আপনি কে? আমি কে? আমরা কেউ কি উল্লেখযোগ্য মানুষ? নাকি আর বাকি দশজনের মতই সাধারণ, অতি সাধারণ। কিন্তু আমরা কি পারতাম অসাধারণ হতে? হয়তো পারতাম, কখনো চেষ্টাই করা হয়নি। মিশে গেছি জনারণ্যে। আমাদের মতই সাধারণ অমল-বিমল-কমল। কিন্তু এদের থেকে আলাদা একজন আছে, সে ‘ইন্দ্রজিৎ’। সে আমাদের মত সাধারণ অমল-কমল-বিমল বা নির্মল নয়, সে ইন্দ্রজিৎ। আর আলাদা বলেই ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে নাটক লেখা হয়।
বাদল সরকারকে বলা হয় বাংলায় থার্ড থিয়েটারের প্রবক্তা। লাতিন আমেরিকার থার্ড সিনেমার আদলে বাংলায় থার্ড থিয়েটারের চর্চা শুরু করেন তিনি। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’। নাটকটি তিনি লেখেন প্রবাস জীবনে, নাইজেরিয়ায় থাকতে ১৯৬৩ সালে। আর নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৬৫ সালে কলকাতায়। সংলাপ এবং চরিত্রের নানা বয়ানে বাদল সরকার এক সাধারণ ছবি তুলে এনেছেন যা আমরা দেখেছি, দেখছি বা দেখবো আমাদের চারপাশের সাথে এই অর্ধশতক পরে এসেও অনেক বেশি মানানসই।
কলেজ জীবন থেকে দেখতে পাই ইন্দ্রজিৎকে। যেখানে তার সাথে আছে বন্ধু অমল-কমল-বিমল এবং এক কবি বন্ধু। হাসি-ঠাট্টা আর আড্ডায় কলেজ জীবনটা সুখেই কেটে যায় সবার। একদিন কবি বন্ধুর সাথে পথে দেখা বাকি তিনজনের। কবিকে নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে তারা। কবির লেখা নতুন কবিতা শুনতে চাইছে বন্ধুরা। তখন বন্ধু কমল কবিতা সম্পর্কে বলছে, ‘যদি বুঝতে পারি, ছিঁড়ে ফেলো। না পারলে মাসিক পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়ো’। অর্থ্যাৎ দূর্বোধ্যতাই যেন কবিতা হয়ে ওঠার প্রথম শর্ত।
নাটকে লেখকের যে চরিত্র তিনি ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে নাটক লেখার চেষ্টা করছেন। জীবনের চক্র বোঝাতে গিয়ে লেখক বলেন, ‘স্কুল থেকে কলেজ। কলেজ আর পরীক্ষা। পরীক্ষা আর পাস। তারপর দুনিয়া’। লেখক চরিত্রের ভেতর দিয়ে বাদল সরকার খুব সহজে জীবনের একটা ছক এঁকে ফেলেন, যেই ছকে আমরা সবাই কম-বেশি ঘুরপাক খাচ্ছি।
দর্শক-পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে কেন এই নাটক। কেন ইন্দ্রজিৎ নাটকের নামভূমিকায়? লেখকের মত সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে নাটক লেখা যায় না, ইন্দ্রজিৎ তার বন্ধুদের থেকে আলাদা। কেন আলাদা? কীভাবে আলাদা? সে আলাদা তার চিন্তাভাবনায়। সে আমাদের সবার মত অবলীলায় সব কিছু মেনে নিতে পারে না। এই যেমন মানসীকে ইন্দ্রজিৎ বলে, ‘যে নিয়মে সাত বছরের ছেলেকে জুতো পালিশ করতে হয়, আর কোলের ভাইকে রাখতে হয়, সে নিয়মটাকে মানতে পারি না’। মানসী আর ইন্দ্রজিৎ তখন বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, জীবন নিয়ে তাদের তখন অতো মাথাব্যথা নেই। কেবল তো কলেজে পড়ছে ইন্দ্রজিৎ।
লেখক চরিত্রটি যে জীবন চক্রের ছক এঁকেছেন তাতে কলেজ পাসের পর দুনিয়া। সেই দুনিয়ায় টিকতে হলে একটা চাকরি দরকার, রুটি-রুজির নিশ্চিত ব্যবস্থা দরকার। ইন্দ্রজিৎ ও তাঁর বন্ধুরা সেজন্য চাকরির খোঁজ করে, ইন্টারভিউ দেয়। এরকমই এক ইন্টারভিউ এর আগে ওয়েটিং রুমে বসে ইন্দ্রজিৎ ও তাঁর বন্ধুর মধ্যে কথোপকথন চলছে, যেখানে বন্ধুটি বলছে, কোন প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে স্মার্টলি জানি না বলে দিতে হয়। এর উত্তরে ইন্দ্রজিৎ বলছে, “‘আই ডোন্ট নো’ কথাটা স্মার্টলি বলাটা খুব শক্ত”।
জীবনচক্রে ধীরে ধীরে আটকে গেছে সবাই। এরই মধ্যে হঠ্যাৎ একদিন রাস্তায় কলেজের কবি বন্ধুটির সাথে ইন্দ্রজিতের দেখা। অনেকদিন পর দেখা তাই কবি বন্ধুটি অনেক কথাই জানতে চাচ্ছে ইন্দ্রজিতের কাছে, কেমন আছে? কি করছে? কিন্তু কবি যতোটা শুনতে চায় ইন্দ্রজিতের বলার মতো ততোটা নেই। তাই সে বলে, ‘দুনিয়াতে বলবার মত ঘটনা প্রায়ই ঘটে না’।
ঘুরে ফিরে বাকি বন্ধু অর্থ্যাৎ অমল-কমল-বিমলের সাথেও দেখা হয় কবির। এরা সবাই চাকরি-বাকরি, ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। এর সবাই ব্যস্ত কিন্তু কেউই তেমন সুখী নয়। এই যেমন অমল, কবিকে বলছে, ‘এই এ-বি-সি-ডি কোম্পানিতে ঢুকে ভবিষ্যৎটা ঝরঝরে হয়ে গেল। সিনিয়র অ্যাসিসটেন্টের পোস্টে ছ’বছরের এক্সপেরিয়েন্স, জানো? আর অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার করে নিয়ে এল, বাইরে থেকে এক মাদ্রাজিকে!’ আমাদের সবারই কি চাকরিজীবনে এমন আফসোস থাকে। অমল যেন সেই মধ্যবিত্ত অসন্তুষ্ট ছাপোষা চাকরিজীবিদেরই প্রতিনিধি।
কিন্তু নাটকের মুখ্য চরিত্র ইন্দ্রজিৎ কোথায়? ওদের মতই চাকরি করছে? বিয়ে করেছে? ওই যে, মানসীলর সাথে ঘুরতো, বিয়ে করেছে মানসীকে? না, মানসী ভয় পেয়েছিল বিয়ে করলে, তাদের মধ্যে ভালোবাসা হয়তো আর থাকবে না। সংসারের চাপে ভালোবাসা মিলিয়ে যাবে। ভালোবাসার তো যাবেই, বন্ধুত্বটাও যাবে। তাহলে? অনেকদিন মানসী বা ইন্দ্রজিৎ কেউই বিয়ে করেনি। দেখা করেছে, কথা বলেছে। ইন্দ্রজিৎ বারবার বলেছে বিয়ের কথা কিন্তু মানসী রাজি নয়। অবশেষে ইন্দ্রজিৎ বিয়ে করে আরেকজনকে, তবে তার নামও মানসী।
ইন্দ্রজিৎ একটা কোর্স করতে লন্ডন চলে যায়। সেখান থেকে সে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে পৃথিবীর পথে। এক সময় ফিরে আসে ইন্দ্রজিৎ। নাটকের লেখকের সাথে দেখা হয় তার। ইন্দ্রজিৎ তার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, কারণ সে ভেবেছিল সে বাকিদের থেকে আলাদা। সে অমল-বিমল-কমল নয় সে ইন্দ্রজিৎ, সে আলাদা।
কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে সে ইন্দ্রজিৎ নয়, সে অমল-কমল-বিমলের মতই সাধারণ আরেকজন। সে নির্মল। সে ইন্দ্রজিৎ হতে চায় না, সে নির্মল হতে চায়। ঘর-সংসার, চাকরি-বাকরি আর প্রতিনিয়ত মেনে নেয়ার ছাপোষা জীবন চায় সে। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ তো নির্মল হতে পারবে না, সে তো সাধারণ হতে পারবে না। কারণ হিসেবে লেখক বলেন, ‘কিন্তু তোমার যে কিছু নেই। প্রমোশন নেই, বাড়ি করা নেই, ব্যবসার স্কিম নেই, কী করে নির্মল হবে তুমি?’
তাহলে কি ইন্দ্রজিৎ আলাদা হতে পারলো? ইন্দ্রজিৎ কে নিয়ে নাটক লেখা কি স্বার্ধক হলো?
লেখক নাটকের শেষ টানেন, ‘আমাদের অতীত-ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে গেছে। আমরা জেনে গেছি পেছনে যা ছিল, সামনেও তাই’।