বিশ্বকাপ থুক্কু জুলে রিমে কাপের নামে বৈশ্বিক ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসরের যাত্রা শুরু হয় ১৯৩০ সালে। তখনো আফ্রিকা-দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারও অধিকাংশ দেশই পরাধীন। আমাদের বাংলাদেশও। মাঝে কেটে গেছে কত না বছর! বিশ্বকাপ ফুটবলের শতবর্ষপূর্তির আর বাকি মাত্র এক যুগ। এরই মাঝে বিশ্বজুড়ে রাজনীতির চাল-পাল্টা চালে কতই না ঘটেছে বদল। সাম্রাজ্যবাদের সূর্য অস্ত গেছে। মাঝে সাম্যবাদী চেতনায় কেঁপেছে দুনিয়া। যদিও পুঁজিবাদের কাছে কোণঠাসা হতে হতে এখন সাম্যবাদী রাষ্ট্র বলে তেমন কিছুই নেই আর বিশ্বে। আর এসব নানা রাজনীতির জেরে স্বাধীন হয়েছে প্রায় শ’খানেক রাষ্ট্র।
বিশ্বকাপের মৌসুমে কৌতুহলীর মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ফুটবল ম্যানিয়াকের হঠাৎ দেশের জন্ম-মৃত্যুর মতো খটোমটো রাজনৈতিক কচকচি আসছে কীভাবে? আসছে কারণ, গত শতকে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের পতন, বামপন্থী ব্লকের ভাঙন আর নানা যুদ্ধবিগ্রহের ফলে এই যে অসংখ্য দেশের জন্ম-মৃত্যু ঘটেছে, তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়াযজ্ঞ বিশ্বকাপ ফুটবলও।
হ্যাঁ, এই জন্ম-মৃত্যুতে সত্যিই আঁচড় লেগেছে বিশ্বকাপেও। এমন অন্তত ছয়টা জাতীয় দলের নাম করা যায়, যারা একসময় বিশ্বকাপ খেলেছিল, অথচ রাজনীতি-রণনীতির জটিল রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে সেই দেশগুলির এখন আর অস্তিত্বই নেই। সে সব দেশের জনগণের জন্য হয়তো এই জন্ম-মৃত্যু মন্দ হয়নি, হয়তো সেগুলো অনিবার্যই ছিল, কেননা সাধারণভাবে গণমানুষের দাবি ব্যতীত রাষ্ট্রের জন্ম-মৃত্যু তো ঘটতে পারে না; কিন্তু ফুটবলের ধ্রুপদী দর্শকদের জন্য ঘটনাগুলো ক্ষতিরই খতিয়ান। বিশেষত এই ছয়টি জাতীয় দলের তিনটিই যে ছিল ফুটবল বিশ্বে রীতিমতো সমীহ-জাগানিয়া দলের কাতারে। বার কয়েক তারা পৌঁছে গিয়েছিল বিশ্বকাপ জয়ের কাছাকাছিও।
এই ছয়টি বিলুপ্ত জাতীয় দলের একটি দুই বারের সেমিফাইনালিস্ট যুগোস্লাভিয়া।
যুগোস্লাভিয়া (জাতীয় দল– ১৯১৮–২০০৩)
ফুটবলে যুগোস্লাভিয়া কেবল সমীহ করার মতো দলই ছিল না, তারা রীতিমতো প্রথম বিশ্বকাপে খেলা দল। প্রথম বিশ্বকাপেই তারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারিয়ে। পৌঁছে গিয়েছিল সেমিফাইনাল অবধি। এরপর থেকে তারা প্রায় নিয়মিতই বিশ্বকাপে খেলেছে। সেমিফাইনালে গিয়েছিল আরো একবার, ১৯৬২-তে। এরপর থেকেই তারা বিশ্বকাপে অনিয়মিত হতে থাকে।
সত্তরের দশক থেকেই দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল হয়ে পরছিল। ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট মার্শাল যোসেফ ব্রজ টিটো মারা গেলে বহুজাতিক এই রাষ্ট্রে ভাঙনের সুর বাজতে শুরু করে। অবশ্য বলকানে আনুষ্ঠানিক ভাঙনের শুরু হয় ১৯৯১ থেকে। যুগোস্লাভিয়া থেকে আলাদা হয়ে একে একে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, মেসিডোনিয়া এবং বসনিয়া অ্যান্ড হার্জগোভিনা। শুরু হয়ে যায় দশক কাল স্থায়ী যুগোস্লাভ যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুরু হলে জাতিসংঘের সুপারিশ অনুযায়ী ফিফা ১৯৯২ সালে যুগোস্লাভিয়াকে সাময়িক সাসপেন্ডও করেছিল। সেই খাঁড়ায় ১৯৯২ ইউরোতে বাছাইপর্ব উৎরালেও খেলতে পারেনি তারা। এমনকি অংশ নিতে পারেনি ১৯৯৪ বিশ্বকাপেও।
একে একে বাকিরা সবাই যুগোস্লাভিয়ার পতাকা ছেড়ে বের হয়ে গেলেও থেকে যায় সার্বিয়া আর মন্টেনেগ্রো। দেশ হিসেবে যেমন, তেমনি তাদের জাতীয় ফুটবল দলও যুগোস্লাভিয়া নাম নিয়ে খেলতে থাকে। ২০০২ সালে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে যুগোস্লাভিয়া নামটি পরিত্যাগ করে। দেশটির নতুন নাম হয় সার্বিয়া অ্যান্ড মন্টেনেগ্রো। ফিফার খাতা থেকে নামটি বাদ পরে তারও পরের বছর। সেখানেই জটিল রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের শেষ হয়নি। সার্বিয়ান আর মন্টেনেগ্রোরিয়ানদের মধ্যেও দূরত্ব ক্রমশই বাড়তে থাকে। ২০০৬ সালে মন্টেনেগ্রোও আলাদা হয়ে নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর ২০০৮ সালে কসোভো যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে সার্বিয়া থেকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয় কসোভো।
এভাবে এক সময়ের যুগোস্লাভিয়া দল এখন একাই হয়ে গেছে সাতটি দল- ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জগোভিনা, সার্বিয়া, মন্টেনেগ্রো আর কসোভো। ফিফা এদের মধ্যে যুগোস্লাভিয়া ফুটবল দলের সকল অর্জনের উত্তরাধিকার দিয়েছে সার্বিয়াকে। আর বাকিদের মধ্যে ইতিমধ্যেই বেশিরভাগেরই বিশ্বকাপ অভিষেকও হয়ে গেছে। ক্রোয়েশিয়া তো অভিষেকেই সেমিফাইনালে উঠে পুরো ফুটবল ব্শ্বিকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। বাকি দেশগুলোর মধ্যে এখনো বিশ্বকাপের মূল পর্বে নাম ওঠাতে পারেনি কেবল মেসিডোনিয়া, মন্টেনেগ্রো আর কসোভো।
সব মিলিয়ে তাই বলা যায়, ফুটবলপ্রেমীদের জন্য যুগোস্লাভিয়ার এই ভাঙন ফুটবলের এক সমীহ জাগানো শক্তিরই বিদায়। এমন ভাঙাভাঙির পরও যাদের বেশিরভাগই বিশ্বকাপে খেলে ফেলেছে, একটা দল খেলে ফেলেছে সেমিফাইনালও, এখনো একসাথে থাকলে নিশ্চিতভাবেই তারা বিশ্বকাপের কড়া দাবিদারই থাকত। দেখার বিষয়, বলকানরা তাদের যূথবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসার পর, অন্তত কয়েকটি দল, কতদিনে বিশ্বকাপের শক্ত দাবিদার হয়ে উঠতে পারে!