সর্বকালের সেরা নির্মাতাদের একজন, আলফ্রেড হিচকক বলেছেন, “আমি প্রতিটা দৃশ্য কল্পনা না করে বই পড়তে পারিনা। সেজন্য, পুরো বইটা আমার কাছে একের পর এক সাজানো ছবিতে পরিণত হয়।” দেশের জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ততোধিক জনপ্রিয় উপন্যাস “দেবী” পড়ার সময় পাঠকমাত্রেই নিজেকে হিচককের পরিস্থিতিতে দেখতে পান। মিসির আলি, রানু, নীলু প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ঘটনা হুমায়ূন পাঠকমাত্রেই কল্পনার চোখে দেখেছেন। আসলে হুমায়ূনের লেখনী এতোই শক্তিশালী ছিলো যে পাঠকদের আসলে এই দৃশ্য-কল্পনা প্রক্রিয়ায় পাঠ সম্পন্ন না করে উপায় ছিলোনা। এমন একটি উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপান্তর করা কতোটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে ভাবুন একবার! নির্মাতা অনম বিশ্বাস সেই চ্যালেঞ্জ এতোটাই দক্ষতার সাথে নিয়েছেন যে সরকারি অনুদানে নির্মিত, সি-তে সিনেমা প্রযোজিত ‘দেবী’ কেন দেখবেন এমন প্রশ্নের জবাবে ঠেলেঠুলে বেরোতে চাওয়া অজস্র উত্তরের মধ্য থেকে আমরা বেছে নিচ্ছি পাঁচটি কারণ এবং উপরি হিসেবে একটি অকারণকে।
১. বড় পর্দায় প্রথমবার মিসির আলির দেখা
মিসির আলি, হুমায়ূন আহমেদের অনবদ্য সৃষ্টি। তার এমন পাঠক কেউ নেই যিনি কল্পনায় মিসির আলির অবয়ব আঁকেননি। এবং এই প্রত্যেক পাঠকের চিন্তা তার নিজের মতো, স্বতন্ত্র। সেখানে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া প্রায় অসম্ভব। আর এই বেকায়দা দায়িত্বটি পরিচালক বর্তান অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর উপর। বিন্দুমাত্র হতাশ করেননি তিনি। প্রখর বুদ্ধিমান, অগোছালো, খেয়ালী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চরিত্রে দারুণ মানিয়ে গেছেন চঞ্চল। এরপর বরং অন্য কাউকে মিসির আলি চরিত্রে মানতে কষ্ট হবে দর্শকদের।
২. মিসির আলির বাসা
এই কারণটাকে আগেরটার সাথে জুড়ে দেওয়া যেতো। কিন্তু, সত্যি বলছি, মিসির আলির বাসার সেট পুরো সিনেমার অন্যতম এক আকর্ষণ। যতবার সেখানে সিকুয়েন্স হয়েছে, মন ভরে গেছে হলভর্তি দর্শকদের। ঘর বই আর বইয়ে ভরপুর থাকবে সেটা অনুমেয়। তবে, এলোমেলোর মধ্যে খোলামেলা, কপাটহীন জানালা আর উদার সবুজ বারান্দার বাসাটি চোখের জন্য ভীষণ স্বস্তিদায়ক। সম্ভবত উপন্যাস পড়ে যেমনটা ভেবেছেন তাকেও হার মানিয়ে দেবে চলচ্চিত্র।
৩. দেশের ইতিহাসে সেরা ভৌতিক ছবি
বাংলাদেশে নির্মিত মানসম্মত একটি ভৌতিক ছবির নাম বলুন দেখি! দর্শকের জন্য খুব কঠিন প্রশ্ন হয়ে যায়। কিন্তু এখন থেকে আমরা বলতে পারবো “দেবী”। তবে, দেবীকে পুরোপুরি ভৌতিক সিনেমা বললে যারা এখনো সিনেমাটি দেখেননি তাদের একদম ভ্রান্ত ধারণা দেওয়া হয়। ফিল্মের পুরোটা জুড়ে রহস্য। আর রহস্য উন্মোচনের আকাঙ্ক্ষায় দর্শককে উন্মুখ করে রাখা এক হরর থ্রিলার “দেবী”। অর্থাৎ ভৌতিক এবং রহস্যের যুগলবন্দীতে মুভির প্রায় দুই ঘন্টা সময় ভয়ে কাবু করে না রাখলেও বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে কাঁপন ধরানো দৃশ্য আছে যথেষ্ট। যেখানে হলিউডের অনেক ছবিতেও জোর করে ভয় ধরানোর প্রয়াস চলে ইদানিং। তাই, হরর এবং থ্রিলার হিসেবে ‘দেবী’ সার্থক।
৪. দেবী
বলছি জয়া আহসানের কথা। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত, অনিশ্চিত, রহস্যময় রানু চরিত্র ফুটিয়ে তোলা সহজ কথা নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক্সপ্রেশনে বাহুল্যের আশঙ্কা। কিন্তু, দারুণ পরিমিতির সাথে যেখানে যতোটা দরকার অভিব্যক্তি দিয়েছেন জয়া। তার অভিনয় দারুণ বললেও আসলে কম বলা হবে। চুলের বিন্যাস ও সুক্ষ্ণ মেকআপে তাকে লেগেছেও দেবীর মতো। সাথে সাথে এই সিনেমার নানা প্রোমোশন/ ক্যাম্পেইন দিয়ে প্রযোজক হিসেবেও অতুলনীয় সূচনা করেছেন তিনি।
৫. নির্মাণে উৎকর্ষ
শুরুতেই বলেছি “দেবী” দেখার পক্ষে আসলে অনেকগুলো যুক্তি দেওয়া যায়। কারণ, নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায় বাংলাদেশের সিনেমার সাথে কমবেশি পরিচিত সকলকেই মুগ্ধ করেছে। চিত্রনাট্য অসাধারণ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শক ধরে রাখার মতো। সিনেমাটোগ্রাফি দুর্দান্ত। প্রতিটা ফ্রেম অর্থবহ। হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এসথেটিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি নজর দিয়েছেন চিত্রগ্রাহক কামরুল হাসান খসরু। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, কালার, লাইটিং, সেট, প্রপস এসবই ছবির চাহিদার সাথে দারুণ সঙ্গতিপূর্ণ। একটি মাত্র মৌলিক গান পুরো ছবিতে। অনুপমের গাওয়া সেই গানটিও চিত্তাকর্ষক। অনম বিশ্বাসের নির্মাণে সাধারণ দর্শকের বিশ্বাসী হয়ে উঠবার সময় এসেছে।
আচ্ছা, পাঁচটির বেশি কারণ থাকবে না বলে আসলে অনেকের প্রতি অবিচার করা হয়ে যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ তিন পার্শ্ব চরিত্রে শবনম ফারিয়া, অনিমেশ আইচ ও ইরেশ যাকের প্রত্যেকে ছিলেন অনবদ্য। বিশেষ করে শবনম ফারিয়া অভিব্যক্তির সুক্ষ্ণ ডিটেইলিংও ছাড়েননি। সবচেয়ে বড় কথা, এই ফিল্মে সবাই একেকটি চরিত্র হয়ে গিয়েছেন। কারওটা অভিনয় মনে হয়নি।
ও হ্যা, একটা “অকারণ” বলে শেষ করি। “দেবী” উপন্যাস পড়ে যদি অংক মেলাতে হলে যান, তাহলে কিছু অমিল ধরার আনন্দ পাবেন। অবশ্য, কিছু পরিবর্তন নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার ভুলে নয়, সচেতনেই করেছেন। সময় ও বড় পর্দার চাহিদার বিবেচনায় করেছেন। বরং, উপন্যাসের সাথে তুলনায় না গিয়ে শুধু সিনেমা হিসেবে দেখলে “দেবী” শেষে আপনি হল থেকে বের হবেন মুগ্ধতা আর হাহাকারের মিশেলে অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে।