৪ এপ্রিল ২০১৭। টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজ ড্র হওয়ার পর শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা টি-টুয়েন্টি সিরিজ। টস করতে নামলেন দুই অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ও উপুল থারাঙ্গা। কিন্তু কে টসে জিতলেন, সেটা একেবারেই গৌণ হয়ে গেল। কারণ টস করতে নেমে মাশরাফি ঘোষণা দিলেন, এই সিরিজ শেষেই আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিকে বিদায় জানাচ্ছেন তিনি। সেই সঙ্গে ক্রিকেট পাগল বাংলাদেশের দর্শকদের কাছেও আর সে ম্যাচের জয়-পরাজয়ের কোনো গুরুত্ব রইল না। মাশরাফির এমন আকস্মিক বিদায় তখনো মানতে পারছিলেন না কেউ-ই।
৬ এপ্রিল। বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে শেষ টি-টুয়েন্টি ম্যাচ খেলতে নামলেন মাশরাফি। তার শেষ ম্যাচে জয় উপহার দিতে জীবনবাজি রেখে খেলল পুরো দল। শুধু জাতীয় দল কেন, মাশরাফির শেষ ম্যাচে জয় উপহার দিতে মুখিয়ে ছিল গোটা বাংলাদেশ। ভালোবাসার ম্যাশকে বিদায় দিতে মন সায় দিচ্ছিল না হয়তো, কিন্তু সিদ্ধান্ততো তিনি জানিয়েই দিয়েছেন। বিদায়তো দিতেই হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভেসে গেল মাশরাফিকে বিদায় জানানো-শ্রদ্ধা জানানো লেখায়। ফিরে আসার আহ্বান ও জানালেন অনেকে। সে দাবিতে শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বিসিবি অফিসের সামনে পোস্টার-প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েও গেলেন কিছু তরুণ-তরুণী।
সেদিন রাতেই মাশরাফিকে নিয়ে গান লেখেন মহিবুল আরিফ নামের চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের এক ছেলে। পরদিন তাতে সুর চড়িয়ে রেকর্ড করলেন। হালকা মেলোরক ধাঁচের গানটি ৮ এপ্রিল আপলোড করলেন ফেসবুকে। মাশরাফির বিদায়ের এই শোক, ফিরে আসার আহ্বান আর মাশরাফির প্রতি শ্রদ্ধা- সবই আছে গানটির কথায়। সবমিলিয়ে গানটি ভাইরাল হয়ে গেল। ফেসবুকে-ইউটিউবে বারবার ভিউ হতে লাগল, লাইক পড়তে লাগল। গানটির এমন সাড়া ফেলা দেখে পরদিন স্টুডিও রেকর্ডিং করে ইউটিউবে ছাড়লেন আরিফ।
এই গানের বদৌলতে কেবল ফেসবুকে-ইউটিউবে ভিউ-লাইক-সাবস্ক্রাইবই জোটেনি আরিফের কপালে, জুটেছে সবচেয়ে বড় পুরস্কারও- মাশরাফি বিন মুর্তজার সাক্ষাৎ। তারকা হলেও তারকাসুলভ অহমিকা মাশরাফির মধ্যে কখনোই দেখা যায়নি। পাগলাটে আর মিশুক বলেই তার খ্যাতি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে হাবিবুলরা তাকে তাই পাগলা বলেই ডাকতেন। বারবার সাক্ষাৎকারে নিজেকে তারকা মানতে অস্বীকার করেছেন। নির্দ্বিধায় সাকিবকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকার তকমা দিয়েছেন। আর দেশের সবচেয়ে বড় তারকার স্বীকৃতি দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
দর্শকদের প্রতিও তিনি সমান বিনয়ী। ভালোবাসার প্রতিদান দেন ভালোবাসা দিয়েই। এইতো কিছুদিন আগে আফগানিস্তানের সঙ্গে সিরিজের শেষ ম্যাচে এক পাগল ভক্ত গ্যালারি থেকে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। ভালোবাসার টানে কাজটা করলেও, সেটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ ছিলনা। ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ভয় পাওয়ার কথা ছিল মাশরাফির। অথচ তিনি কিনা বুক দিয়ে আগলালেন সেই ভক্তকে। নিরাপত্তারক্ষীদের বারবার করে বলে দিলেন, ছেলেটার যেন কোনো সমস্যা না হয়।
এমন যে মাশরাফি, তারপক্ষে খুবই স্বাভাবিক তাকে নিয়ে গান গাওয়া এই ছেলেটার সাথে দেখা করতে রাজি হওয়া। হয়েছেও তাই। আরিফ যখন বিসিবির কিউরেটর জাহিদ রেজা বাবুর মাধ্যমে মাশরাফির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, রাজি হয়ে গেলেন মাশরাফি।
২৩ এপ্রিল ২০১৭। শনিবার। রাত সাড়ে আটটা। মাশরাফির মিরপুরের বাসা। বন্ধুদের নিয়ে জমিয়ে খেলা দেখছেন তিনি। সেসময়ে একটা ছেলে আসলো তার বাসায়। হাতে উপহার- লুঙ্গি, গামছা আর গেঞ্জি। পরিচয় দিলেন, মাশরাফিকে নিয়ে গান গাওয়া সেই ছেলে। আরো একবার আরো এক ভক্তকে জড়িয়ে ধরলেন মাশরাফি।
একটু ভালো লাগা ছাড়া এই ঘটনায় মাশরাফির হয়তো আর তেমন কিছুই হয়নি। এমনতো কতই হয়! সারা পৃথিবীতে কত তারকার জন্য কত ভক্তইতো এমন পাগলামি করে। আরিফতো কেবল একটা গান গেয়েছে, আর তার সাথে দেখা করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসেছে।কিন্তু বিনিময়ে আরিফ যা পেল, সেটা তার সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে। ম্যাশের সাথে কাটানো ওই সন্ধ্যাটা, ম্যাশকে জড়িয়ে ধরার ওই মুহুর্তটা হয়তো তার জীবনকেই বদলে দেবে। আর এভাবে জড়িয়ে ধরতে পারেন বলেই হয়তো বাংলাদেশের মানুষ এতটা ভালোবাসে ম্যাশকে। পরিসংখ্যানে নয়, মাশরাফির শ্রেষ্ঠত্ব এই ভালোবাসতে পারায়, ভালোবাসাতে পারায়।