিরব ও মেহজাবিন। কিন্তু পরে অপেশাদার আচরণ ও অদক্ষ অভিনয়ের অভিযোগে বাদ পড়েন তারা। আসেন ইমন ও অপ্সরা। পেশাদার আচরণের বিষয়টি দর্শকের বোধগম্য হওয়ার সুযোগ না থাকলেও মূল চরিত্রে তাদের ‘দক্ষ’ অভিনয়ের নমুনা অবশ্যই হতাশার।
পাশাপাশি চমক দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাস্ট করার মাধ্যমেও। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের দাবি, পরবাসিনীতে অভিনয় করেছেন বিশ্বের ১৬ দেশের শিল্পী। যাদের মধ্যে আছেন কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী ও জুন মালিয়া। আছেন বলিউডের গ্রেট গ্রান্ড মাস্তিখ্যাত উর্বশী রাওতেলাও। বাকি ১৪ দেশের শিল্পীদের তালিকা ও তাদের অভিনয় দক্ষতার প্রসঙ্গ না তোলাই শ্রেয়।
যদিও পুরো চলচ্চিত্রটিতে খ্যাতনামা এই ভারতীয় শিল্পীরাও আহামরি কোনো পারফরমেন্স করেননি। গল্পের কারণে তাদের সে সুযোগও ছিলোনা। আর আইটেম সংটিও তথৈবচ।
ফিল্মের শুটিংও হয়েছে পাক্কা ৯ দেশে। বাংলাদেশ আর হাতের কাছের ভারত ছাড়াও ক্যামেরার সামনে রোমান্স করতে নায়ক-নায়িকা ছুটেছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড আর বেলজিয়ামের এস্টাবলিশমেন্ট শটের পর বেচারা সুইডেনের জন্য একটু মন খারাপই হয়। ওকি তাহলে ইইউ ছেড়ে দিয়েছে!
চলচ্চিত্রটির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে। ৩ বছরের প্রোডাকশন পর্ব কাটিয়ে পরবাসিনী সেন্সর ছাড়পত্র পায় ২০১৫ সালের অক্টোবরে। প্রথমে মুক্তির তারিখ দেয়া হয়েছিল ২০১৬ সালের ৪ মার্চ। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে এ বছরের ৫ মে। চলচ্চিত্রটি একই দিনে মুক্তি দেয়া হয় ভারতেও। পাশাপাশি এই মাসেই মুক্তি দেয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আরব আমিরাতসহ আরো কিছু দেশে।
যখন গোটা দুনিয়া কাটাপ্পা বাহুবলীকে কেন মেরেছে-এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে তখন এত দুর্বল গল্পের ততোধিক দুর্বল নির্মাণ নিয়ে আসলে কিছু বলবার সুযোগ থাকেনা। সেটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেটের সিনেমা হলেও না।
মুক্তির সময়ে প্রচারণার জন্য ভারত থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল সব্যসাচী ও উর্বশী রাওতেলাকে। ২৮ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ফরাসি অ্যাম্বাসেডর সোফি ওবাট নিজেই। সোমবার নাগাদ বক্সঅফিসের রিটার্নে সেটিও খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারেনি।
শুক্রবারে একদম শেষ মুহূর্তে যুক্ত হয় আরেক উটকো চমক- একই দিনে আচমকা ভারতীয় চলচ্চিত্র ওয়ান-এর মুক্তি পাওয়া। ওয়ান-এর সঙ্গে বাজার দখলের লড়াইয়ে তাই একেবারেই সুবিধা করতে পারেনি পরবাসিনী। তারই ফলাফল, দীর্ঘ পাঁচ বছর সময় নিয়েও এবারে দর্শকের খুব একটা কাছে যেতে পারেননি স্বপন আহমেদ।
তাই, পরবাসিনী না দেখলেও চলে।
ছবিঃ গুগল