হাথুরুকে মনে রাখবে বাংলাদেশ

মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠে ১৯৯৬ সালে আইসিসি ট্রফি জেতার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের স্বপ্ন যাত্রার শুরু। এরপর রীতিমতো জোয়ার বয়ে গেছে ক্রিকেটের, সারা দেশের সবাই এখন চোখ রাখে বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমের প্রতিটি খবরে। ১৬ কোটি দেশের মানুষের প্রাপ্তির একমাত্র জায়গা হয়ে দাঁড়ায় এই ক্রিকেট। একরাশ আগ্রহ নিয়ে খেলা দেখতে বসে দেশবাসীর আশা থাকতো যেন লজ্জাজনকভাবে না হারে, বিশ্ববাসী যেন অন্তত এটা বলে যে, বাংলাদেশ দল লড়াই করতে জানে।  সেই ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল অবধি কদাচিত জয়ের সুবাসে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো পুরো দেশ। কিন্তু বিপক্ষ দলকে দুমড়িয়ে-মুচড়িয়ে হোয়াইট ওয়াশ করবে বাংলাদেশ-এমন ঘটনা দেখতে পাওয়াটা ছিল নেহায়েত স্বপ্নই।

প্রধান কোচ হাথুরুসিংহের পরিকল্পনা মন দিয়ে শুনছেন টেস্ট দলের অধিনায়ক মুশফিক

সে স্বপ্ন এখন পুরোপুরি বাস্তব। বিগত তিন বছরে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল ঈর্ষনীয়; অন্তত বাংলাদেশি ক্রিকেট ভক্তদের কাছে তাই মনে হবে। দেশবাসী তো বটেই, একবাক্যে বিশ্বের বড় বড় সব ক্রিকেট বিশ্লেষক যার কৃতিত্ব দেন ক্যাপ্টেন মাশরাফিকে। তথাপি দলের কোচের ভূমিকা কি কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যায়? না, দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে কোচ হাথুরুসিংয়ের অবদানও কখনও হারিয়ে যাবে না। কিন্তু সাফল্যের পাশাপাশি তিনি নিজেকে জড়িয়েছেন বেশ কিছু অপ্রীতিকর বা বিতর্কিত বিষয়েও।

বদলে যাওয়া বাংলাদেশ দলের অদম্য বিজয় উচ্ছ্বাস

আসুন দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে কোচ হাথুরুসিংয়ের অধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য দশ ঘটনা।

১।। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবতকালের সবচেয়ে সফল কোচ হাথুরু। এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু পরিসংখ্যান হাথুরুর পক্ষে।

সামগ্রিক পরিসংখ্যান: (১১ এপ্রিল, ২০১৭ পর্যন্ত) 

  ম্যাচ জয় পরাজয় টাই/ ফলাফল হয়নি জয়ের হার
এপ্রিল ২০১৪  ২৮৩ ৮০ ২০০ ২৯%
মে ২০১৪ ৪১ ২২ ১৭ ৫৬%

সূত্র: ইএসিপএন

২।। হাথুরুর সময়কালে বিশ্বের শীর্ষ ৮ দলের বিপক্ষে লড়াইয়ে চোখে চোখ রেখে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।

শীর্ষ ৮ দলের বিপক্ষে (ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, শ্রীলংকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ) পরিসংখ্যান:

  ম্যাচ জয় পরাজয় টাই/ ফলাফল হয়নি জয়ের হার
এপ্রিল ২০১৪ ১৯১ ২৭ ১৬১ ১৪%
মে ২০১৪ হতে ২৮ ১০ ১৬ ৩৮%

সূত্র: ইএসিপএন

শীর্ষ ৮ দলের বিপক্ষে সিরিজ:

  সিরিজ জয় পরাজয়
এপ্রিল ২০১৪ ৫৫ ৪৮
মে ২০১৪

সূত্র: ইএসিপএন

৩।। তার সময়ে টেস্ট ও টি২০ ক্রিকেটেও এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ।

ফরম্যাট ম্যাচ জয় পরাজয় টাই/ ফলাফল হয়নি জয়ের হার
টেস্ট ১৭ ২৯%
টি২০ ২৫ ১১ ৩৬%

সূত্র: ইএসিপএন

৪।। নিজ দেশের মাটিতে টেস্ট ম্যাচে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করে এবং বিদেশের মাটিতে পরাজিত করে শ্রীলংকাকে। নিজ দেশের মাটিতে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়াডে সিরিজ জিতে বাংলাদেশ।

৫।। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ; আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ডের পাশাপাশি পরাজিত করে শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে। যদিও ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের সুপার এইট পর্বে খেলেছিল; কিন্তু ওই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালের পরিবর্তে সুপার এইট পর্ব রাখা হয়েছিল।

৬।। সর্বশেষ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমিফাইনালিস্ট হিসেবে নাম লিখিয়েছিল বাংলাদেশ। আইসিসি’র কোনো বড় কোনো টুর্নামেন্টে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

৭।। প্রথমবারের মতো আইসিসি ওয়াডে র‌্যাংকিয়ের ৫ম স্থানে জায়গা করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ আইসিসি ওয়ানডে র‌্যাংকিংয়ের ৭ম স্থানে রয়েছে।

৮।। সাফল্যের পাশাপাশি বেশ কিছু বিতর্কিত বিষয়েও জড়িয়েছেন হাথুরু; এর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নেয়নি বাংলাদেশের ক্রিকেট মহল। নিউজিল্যান্ড সফরে অফ-ফর্মে থাকা শুভাগত হোম ও সৌম্য সরকারকে মূল একাদশে রেখে সমালোচনার মুখে পড়েন হাথুরুসিংহে। এর আগেও পারফরম্যান্স না থাকা সত্ত্বেও নিজের পছন্দের খেলোয়াড়দের খেলিয়ে তিনি বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন।

৯।। তার কথায় বোর্ডের অনুরোধে টি২০ ক্রিকেটের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন মাশরাফি। এ নিয়ে সে সময় ক্রিকেট মহলে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়।

১০।। দল সাজানো, দলের লক্ষ্য নির্ধারণ, একাদশ তৈরি, এমনকি ব্যাটিং অর্ডার তৈরিতেও তিনি সর্বেসর্বা ভূমিকা রেখেছন। এ নিয়ে সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন বিতর্কে। তার হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত মুশফিককে পরিবর্তিত ব্যাটিং অর্ডারে নামতে হয়। এতদসত্ত্বেও টেস্ট সিরিজে ব্যর্থতার দায়ভার এসে পড়ে মুশফিকের ওপর। বিশেষত টসে জিতে কেন ব্যাংটিং নেওয়ার বিষয়টিতে সবাই দোষ দিচ্ছে, কিন্তু টস জয়ে পর কি নেওয়া হবে সে সিদ্ধান্ত অন্তত বাংলাদেশ দলে ক্যাপ্টেনের একার নয়।

সবকিছুর শেষে বলা যায়, বিগত তিন বছর ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম স্বর্ণ যুগ। বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট সমর্থকরা প্রথমবারের মতো নিজেদেরকে এক অনন্য উচ্চতায় আবিষ্কার করেন। প্রথম ভালোলাগা যেমন কখনও ভোলা যায় না, তেমনি প্রথম অর্জনও কেউ কখনও ভোলে না। বাংলাদেশও ভুলবে না ক্রিকেটের এ সোনালী সময়কে, ভুলবে না কোচ হাথুরুসিংহকে।