ছোট পরিসরে ১৯২৯ সালের ১৬ মে এক রকম ঘরোয়া পরিসরে যাত্রা শুরু হয় অস্কার পুরস্কারের। সেই ঘরোয়া পরিবেশ ছাড়িয়ে এই পুরস্কারটি এখন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কোন কোন সিনেমা নমিনেশন পেল, তার মধ্য থেকে কোনটি জিতে নিল সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার। কিংবা কে হলেন সেরা অভিনেতা বা অভিনেত্রী, কেনইবা হলেন, কে কে পুরস্কার বঞ্চিত হলেন; এ সব নিয়ে চলে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা। সিনেমা শিল্পের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এবং বহুল আলোচিত এই অস্কার পুরস্কার নিয়ে তুলনামূলক নাতি দীর্ঘ একটি আলাপ হলে মন্দ হবে বলে মনে হয় না!
অস্কার পদক ও একাডেমি
শত শত সিনেমা এবং সে সব সিনেমার শত শত অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলা-কূশলীর মধ্য থেকে যোগ্যদের নমিনেশন ও পুরস্কারের জন্য মনোয়ন দেন যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমি অব মোশন পিকচার্স, আর্টস অ্যান্ড সাইন্স নামক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬ হাজারের অধিক সদস্য। পুরস্কারটির প্রকৃত নাম ‘একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট’, আর পুরস্কারের সঙ্গে দেওয়া পদকটির নাম অস্কার। অস্কার পুরস্কার নামে বহুল প্রচলিত এ পদকটির নকশা তৈরি করেন বিখ্যাত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এমজিএম-এর শিল্প নির্দেশক সেডরিক গিবসন।
ক্যাটাগরি
মোট ২৪টি ক্যাটাগরিতে বর্তমানে অস্কার পুরস্কার দেওয়া হয়। ক্যাটাগরিগুলোর মধ্যে রয়েছে-সেরা সিনেমা, সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য, সেরা রূপান্তরিত চিত্রনাট্য, সেরা মৌলিক কাহিনী, সেরা রূপান্তরিত সিনেমা, সেরা পরিচালক, সেরা অ্যানিমেশন সিনেমা, সেরা অ্যানিমেশন স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা, কেন্দ্রীয় চরিত্রে সেরা অভিনেতা, কেন্দ্রীয় চরিত্রে সেরা অভিনেত্রী, পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনেতা, পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনেত্রী, সেরা শিল্প নির্দেশনা, সেরা চিত্রগ্রহন, সেরা ভিজ্যুয়াল এফেক্ট, সেরা মৌলিক গান, সেরা সুর, সেরা পোশাক পরিকল্পনা, সেরা মেকআপ, সেরা শব্দ সম্পাদনা, সেরা শব্দ সংমিশ্রণ, সেরা ডকুমেন্টারি, সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি, এবং সেরা বিদেশি ভাষার সিনেমা।
সদস্য কারা?
সদস্য হতে হলে সিনেমা শিল্পে উৎকর্ষ অর্জনের পাশাপাশি পূরণ করতে হবে বেশ কিছু শর্ত। একাডেমির সদস্য হতে হলে প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকদের কমপক্ষে দুটি সিনেমায় কাজ করতে হবে। অপরদিকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাজ করতে হবে কমপক্ষে তিনটি সিনেমায়। আর সিনেমার কারিগরি বিষয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের একটি নিদির্ষ্ট সংখ্যক বছর ধরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে। তবে এসব যোগ্যতার কোনটিতে ঘাটতি থাকলে একাডেমির দুই জন সদস্যদের সুপারিশ নিয়ে আবেদন করা যাবে, কিন্তু এরপরও পদ প্রাপ্তির বিষয় সম্পূর্ণই একাডেমি কমিটি এবং এর বোর্ড অব গভর্নরসদের হাতে। তবে পূর্ববর্তী বছরের অস্কার বিজয়ী ও নমিনেশন প্রাপ্তদের কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই সদস্যপদের জন্য বিবেচনা করা হয়।
সকল সদস্য সেরা সিনেমার নমিনেশনের ভোট দিতে পারবেন। এছাড়া শুধুমাত্র নিজ নিজ ক্যাটাগরিতে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকে সদস্যদের। যেমন, ব্রাড পিট শুধু অভিনেতা ক্যাটাগরিতেই ভোট দিতে পারবেন, প্রযোজক কিংবা অন্য কোনো ক্যাটাগরিতে ভোট দিতে পারবেন না।
নমিনেশনের কায়দা-কানুন
চোখ ধাঁধানো চাকচিক্য ও রূপের মুগ্ধতা পরিপূর্ণ হলেও অস্কারে নমিনেশন প্রক্রিয়াটি নেহায়েৎ অঙ্কের সমীকরণ। অঙ্কের এ সমীকরণ মেলানোর কাজটি ১৯৩৫ সাল থেকে সমাধা করছে লন্ডন ভিত্তিক বহুজাতিক অর্থ বিষয়ক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার কুপারস (পিডব্লিউসি)। প্রতিবছর অস্কার নমিনেশনের তালিকা তৈরি করতে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১৭ হাজার কর্ম ঘণ্টা ব্যয় হয়। ভোটের আয়োজন, ভোট গণনা ও ফলাফল তৈরিসহ সব ধাপ শেষ করে তারা শুধু নমিনেশনের তালিকাটি একাডেমিকে পাঠায়।
তবে নমিনেশনের ক্ষেত্রে একাডেমি’র সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতির আলোকেই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান নীতিমালার আলোকে নমিনেশনের জন্য তাদের সিনেমাগুলো নমিনেশনের জন্য জমার দেওয়ার পর শুরু হয় ভোট গ্রহণের কাজ। সদস্যদেরকে তালিকাভুক্ত সিনেমারগুলোর মধ্য থেকে যে কোনো পাঁচটিকে তাদের পছন্দমত ক্রমে নমিনেশন দেওয়ার জন্য বলা হয়। ফলাফল তৈরির প্রক্রিয়ায় পিডব্লিউসি প্রথমে বাচাই করে ক্যাটাগরি অনুসারে কোন কোন সিনেমাগুলো ১০০ বা এর বেশি ভোট পেয়েছে। এরপর ১০০ এর বেশি ভোট পাওয়া সিনেমারগুলোর প্রাপ্ত সংখ্যাকে নমিনেশন সংখ্যার সঙ্গে এক যোগ করে ভাগ দিয়ে দেওয়া হয়। ধরা যাক, কোনো একজন অভিনেত্রী কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্যাটাগরিতে মোট ৭৫০ ভোট পেলেন, এ সংখ্যাটিকে নমিনেশন সংখ্যা পাঁচ-এর সঙ্গে এক যোগ অর্থাৎ ছয় দিয়ে ভাগ করে তৈরি করা হয় ওই অভিনেত্রীর অর্জিত পয়েন্ট।
নমিশনের তুলনায় চূড়ান্ত বিজয়ী নির্বচান করা অপেক্ষাকৃত সহজ। একাডেমির সবাই প্রতি ক্যাটাগরিতে একজনকে ভোট দিতে পারেন। সবচেয়ে বেশি ভোট যিনি পাবেন তিনি হবেন বিজয়ী, আর এর ফলে জনপ্রিয় ভোটকে কাজে লাগিয়েই অনেক মধ্যম মানে সিনেমা পুরস্কার জিতে নেয়। কেননা, সদস্যদের সবার পক্ষে সব বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করা অসম্ভব, এবং এ ধরনের পরিস্থিতিতে আপাত ভালো লাগার ওপর ভিত্তি করেই সাধারণত মানুষ ভোট দিয়ে থাকে। যদিও নীতিবোধের জায়গা থেকে সদস্যদের সব ক্যাটাগরিতে ভোট না দিতে কর্তৃপক্ষ নিরুৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু, এমন মর্যাদা ও প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ পুরস্কারের ক্ষেত্রে নীতি বোধের বিষয়টি কতটাই বা মাথায় থাকে!
সমালোচকদের পাশাপাশি সাধারণ দর্শকদেরও অস্কার পুরস্কারের জন্য সিনেমা মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটিতে সন্দেহ জেগেছে। স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ইতিমধ্যে নানা মহল থেকে মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটিকে বদলানোর পাশাপাশি ভোটিংয়ের পুরো ফলাফল প্রকাশেরও দাবি অনেকেই জানিয়েছেন। কিন্তু দিনশেষে একাডেমিরই যদি সেই বোধ জাগ্রত না হয়, তবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত কি করে সম্ভব?