হট অ্যান্ড হ্যাপেনিংস

পত্রিকার বিনোদন পাতার লিড। আসিতেছে! আসিতেছে!! নতুন নতুন সব ওয়েব সিরিজ, আসিতেছে। বিষয়টা কি সেটা জানেনতো? মানে ওই যে, অ্যাপ ডাউনলোড করে বাড়ির মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভোগা কর্তা, কলেজ পড়ুয়া কিশোরটা সারাদিন জোম্বির মতো যা নিয়ে মত্ত থাকে! সেগুলো আসছে। যাতে সকাল-বিকেল দেখা মেলে বড় পর্দার মূল ভূমিকায় প্রায় অচল বিগত যৌবনাদের, বিসস্ত্র বসনে। মাঝে মাঝে অবশ্য উঠতি উদ্ভিন্নাদেরও দেখা মেলে, তবে দর্শকের বরাত ভালো হলেই। যদিও কথাটা একটু জেনারেলাইজড হয়ে গেলো! কিন্তু কি করা যাবে বলুন? প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার স্রেফ একটা স্টিল ছবি নিয়ে যে দেশে নীতি-আদর্শ কই গেল, কই গেল- এমন রণহুংকার ওঠে সেই দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি! বোঝেন তাহলে, বায়ুপরাগায়ণ কোন লেভেলে পৌঁছেছে! তাহলে বায়ু পরাগায়ণের দোহাইয়ে এদফায় জেনারেলাইজেশনই সই।

এত আলাপ আসলে কি নিয়ে? ওয়েব সিরিজ নিয়ে। সেটা কি? খায়, না মাথায় দেয়? উত্তর হবে- দেখে। নেটফ্লিক্স, বায়োস্কোপ, আইফ্লিক্স, বঙ্গবিডি, হইচই, র‌্যাবিটহোল এবং ইউটিউবে নানা চ্যানেলে যে কন্টেন্ট দর্শক দেখছেন সেগুলোকেই মোদ্দাকথায় ওয়েব সিরিজ বলে। ডেফিনেশন ক্লিয়ার হয়নি, কি করা যাবে বলুন? জিপিএ-৫ পাওয়া দেশগুলো মানে বড় লোকেদের দেশে ওয়েব সিরিজের ব্যবসাটা এইচবিও/নেটফ্লিক্স তো করছে বহুদিন ধরে। আমরা নতুন নতুন লাইনে নেমেছি কিনা! হৃদয় জিতলেই হয়, কাপ আর লাগে না। গেইম অব থ্রোনস বা হাউজ অব কার্ডসের নাম শোনেননি? ওই, ওই। হ্যাঁ হ্যাঁ, একগাদা গরম দৃশ্যে ভরপুর হালের স্যাকরেড গেমসও, ওয়েব সিরিজই, বুঝেছেন?

তো হিল্লি-দিল্লি (পড়ুন হলিউড-বলিউড) ঘুরে বাংলা ভাষায় ওয়েব সিরিজের আগমনও কিন্তু বছর কয়েক আগে ঘটে গেছে। যদিও বাংলাদেশের মাটিতে ক্যাজুয়াল কুর্তি গায়ে ফেলুদা সেজে শেয়ালদেবতা খুঁজে বেড়ানো পরমব্রত-ঋদ্ধির বদলে আসল, আদিমতম ঝড়টা দেখিয়ে ছিল হইচই’র ‘দুপুর ঠাকুরপো’। কারণ শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের হইচই অ্যাপে ছিল মেইনস্ট্রিমে কম হিট কিন্তু জীবনমুখীতে সফল ওপারের নায়িকা স্বস্তিকার আলতো আদুল শরীর দেখানো ভোজপুরী আইটেম সং। এবং তাতেই কলকাতার জীবনমুখী সিনেমার ট্রেডমার্ক আলগা যৌনতা, অনুপান অস্তিত্ববাদী কচকচি মিলে ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে দর্শক বলেছিল এই যৌবন জলতরঙ্গ রুধিবে কে? আর অ্যাপের যেহেতু মা-বাপ নেই মানে সসাগরা এই দুনিয়ার যেকোন প্রান্তে বসে যে কেউ তার রস নিতে পারেন! তাই তাবৎ বাংলাভাষী বাঁধা পরেন সে সিরিজের উমা বৌদির নানা রংগের ওয়েবে।

কে? কে? কে? তোমারে বধিবে যে, গোকুলে কি বাড়িছে সে? তো ‘দুপুর ঠাকুরপো’ দেখেছেন? অনেকেই দেখেছেন, তবে সবসময়ে স্বীকার করেন না। আর না দেখে থাকলে, ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। প্রথম সিজনে উমা বৌদি হিসেবে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় হিট এবং যথেষ্ঠ হট হওয়ায় জনগণের (পড়ুন ঠাকুরপোদের) ‘ডিমান্ডে’ দ্বিতীয় সিজন খুব শীগগিরই আসছে। আর সে সিজনে আর বাংলা সিনেমার নায়িকা দিয়ে ভোজপুরী আইটেম সং শ্যুট করানো হচ্ছে না! ভোজপুরী-ওড়িয়া থুক্কু সর্বভারতীয় আইটেম সং-এ পারদর্শী বাংলা বলিয়ে নায়িকাই যোগাড় করে ফেলেছেন প্রযোজকরা। তো এইযে অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস!- তাতে আদৌ কি নতুন কিছু পাচ্ছে দর্শক? মানে প্রবাসী বাঙালিরাও কি কলকাতা-ঢাকার বাঙালিদের মতো কেবল সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসিতেই মগ্ন হয়ে থাকেন? নাকি আন্তর্জাতিক পরিবেশে থাকায় কালেভদ্রে চৈতন্য ফিরে পান? সিরিয়াস কিছুও দেখেন?

কে জানে? যদিও ভেঙ্কটেশের হইচই কিন্তু একের পরে এক হইচই বাঁধাচ্ছে সিটি অব জয়ের সেক্স এবং সেনসুয়ালিটিকেই পুঁজি করে। সম্ভবত দত্তকবির বিবৃত বঙ্গ ভাণ্ডারের বিবিধ রতনেরাও সকলেই আজ ভূষ্ণ/বিভূষণ হয়ে উধাও হয়েছেন! নজির তাদের নতুন সিরিজ, জাপানি টয়। এটি কি? ট্রেইলার দেখুন এবং নিজেই সিদ্ধান্ত নিন।

এদিকে বাংলাদেশে চলছে অন্য সমস্যা। ভারতে যশরাজ ফিল্মস যেমন সেক্স এজুকেশন নিয়ে ঠিকঠাক ডুরেক্সের পয়সায় ওয়েব সিরিজ করতে পারছে, হংসল মেহতা যেমন সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে দারুণ সিরিজ করতে পেরেছেন তেমন কোন কন্টেন্ট এখনো পর্যন্ত আমরা তৈরিতো দূরের কথা ভেবেই উঠতে পারিনি। কেন পারিনি? কেন আমাদের হয় না?- এসব কঠিন প্রশ্ন! উত্তর অন্তত এখন অবধি আমাদের জানা নেই।

সুতরাং দেশীয় ওয়েব সিরিজগুলোর বদৌলতে দর্শক নতুন একটি মাধ্যমের সঙ্গে অভ্যস্ততা তৈরির বদলে ব্যাক টু ব্যাক ধাক্কা খাচ্ছেন। আগামী দিনে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হতে চলা ওয়েব সিরিজের নামে তাহলে দেশে কি তৈরি হচ্ছে? কারা তৈরি করছেন? সিএমভি, ধ্রুব টিভি প্রভৃতি যেসব প্রোডাকশান হাউজ ইউটিউবের জন্য কন্টেন্ট তৈরি করছে তা যারা দেখছেন; কেন দেখছেন? এমনকি ওয়েব সিরিজ তৈরি না করলেও থার্ড বেল-এ প্রচারিত কিছু কনটেন্টও দুদণ্ডের উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।’

নিজেদের ভবিষ্যতের বাংলাদেশি নেটফ্লিক্স ভেবে মডেলিং জগতের অন্ধকার নিয়ে মাঠে থুক্কু ইউটিউবে নেমেছে বঙ্গবিডিও। আসছে নানা মাধ্যমে, নানা ভাবে পরিচালক হতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া অনন্য মামুনের ফোন-এক্স।

এখন প্রশ্ন হলো সেন্সর নেই বলেই কি সেক্স ও স্কিনের এই রমরমা? হয়তো, হয়তো না। আমরা আসলে জানি না। এতো এতো অখাদ্য কন্টেন্টের ভীড়ে দিশেহারা পাঠককে শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই, শহরের উষ্ণতম দিনে পিচগলা রাস্তার মোড়ে, রোদ্দুরে সবচে বেশি যে পোস্টারের দেখা মেলে সেটির চেহারা।

 

নিশ্চয়ই ভুলে যাননি?