উত্তর গোলার্ধ জুড়ে নামছে শীত। আমাদের দেশের মতো পুরো উত্তর গোলার্ধে হেমন্তের মাঠে মাঠে ফসল তোলার ধুম। ঠিক এ সময় মার্কিনি তথা পুরো পশ্চিমা সংস্কৃতির কাঠামোতে গড়া বিশ্বে ভোগবাদীদের মধ্যে কেনা-কাটার ধুম লেগে ছিল। কেনা-কাটাকে ঘিরে স্রেফ উন্মাদার এ দিনটি ইতিমধ্যে ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে ব্র্যান্ড খ্যাতি লাভ করেছে।
অন্য ধর্ম বা সংস্কৃতি নির্ভর সমাজে কালো শব্দ বা রঙের অর্থ অন্য কিছু হলেও খ্রিস্টান ধর্মের কোলে বেড়ে ওঠা পশ্চিমা সমাজে ব্ল্যাক বা কালো অশুভ অর্থে ব্যবহৃত হয়-ব্ল্যাক ডেথের নাম শুনলে এখনও ইউরোপবাসীদের শীড়দাঁড়া বেয়ে ভয়ের হিমবাহ নেমে আসে। আভিধানিক অর্থে কোনো মাসের ১৩ তারিখ শুক্রবার হলে সে দিনটিকে পশ্চিমারা অশুভ বা ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে অভিহিত করে থাকে। এছাড়া, আরও বেশ কিছু আর্থিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক ও অন্যান্য বড় ধরনের বিপর্যের সাথে এ ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামটি জড়িত; এমনকি ভবিষ্যতেও জড়ানো হতে পারে।
সে যাই হোক, এমন অশুভ দিনে মানুষের মনে উদ্বেগ কিংবা শঙ্কা থাকার কথা! অনন্ত ইতিহাস তো তাই বলে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের বিপনী বিতানগুলোতে হাশরের ময়দানের মতো ক্রেতাদের মধ্যে অমন উত্তুঙ্গ প্রতিযোগিতা লেগে গেল কেন? বুঝতে হলে, জানতে হবে। কি জানতে হবে? জানতে হবে পণ্যভোগবাদ বা কনজ্যুমারিজম।
প্রতি বছর নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার মার্কিন মুল্লুক জুড়ে পালন করা হয় থ্যাংকস গিভিং ডে। বছরের শেষ ফসলটি ঘরে ওঠার পর এ দিন ঈশ্বদের প্রতি শুকরিয়া আদায়ের পাশাপাশি পূর্ব-পুরুষদের স্মরণ করে মার্কিনিরা। আমাদের দেশের নবান্ন মৌসুমের নতুন চালে মসজিদ কিংবা দরগায় শিরনির দেওয়ার প্রচলের মতো বলা যেতে পারে। ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত ধরে শুরু হলেও জাতির পিতা জর্জ ওয়াশিংটনের আমল থেকে মার্কিনিরা দিবসটি পালন করে আসছে। গৃহ যুদ্ধের পর প্রেসিডেন্ট আব্রাহাস লিংকন একে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এই থ্যাংকস গিভিং ডে-এর পরের দিন অর্থাৎ নভেম্বরের চতুর্থ শুক্রবারকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে অভিহিত করা হয়।
পশ্চিমা বিশ্বে বছরের শেষ ফসল ঘরে ওঠার পর আসে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ক্রিসমাস। উৎসবের আগে আগে হাতে থাকা অর্থ উৎসবকে ঘিরেই খরচ করা হয়, এবং ইতিহাস বিস্মৃতকাল থেকে এমনটি হয়ে আসছে। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে অনেকখানি উত্তরণ ঘটলেও অন্য অনেক অধরা প্রথার মতো মানুষের চেতন-অবচেতনে উৎসবকে উপলক্ষ করে কেনার সহজাত প্রবণতা সব দেশে সব সমাজে পুরোপুরি রয়ে গেছে। এ সুযোগটিই খুব চাতুর্যের সহিত কাজে লাগিয়েছে মার্কিন মুল্লুকের ব্যবসায়ীরা। ভোগ্যপণ্যবাদের আর্দশিক মানষ প্রতিমা মার্কিন ব্যবসায়ী ও সমাজের দেখানো পথে বিশ্বের অপরাপর ভোগবাদীরা হুক্কাহুয়া হল্লা তোলে তাদের অনুসরণ করছে, এটাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বাস্তবিক চিত্র।
পণ্য ব্যবসায়ীদের প্রধান লক্ষ্যই থাকে বিকি-কিনির মৌসুমকে দীর্ঘ করা। উনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের শুরুতে একদল চতুর ব্যবসায়ী থ্যাংকস গিভিং ডে-তে অনুষ্ঠিত শোভাযাত্রার আয়োজনে অর্থায়ন করতে শুরু করেছিল, এবং একই সঙ্গে তাদের পণ্যগুলোর প্রচার ও প্রসারে দিতে লাগলো ছাড়সহ নানা রকমের সুযোগ সুবিধা। ওই সময়ে উদ্দেশ্য ছিল মাস খানেক পরে ক্রিস মাস উপলক্ষে ক্রেতাদের মধ্যে কেনা-কাটার একটা আবহ তৈরি করা। এটাকে মাসব্যাপী কেনা-কাটার শুভ মহরত বলা যায়। শুভ মহরতের আয়োজন যত ঝাঁকালো হবে, ভোক্তার মানসপটে তত বেশি ভাসবে নানা রকম পণ্য; একই সঙ্গে তৈরি হবে মনস্তাত্বিক চাহিদা। চাহিদা যত বাড়বে পণ্যের বিকি-কিনিও তত বাড়বে।
পুঁজিবাদ ঝাড়ে বংশে বেড়ে পণ্যভোগবাদ হয়ে সবার জীবন যাপনে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসেছে। যারা বাইরে রয়ে গিয়েছিলেন বা এখনও আছেন, তাদেরকে কব্জা করতে জীবন যাপনের বিন্যাসগুলো ভেঙ্গে-চুরে ভোগ্যপণ্যের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। মার্কিন মুল্লুকের সেই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দেখানো পথে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের ব্যবসায়ীরা মানব জীবনের উৎসব, ঐতিহ্য ও প্রথার সঙ্গে কেনা-কাটার মানসিকতা সেঁটে দিয়েছে। উৎসব মানে যত পারো যত রকমে পারো কেনো, যত পারো সেবা গ্রহণ করো; সর্বপোরি যত পারো ভোগ করো। ধীরে ধীরে ভোগবাদীদের রঙিন চশ্চমার মধ্য দিয়ে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভিতরে-বাইরে উপভোগ ও উপলব্ধি লাভের আদলে সমাজ কাঠামো ও জীবন যাপনকে গড়ে তোলা হয়েছে।
মার্কিন ব্যবসায়ীদের ক্রেতা বাগানোর সেই ফন্দি বেশ ভালোভাবে কাজে লেগেছিল। ছাড়সহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধায় এক সময় থ্যাংকস গিভিং ডে-এর পরদিন দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ঢল নামতে শুরু করলো। ক্রেতাদের ঢল সামলাতে দোকান খোলার সময় সকাল ৭ টা থেকে ভোর ৫ টায় নেওয়া হয়েছিল, তবুও ঢল সামলানো যাচ্ছিল না। দোকান খোলার সময় এগিয়ে আসতে আসতে ঠেকলো মধ্যরাতে অর্থাৎ রাত ১২টায়। ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে ক্রেতাদের ঢল সামলাতে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে নামানো হয় বাড়তি পুলিশ। এ দিন সাধারণ ছুটি থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশি অঙ্গরাজ্যের সরকারি অফিসগুলোতে। এমন এক ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে ক্রেতা কেনাকাটার উন্মাদনার ঢলে দেশটির ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, রাস্তা জুড়ে যানজট-মানবজটের তালগোল পাকানো ভীতি জাগানিয়া অবস্থাকে বোঝাতে ব্ল্যাক ফ্রাইডে শব্দটি সেবারই প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। অর্থ্যাৎ পশ্চিমা বিক্রয় বাণিজ্যের ছকে পণ্যভোগবাদের দিকবিদিক কুচকাওয়াজে সৃষ্ট ভয়াবহ বিপর্যয়কে ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে অভিহিত করা হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারক-বাহক ও অনুসারী দেশগুলোতেও কেনাকাটার উম্মাদনা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, আর ক্রেতারা তাতে ঝাপিয়ে পড়েন সদলবলে। বছর বছর ব্যবসায়ীরা গুণে চলেছেন পণ্য বিক্রির কাড়ি কাড়ি টাকা, আর ক্রেতা গুণে চলেছেন কেনা-কাটার ব্যাগের সংখ্যা।
দিবসের নাম যাই হোক না কেন, পণ্য বিকি-কিনিই দিনশেষে ব্যবসায়ীদের মোক্ষম উদ্দেশ্য। আর তাই ব্যবসায়ীরাও এ দিবসটির পালে সজোরে হাওয়া দিয়ে যাচ্ছেন বহুবিধ রঙে-ঢঙে, ক্রেতারাও সেই হাওয়ায় গা ভাসাচ্ছেন। ব্ল্যাক ফ্রাইডে আদতে ক্রেতাদের ‘ব্যাগ ফ্রাইডে’-তে পরিণত হয়েছে। পণ্যভোগবাদকে উসকে পশ্চিমা সেল বাণিজ্যের এমন চমৎকারিত্বে বেঁচে থাকলে স্বয়ং এপিকিউরিয়াসও হার মানতে বাধ্য হতেন।