অদ্বিতী ইরা
‘এক টাকায় আহার’ – দেশের বিভিন্ন শহরের অলিগলিতে, রাস্তার, রেলস্টেশনে সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের মুখে এক বেলা খাবার তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আলোচনায় উঠে আসে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পর আমাদের দেশেও যখন ‘করোনাভাইরাস’ নামক কালো ছায়া এসে পরে সংগঠনটি এগিয়ে এসেছিলো সমাজের এবং অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করতে।
সমাজের সুবিধা বঞ্চিত পথ শিশুদের জন্য পড়াশুনার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে যাত্রা শুরু করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এরপর পথশিশু এবং বৃ্দ্ধদের খাবার যোগানোর উদ্দেশ্যে ‘এক টাকার আহার’ কার্যক্রমটি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তা কিশোর কুমার দাশ একজন সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করছেন বহু বছর যাবত। এই সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য কিছু করার উদ্দেশ্যে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন তিনি। এখন তার সঙ্গে যক্ত হয়েছেন বহু সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক এবং বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।
ক্ষুদার্তকে একবেলা ভালোমতো খাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ‘এক টাকার আহার’ কার্যক্রম শুরু করেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষুদার্তদের হাতে খাবার তুলে দেওয়া, তবে তাদের মধ্যে যেনো এমন ধারণা সৃষ্টি না হয় যে, তাদের ভিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সে কারণে খাবারের নূন্যতম দাম ধরা হয় ‘এক টাকা’।
এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা নিজেও দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছিলেন। সেই থেকে সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কাজ করতে এগিয়ে আসেন।
‘এক টাকার আহার’ এর ফেসবুক পাতায় এই বিষয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে লেখা ছিলো, “বিনা পয়সায় খাবার সরবরাহ করলে শিশুরা ভিক্ষা মনে করতে পারে, তাই খাবারের প্রতীকী মূল্য এক টাকা।” তাদের এই কার্যক্রমের আওতায় খাবার পেয়ে থাকেন ১২ বছরের নিচে শিশু এবং ষাটোর্ধ্বো বৃদ্ধরা।
তবে তাদের যাত্রার পথটি মোটেও সুখকর ছিলো না। ২০১৩ সালে যাত্রার শুরুতে স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেদের স্বামর্থ অনুযায়ী অর্থ জুরে দুস্থ মানুষদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে আসছিলেন। ২০১৬ সালের দিকে তারা অন্যান্য উৎস থেকে সাহায্য পেতে শুরু করেন। তবে এরপরও মাঝে মধ্যেই অর্থের অভাবে তাদের কাজ থমকে গিয়েছিলো।
এ ছিলো বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের শুরুর গল্প। কিন্তু সাম্প্রতিক দেশে করোনা-আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করার পর একদিন হঠাৎ ফেইসবুকের হোমে দেখা গেলো, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেদের উদ্যোগেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের যেসব স্থানে জনসমাগম বেশি, সেসব স্থানে জীবাণুনাশক ছিটানো এবং মাস্ক-অ্যাপ্রোন ইত্যাদি তৈরি ও বিতরণের কাজ শুরু করেছে।
পুরো দেশে কোয়ানেন্টিন এবং লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার আগেই এই সংগঠনটি কাজ শুরু করে। তারা মাস্ক ও অ্যাপ্রোন বানিয়ে বিতরণ করেছেন সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে।
শুধু যে সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্য করার জন্য বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কাজ করছে তা নয়, করোনা মোকবিলায় চিকিৎসা সেবাদানকারীদের জন্যও তারা এগিয়ে এসেছেন মাস্ক এবং গাউন নিয়ে। এক মাধ্যম থেকে জানা যায়, চিকিৎসকদের জন্যে গাউন তৈরি করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনও পেয়েছেন। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশনটিকে প্রায় ২৫শ গাউন স্পন্সর করছে বলেও জানা যায়।
এখানেই শেষ নয়, বিভিন্ন এলাকায় লকডাউনের কারণে দিন মজুর এবং নিম্ন আয়ের মানুষরা খাদ্যসংকটে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতেও তাদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
ফেসবুক পোস্টে তারা জানান, ’বাড়ীতে লকডাউন অবস্থায় যদি কেউ খাবার সংকটে ভুগেন তবে এক টাকায় আহার পেজে যোগাযোগ করলে বিদ্যানন্দ টিম খাবার পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করবো। সীমিত আমাদের অর্থ, তাই অপব্যবহার না করার অনুরোধ থাকবে। শুধুমাত্র খুব দরকার হলে এবং প্রশাসন দ্বারা বাড়ী “লকডাউন” হলে এবং তাঁদের অনুমতি পেলে আমরা খাবার প্রদান করতে পারবো।’
শুধু যে খাবার পৌছে দেওয়াই নয়, এই দুঃসময়ে যখন বাজারের প্রতিটি দোকানে হ্যান্ডস্যানিটাইজার হয়ে গেছে সোনার হরিণ তখন এই সমস্যা সমাধানে ফাউন্ডেশনটি কাজ শুরু করে। নিজেদের উদ্যোগেই অ্যালকোহল যুক্ত স্যান্টিাইজার তৈরি করেন বিনামূল্যে বিতরণের জন্য। একটি ফেইসবুক পোস্টে জানান, সাধারণ দামের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি দামে তাদের কিনতে হয়েছে কাঁচামাল।
ডাক্তার এবং নার্সদের জন্য পিপিই তৈরির কাজটিও করে গেছেন তারা সব কিছুর পাশাপাশি। কিন্তু এতো কিছুর পরও এক পোস্টে ফাউন্ডেশনটি জানায় তাদের ফেইসবুক পেইজ রিপোর্ট করা হচ্ছে, আর যাতে করে বন্ধ হয়ে যেতে পারে সমাজসেবা প্রচারের প্ল্যাটফর্মটি। কিন্তু বলা যায় এই ঘটনাটি উল্টো ক্ষতির থেকে সবার নজরে নিয়ে আসে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমকে।
তারা একটি পোস্টে জানায়, ”ফিরে পেলাম আমাদের আত্মার “এক টাকায় আহার” পেজটি। আমাদের নয়, কৃতিত্বটা আপনাদেরই। আপনাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে ফেরেশতারা, যারা এই ক্ষতিকে নিজের ক্ষতি ধরে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যার যার মতো। স্যালুট আপনাদের !!!”
এরপর বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের অনুদান সংগ্রহ শুরু হয়। আর তারুণ্যের এই ডাকে সাড়া দেয় অসংখ্য মানুষ। যে সংকটগুলো কাটানো মুশকিল হয়ে পরেছিলো সেগুলো যেনো কিছুটা সহজ হতে শুরু করে। আর এতে উৎসাহী হয়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন প্রায় পাঁচ লাখ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে খাবার পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়।
এখানেই শেষ নয়, প্রতিটি বাড়িতে বা সবার হাতে খাবার পৌঁছে দেওয়া বেশ কঠিন। তাছাড়া শহরে সবজির দামও বেশ চড়া। এই সব ঝক্কি এড়াতে সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে ট্রাকে করে সবজি এনে রাস্তায় ছড়িয়ে দিচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। পাশাপাশি শহরের কিছু কিছু বৃদ্ধাশ্রম এবং অনাথাশ্রমেও খাবারের মজুদ পৌঁছে দিচ্ছে সংগঠনটি।
লকডাউনের কারণে কৃষকদের জন্য ফসল বাজারে বিক্রি বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এমন অনেক কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সবজি কিনে নিয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে বিতরণের জন্য।
শুধু মানুষ নয় লকডাউনের কারণে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে রাস্তার বোবাপ্রাণীদেরও। তাই প্রতিদিনকার কাজের ফাঁকে রাস্তার প্রাণীগুলোর জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করেছে এই সংগঠনের তরুণ দল।
শহরের রাস্তা জীবাণুদাশক দিয়ে ধুয়ে দেওয়ার কাজটিও বাকি রাখেন নি তারা। একটি শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুদানে তিন লাখ লিটার জীবানুনাশক দিয়ে শহরের রাস্তা ধুয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এই উদ্দেশ্যগুলো সফল করতে অনেক প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে এসেছেন সাহায্য করতে। দেশের পরিস্থিতিতে শুধু একটি দল বা সরকারের উপর নির্ভর করে যে বসে থাকা যায় না তা বুঝিয়ে দিয়েছে এই ফাউন্ডেশনটির নিঃস্বার্থ উদ্যোগগুলো। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অনেককেই কান্ডারি হয়ে হাল ধরতে হবে সেই বিষয়টিও চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ও এর সঙ্গে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবকদের দল।
* উল্লেখ্য সকল ছবি বিদ্যানন্দ এবং এক টাকার আহার ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত